ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
লেখকের দায়, লেখকের প্রতিক্রিয়া
Published : Tuesday, 30 August, 2022 at 12:00 AM
লেখকের দায়, লেখকের প্রতিক্রিয়াশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে:
বিগত কয়েকদিন যাবত আমার লেখা ‘কুমিল্লায় সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা: বর্তমান হালচাল’ নিয়ে ফেইসবুকে প্রচুর স্ট্যাটাস ও মন্তব্য প্রচারিত হয়। এ প্রেক্ষিতে আমার শুভানুধ্যায়ীগণ বলেন- ‘এখন তোমার কিছু বলা দরকার’। আমি বলি- ‘আরও কিছুদিন যাউক। কারণ বিষয়টি আমি দারুণভাবে উপভোগ করছি।’ তাঁরা মানতে চায় না বলে এ লেখা।
আমি লেখাটি শুরু করেছি- ‘অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, বর্তমানে কুমিল্লায় সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা কেমন চলছে। কারণ, এককালে কুমিল্লা শহরকে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান বলা হতো।’ আমি সংগত ও স্বাভাবিকভাবে ধরে নিয়েছি, যাঁরা প্রশ্ন করেছেন, তাঁরা কুমিল্লা শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা বিষয়ের অতীত ইতিহাস জানেন। কাজেই এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন নেই। তারপরও লেখাটার সূচনাপর্বে একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরি পরবর্তী বক্তব্যকে উপস্থাপনের সুবিধার্থে। কাজেই কুমিল্লায় সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ইতিহাস লেখা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, প্রয়োজনও বোধ করিনি। আর লেখাটি ছিল প্রশ্নকারীদের জন্য। কিন্তু যখন কোনো লেখা ছাপাক্ষরে প্রকাশিত হয়, তখন তা সার্বজনীন হয়ে যায়। যে কেউ পড়তে পারেন, প্রাসঙ্গিক মতামত প্রকাশ করতে পারেন-এটাই স্বাভাবিক।
‘বর্তমান হালচাল’ অংশে চলমান কয়েকটি সংগঠনের কথা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। প্রসঙ্গক্রমে সংগঠকদের কথাও বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি- কোনো সংগঠন সম্বন্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করিনি, কোনো সংগঠককে অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিনি। তারপরও ফেইসবুকে নানা স্ট্যাটাস ও মন্তব্য। উল্লেখ করতে হয় প্রথম যিনি আমার লেখাকে সামনে রেখে আমাকে আক্রমণ করে স্ট্যাটাস প্রদান করেন এবং ধারাবাহিকতায় মন্তব্য আসতে থাকে, স্বল্পসময়েই তা ফেইসবুক থেকে সব লেখা উধাও হয়ে যায়, সবটুকু মন্তব্যও পড়ে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয়বার যখন একই ব্যক্তি স্ট্যাটাস প্রদান করলেন, মন্তব্যও আসতে শুরু করল, স্বল্পসময়েই তা ফেইসবুক থেকে উধাও হয়ে গেলো। বুঝলাম না- ‘হিংসুটে মনোভাব ও মানসিক সংকট’ আমার, না স্ট্যাটাসপ্রদানকারীর। অনুভব করলাম স্ট্যাটাস প্রদানকারী, যাকে আমি স্নেহ করতাম, এখন সে আমার সমকক্ষ নয়, অনেক বড়মাপের একজন কেউকেটা হয়ে গেছেন অনেক আগেই। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে বুঝে উঠতে পারিনি।
আমি এতটুকু জানি-
‘আপনাকে বড়ো বলে- বড়ো সেই নয়;
লোকে যাকে বড়ো বলে-বড়ো সেই হয়।’
আমি ‘বর্তমান হালচাল’ অংশে যে বার্তাটি দিতে চেয়েছি, তা হয়ত অনেককেই বুঝাতে পারিনি। তা আমার ব্যর্থতা। আমি যে কথাটি বলতে চেয়েছি, তাহলো-
১. যদি কোনো ‘সংগঠন’ ব্যক্তি বা পরিবার কেন্দ্রিক হয়ে যায়, তাহলে সার্বজনীনতা হারিয়ে ফেলে।
২. পরবর্তীতে ব্যক্তি বা পরিবারের অনুপস্থিতিতে সংগঠনটি হারিয়ে যায়।
৩. তাতেই আমার আতংকিত ও হতাশার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। উদাহরণস্বরূপ প্রথমেই ‘অলক্ত সাহিত্য পরিষদ’ ‘অলক্ত পত্রিকা’ ও ‘অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার’ বিষয়টির পরিণতির কথা উল্লেখ করেছি।
চলমান সংগঠন ‘বিনয় সাহিত্য সংসদ-এর কথা বলতে গিয়ে লিখেছি- ‘যেহেতু সংগঠন, সেজন্য একটি কমিটি আছে, কিন্তু প্রাণপুরুষ মাহবুব। সংগঠনের সকল কর্মধারায় তার পরিকল্পনাই শেষ কথা।’ জানি না, মাহবুব কেন এতটা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন। এবং অব্যাহত মিথ্যা বিষোদাগার করে যাচ্ছেন। হিংসুটে ও মানসিক সংকট হয়ত তা-ই। পছন্দ-অপছন্দ বা যোগ্য-অযোগ্য এককথা নয়। তা বুঝতে দূরদর্শিতার দরকার, বিবেকবুদ্ধি শাণিত করতে হয়।
‘তিন নদী পরিষদ’ এ উল্লেখ করেছি- ‘এই দায়িত্বটা এককভাবে আবুল হাসানাত বাবুল কাঁধে তুলে নিয়েছেন।.... এই কর্মকাণ্ডটি ইতিহাসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।’ স্নেহভাজন বাবুল অবশ্য কোনো মন্তব্য করেননি।
‘রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’এ উল্লেখ করেছি- ‘... কেন জানি ডা. মল্লিকা বিশ্বাস নির্ভর হয়ে পড়েছে কুমিল্লার শাখাটি। আমার এ মূল্যায়নে স্বাভাবিকভাবেই সংগঠনের কর্তা ব্যক্তিরা, বিশেষ করে ডা. মল্লিকা বিশ্বাস কষ্ট পেতে পারেন। কিন্তু সংগঠনের স্বার্থে সংঘশক্তিকে পরিচালিত করতে কোনো একজনকে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে অবশ্যই তাঁদের মধ্যে কোনো অভিমান নেই। এক্ষেত্রে তৃপ্তীশ-মল্লিকা দম্পতিকে সাধুবাদ জানাই এজন্য যে, তাঁরা নিজেদের মতো করে সাহিত্যচর্চা করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।’ তাঁরা দু’জনই আমার স্নেহভাজন, তাদের কল্যাণ কামনাপ্রার্থী নিরন্তর।
কুমিল্লায় সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় যারা বর্তমানে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। আমি ২০/২৫ জনের নামও উল্লেখ করেছি। বিস্তারিত লেখার প্রয়োজনবোধ করিনি। প্রবন্ধটির শেষাংশে লিখেছি- ‘তারপরও কুমিল্লা ছিল ঐতিহ্যে-গৌরবে-ইতিহাসে, এখনও আছে আপন ভুবনে বিরামহীন পথচলার আনন্দে। কুমিল্লা তো কুমিল্লাই, আমাদের ঠিকানা।’
আমরা আসলে কেউ গভীরভাবে কোনো লেখাই পড়তে চাই না। কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলক বা ব্যক্তিপর্যায় কোনো প্রচেষ্টায় উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে কোনো কোনো লেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়, লেখাটা তখন পড়তে চায় অনেকেই। আমি এ লেখা লিখে তৃপ্ত এজন্য যে যেভাবেই হোক যে কারণেই হোক কতিপয় পাঠক তা পড়েছেন। পত্রিকায় আমার অন্যদিনে অর্থাৎ মঙ্গলবারের কলাম পড়েন কী না জানি না।
বিদ্যাবুদ্ধি তো কম তাই বলছি- কচুচাষী কচুক্ষেত করেছেন। কচু বড় হলে শাক খাবেন, বিক্রি করবেন, কচু তরকারি খাবেন, বিক্রি করবেন, বিলি করবেন। সেই কচু ক্ষেত থেকে যদি কেউ কচু তুলে নিয়ে গায়ে মেখে চুলকানি সৃষ্টি করে, তাতে কচুচাষীর কী করার থাকতে পারে ?দায়ও বা নিবে কেন ? আমার লেখা যে কারো কারো চুলকানি সৃষ্টি করেছে, তা দেখে-শুনে অবাক হচ্ছি।
বিনয়ের সাথেই বলছি, আমি যাঁদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এ লেখাটি লেখেছি এবং কুমিল্লার কতিপয় সংগঠনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার আতঙ্কিত ও হতাশার কথা উল্লেখ করেছি, এটা নিতান্তই আমার নির্মোহ মূল্যায়ন। এ দায় আমার। কেউ যদি স্বেচ্ছায় গায়ে মেখে কষ্টানুভব বা যন্ত্রণা ভোগ করেন, তাহলে আমিও তো কষ্ট পাবো। কারণ, কচু ক্ষেত যেমন কচুচাষীর, তেমনি লেখাটি তো আমার। অযথা কষ্ট ভোগ করবেন না- এ অনুরোধ রইল। একথা তো ঠিক যে আমরা প্রত্যেকেই নিজের হাতে সাড়ে তিনহাত, আমার হাত দিয়ে অন্যকে মাপতে গেলে সমস্যা তো হবেই। এটা কেউ মানতে চাইবে না হয়ত। সেজন্য মনে মনে ভাবছি মাপলেও তা জানানো যাবে না।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক নির্মল সাহিত্য চর্চা বিশেষ। তাতে অনেক সুপ্ত বিষয় প্রকাশ পায়, ব্যক্তি ও ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা ও অভিজ্ঞতার নির্যাস উপভোগ করা যায়। চলুক না বিতর্কচর্চা, ক্ষতি কি ? সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা এ অর্থে বারোয়ারী। এক্ষেত্রে সংগঠনের নীতি-আদর্শ অবশ্যই থাকতে হয়। যারা সে ধারায় বিশ্বাসী হবে, তাদের জন্য দরজা-জানালা খোলা থাকে। সংকীর্ণ-মানসিকতা যাপন করে এক্ষেত্রে বেশি সুবিধা করা যায় না। এজন্যই সুবিধাবাদীদের কারণে এখন সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অযোগ্যরা তাকে ব্যবসায় পরিণত করেছে, জীবিকা নির্বাহের হাতিয়ার করতে গিয়ে শুভ ও নান্দনিক বিষয়টিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তা কখনও কাম্য নয়। এক্ষেত্রে আমাদের শুভবুদ্ধি উদয় হোক, তা প্রত্যাশা করি।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫