
ড. মো. মোশাররফ হোসেন ||
দেশে
করোনা সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এর
ভয়াল থাবা কত দূর বিস্তৃত হবে তা নিয়েও উদ্বেগ আছে। করোনা ভাইরাসের ডেল্টা
ভ্যারিয়েন্ট এবং এর রূপান্তরিত ধরন ‘ডেলটা প্লাস‘ এ উদ্বেগ ও শঙ্কাকে
বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগের সব মহামারীকে ছাপিয়ে বিশ্বে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে
মৃত্যুর নতুন রেকর্ড তৈরি করবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সংক্রমণের সর্বশেষ
ধারায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। আগে গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ খুবই কম ছিল, এখন
সেখানেও সংক্রমণ বেড়েছে দ্রুতগতিতে। এরই মধ্যে গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণের হার
৫০ শতাংশে উঠেছে।
জুনের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে জুলাইয়ের মধ্যভাগের
পরিসংখ্যানে দৃষ্টি দিলেই দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে
উঠবে। সংক্রমণের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির সাথে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর মিছিল। সমগ্র
বাংলাদেশে কান পাতলে শোনা যাবে সেই ক্রন্দনধ্বনি। কত মানুষ লাশ হয়ে ঘণ্টার
পর ঘণ্টা পড়ে ছিল আপনজন, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন কেউ আসেনি দাফন
কিংবা সৎকার করতে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক লাশের দাফন কিংবা সৎকার সম্পন্ন
করেছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তখনই শঙ্কা ছিল
নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি থামাতে সরকার
এলাকাভিত্তিক লকডাউন আরোপ করেছিল। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে
পারলেও সফলভাবে বিস্তার রোধ করতে পারেনি। কারণ আমরা লকডাউন সঠিকভাবে
মানিনি। নানা অজুহাতে ঘরের বাইরে চলে আসছি। যে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার
জন্য লকডাউন সেই মানুষই লকডাউন বোঝেনি, বুঝলেও মানেনি, মানলেও পুরাপুরি
মানেনি। সংকট সঠিকভাবে মোকাবিলা না করতে পারার এ কারণটিকে খাটো করে দেখার
উপায় নেই।
আমরা যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সংক্রমণের লাগাম টেনে
ধরতে সম হচ্ছিলাম তখনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো তৃতীয় টেউ এসে হাজির।
ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং এর রূপান্তরিত ধরন ‘ডেলটা প্লাস‘। যার
সংক্রমণের হার অন্য সকল ভ্যারিয়েন্ট থেকে অনেক বেশি এবং মৃত্যুর হারও বেশি।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে রাশিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে
সংক্রমণ আবার বেড়ে চলেছে। অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের
দ্বারা আশঙ্কাজনকভাবে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে ডেল্টা
ভ্যারিয়েন্ট এবং ডেল্টা প্লাসের মারাত্মক ছোবলে বাংলাদেশও আজ নাজুক
পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। ৬০ জেলায় সংক্রমণের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী, অধিকাংশ
জেলা আবার অতি উচ্চ ঝুঁঁকিসম্পন্ন। জুনের শেষ ভাগে এসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর
সংখ্যা যখন আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকল সরকার এই ঊর্ধ্বগতি থামাতে কঠোর
লকডাউন আরোপ করেছিল।
করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ
করছে। প্রথম থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রি-অ্যাকটিভ ব্যবস্থাপনার প্রতি
গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় প্রথম থেকেই যে দিকটি উপেতি
হয়ে আছে সেটি হলো প্রো-অ্যাকটিভ ব্যবস্থাপনা। রোগের ভয়াবহতা পূর্বানুমান
করতে অমতা, সেই সাথে বিস্তার রোধের কার্যকর পদপে প্রণয়নে অপারগতা এবং
ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে উদাসীনতা অন্যতম। বিস্তারকে আমরা উৎসে আটকে
দিতে পারিনি শুধু প্রো-অ্যাকটিভ পরিকল্পনার অভাবে।
৮ মার্চ, ২০২০
বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ছিল একজন নারী
ও দুইজন পুরুষ। তাদের মধ্যে দুইজন ইতালি থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। অপর একজন
তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তখন থেকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে
পারিনি প্রো-অ্যাকটিভ পরিকল্পনার অভাবে। বিদেশ ফেরত যাত্রীদের ব্যবস্থাপনায়
ছিল না কোনো সমন্বয়, ছিল না কোনো কৌশলিক পরিকল্পনা। যদি
পূর্বানুমানভিত্তিক কৌশলিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের
সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা যেত তা হলে আজকের এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত বলে
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আবার ভারতের করুণ পরিণতি দেখার পরও আমরা কার্যকর
পূর্বপরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতের যাত্রী/রোগীকে আটকাতে পারিনি। পারিনি
সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করতে। সীমান্ত রা বাহিনীকে আরও দৃঢ়ভাবে কাজে লাগানো
যেত। হয়নি তা, যার নির্মম পরিণতি জীবননাশ।
১১ এপ্রিল ২০২০ করোনা
ভাইরাসকে মহামারী বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই মহামারি
মোকাবিলায় আমাদের সঠিক প্রস্তুতি ছিল না। পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য
আমাদের স্বাস্থ্য খাত প্রো-অ্যাকটিভ পরিকল্পনা করেনি। যথেষ্ট আইসিইউ,
ভেন্টিলেটর ও চিকিৎসক প্রস্তুত করেনি। রোগের বিস্তার রোধের পাশাপাশি রোগী
সামলানোর ব্যাপারটি করোনা মোকাবিলার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
দেশে করোনা
রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও হাই ফো নেজাল ক্যানুলা সংকটের
বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন
সরবরাহের জন্য আইসিইউ বা হাই ফো নেজেল ক্যানুলার দরকার হয়। রোগীর সংখ্যা
ক্রমাগত বাড়তে থাকায় অনেক হাসপাতালেই রোগীর ঠাঁই হচ্ছে না। জরুরি হলেও
অনেককে আইসিইউ সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। ভেন্টিলেটর, হাই ফো নেজাল ক্যানুলাসহ
অনেক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। তাই দ্রুত হাসপাতালগুলোতে ধারণমতা ও
জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে চিকিৎসক, নার্স ও
টেকনিশিয়ানের সংখ্যা। এই সংকটের মধ্যে কিছুটা আশার খবর দিয়েছে বাংলাদেশ
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল শিক-শিার্থীর উদ্ভাবিত ‘অক্সিজেট‘
নামের একটি যন্ত্র। এই যন্ত্রের মাধ্যমে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদেরও
হাসপাতালের সাধারণ বেডে রেখেই উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সহায়তা দেওয়া যাবে।
যন্ত্রটির উৎপাদন খরচও খুব বেশি নয়। বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ এরই
মধ্যে যন্ত্রটি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। করোনা চিকিৎসায় যন্ত্রটি
ব্যবহারের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন দরকার। সে জন্য যন্ত্রের
বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। অথচ স্বাস্থ্য
অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এ ব্যাপারে আরও ত্বরিত পদপেই জাতির
প্রত্যাশা ছিল।
গোটা বিশ্ব প্রো-অ্যাকটিভ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করোনা
মোকাবিলা করছে। করোনার বিস্তার রোধে টিকা কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
অর্থাৎ সংক্রমণের আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। এখানেও টিকা সংগ্রহে শৈথিল্য
পরিলতি হয়েছে। দেশে টিকাদান শুরুর পর থেকে এ
পর্যন্ত দুই ডোজ টিকা
পেয়েছেন মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৫ শতাংশের মতো। কমপে ১০ কোটি মানুষকে দুই
ডোজ করে টিকা দিতে হলে ২০ কোটি ডোজের ওপরে টিকা প্রয়োজন। তাই টিকা সংগ্রহে
আরও মনোযোগী হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার েেত্র মানুষকে আরও সচেতন
করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এ কাজে লাগানো যেতে পারে।
এলাকাভিত্তিক নাগরিক কমিটিও এ সচেতনার কাজটি করতে পারে। রাজনৈতিক
ব্যক্তিত্ব, জনপ্রতিনিধি, শিক-অভিভাবক যার যার অবস্থান থেকে এ মহামারী
নির্মূলে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অধিকতর
প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকায় দেখতে চাই। কারণ এটি জীবনের প্রশ্ন, সম্ভাবনাকে
বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্ন। প্রতিটি মানুষ মানেই অফুরন্ত সম্ভাবনা। সামান্য
অবহেলা বা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদেেপর অভাবে অকালে ঝরে পড়তে পারে শত সহস্র
সম্ভাবনাময় কুঁঁড়ি কিংবা নিভে যেতে পারে জাতির আশার প্রদীপ। যা কারোরই
কাম্য নয়।
ড. মো. মোশাররফ হোসেন : অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়