ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
একটি ভ্রমণের সাতকাহন
Published : Tuesday, 30 November, 2021 at 12:00 AM
একটি ভ্রমণের সাতকাহন শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
নবম অধ্যায়
এই শান্তিনিকেতনে তথা বিশ্বভারতীতে প্রবল আবেগ নিয়ে জীবনের পড়ন্ত বেলায় গিয়ে চারদিন কাটিয়ে এলাম। এ স্বল্প সময়ে শুধু চোখেই দেখেছি, উষ্ণতা লাভ করতে পারিনি, তা যে কত বেদনাদায়ক তা বুঝানো যাবে না। মাঝে মাঝে চোখের জল পড়েছে। কেন জীবনের প্রথমভাগে এলাম না। সকালবেলায় গাছতলায় যখন ক্লাশগুলো বসেছে, প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়েছিল তাদের সাথে অংশগ্রহণ করি। আশ্রমের কথা শুনেছি- আশ্রমিক জীবনযাপনের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ছেলে-মেয়েদের নির্ধারিত পোষাক। মেয়েরা যখন অফ-হোয়াইট জমিনে লাল পাড়ের শাড়ি পরে সাইকেলে চড়ে ক্লাশে আসছে দেখে মনে হয়েছে তারা সকলেই যেন ঋষিকন্যা। তাদের কথাবার্তায় অনুচ্চ কণ্ঠ, সদাহাস্য অবয়ব, বিনীত জিজ্ঞাসা ও মার্জিত পোশাক পরিধানের মধ্যে এক বিশেষ রাবীন্দ্রিক আবেশ ছড়িয়ে রয়েছে। এখানে সবাই দাদা বা দিদি, শিক্ষকগণ ‘মাস্টারমশাই’ সম্বোধনে সমৃদ্ধ। শান্তিনিকেতনকে গ্রামও বলা যাবে না, শহরও বলা যাবে না। একমাত্র ‘আশ্রম’ শব্দটি যথার্থভাবে প্রযোজ্য। কী নেই সেখানে। সবই আছে, আছে ছাতিমগাছের ছায়া, ফুলের উৎকর্ষ ঘ্রাণ, অশত্থগাছের বিশালতা, আশ্রিত পাখিদের কূজন, বন্যতা নেই-আছে বনের ভালবাসা ও স্নিগ্ধতা, সাপগুলোও যেন নান্দনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। রামকিংকরের ভাস্কর্যের অসাধারণ উপস্থিতি ত্রিকালকে সময়ের বাঁধনে বেঁধে রেখেছে। সাঁওতাল সমাজের প্রতিচ্ছবি স্থান-কাল-পাত্রকে উচ্চকিত করে তুলেছে, যার পরশ শুধু মাটির রং-এ সীমাবদ্ধ না থেকে বৈশ্বিক মিলনভূমি হয়ে ধন্য হয়ে ওঠেছে শান্তিনিকেতন। আবেগ আর ভালবাসা পোষাকি আবরণে আবদ্ধ থাকছে না বলেই প্রতিটি সদস্য রবীন্দ্র-মানসিকতায় নিজেদের করে তুলেছে সমৃদ্ধ। এটা তাদের অহংকার হতে পারত, কিন্তু তা অনেকটাই প্রথাগত স্বাভাবিকতায় ভরে ওঠেছে। তাই সাধারণ চায়ের দোকানে বসে যখন ছাত্র-শিক্ষক-বন্ধু আড্ডা জমিয়ে রাতের প্রহর বাড়িয়ে দেন, তখন মনেই হয় না- সেখানে থেকে তারা নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে হবে। দোকান সাজিয়ে বসেছে নারী-পুরুষেরা, রাস্তার পাশে মাটিতে বই-এর পশরা, সন্ধ্যায় চটপটি বা ঝাল-টকের দোকান-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেচা-কেনা, ক্রেতাদের দেখে মনেই হয় না অন্য জগতের বাসিন্দা, বৈষ্ণবীয় আভরণে কেবলি নিজের অভিজ্ঞতা ও মেধাচর্চার আলোকে নিজেদের এমন করে রেখেছে, দেহটা হিমশীতলে আচ্ছন্ন, মন বৈরাগীভাবে ত্যাগ-মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে-
‘এই বাঙালি কবির মধুর বাঁশির সুর শুনে আমরা যেন এক বহমান নদীর
ভাটার টানে উৎসের দিকে ফিরে যাওয়ার আকর্ষণ বোধ করি।’
শান্তিনিকেতনবাসীর উক্তি যেন-
‘যে মুহূর্তে আমরা এই কবিকে পড়তে আরম্ভ করি আমাদের হৃদয় স্পন্দিত হতে থাকে তালে তালে, সেই তালের আত্মীয়তা নক্ষত্র চন্দ্রের ঘূর্ণমান গতির সঙ্গে, মাটি ভেদ করে বীজের অঙ্কুরিত হওয়ার সঙ্গে, যে গতিতে সমুদ্রের বঙ্কিম বক্ষ নিশ্বাস প্রশ্বাস ফেলে তার সঙ্গে। ... আমাদের জীবন এত উত্তেজিত, এত কোলাহলমুখর যে বসন্ত শেষের মরুদ্যানের মতো শান্ত ও স্নিগ্ধ, এই আত্মার কাছাকাছি যেতে লজ্জা হয়।’
শরৎকালের শেষভাগে আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। সেজন্যই হয়ত একটি বিশেষ গন্ধ পেয়েছি। সন্ধ্যাবেলায় প্রৌঢ় ধানক্ষেতের সান্নিধ্যে- তপ্ত কোমল উদ্ভিজ্জ সুবাস, শান্তিনিকেতনের এক-একটি স্থানের সঙ্গে এক একটি গন্ধের স্মৃতি জড়িত। ছাতিমতলায় ছাতিমফুলের উগ্রমদির গন্ধ, উত্তরায়ণের পথে হেনা আর রজনীগন্ধার তরল সুরভি; নতুন বাড়িতে ঝুমকো ফুলের সুবাস- এই সব বিচিত্র গন্ধ একদল অদৃশ্য কুস্তূরীমৃগের মতো কোন সর্বনাশের মুখে উধাও হয়ে ফুটতে থাকে।
শান্তিনিকেতনের সবই দেখলাম, কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। মাত্র চারদিনের কয়েকঘন্টা। এ বিশাল দিগন্ত প্রসারী আশ্রম রাজ্যে নিতান্ত ক্ষণিকের আবেগ আর উন্মাদনায় কতটুকু বা গ্রহণ করা যায়। গ্রন্থাগারের বইগুলো স্পর্শ করেছি, রবীন্দ্রভবনের দুর্লভ রত্নগুলো চোখের কোণে আবদ্ধ করেছি, উত্তরায়ণের বাড়িগুলো দেখে জন্মান্তরবাদে বিশ্বস্ত হতে চেয়েছি, শ্রীনিকেতন ঘুরে ঘুরে অক্লান্ত থেকেছি-অস্পষ্টভাবে আর্তনাদে স্বগোক্তি করেছি- আবার আসব। পরক্ষণেই-কখন? পিছনে তাকিয়ে দেখলাম এতদিনকার চলার ব্যর্থতা, অপূর্ণতাকে সামনের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখলাম না, এমন কী নিজেকেও না।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে চাই, শুনেছি বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই কলকাতার বিত্তশালী বিলাসী ব্যক্তিবর্গ শান্তিনিকেতনের আশেপাশে জমি কিনে অনেক সুরম্য বাংলো টাইপের দালান নির্মাণ করে রেখেছেন, ধারাবাহিকভাবে কেউ থাকেন না। বিনোদনের জন্য মাঝে মাঝে আসেন, আনন্দ ফূর্তি করে সময় কাটিয়ে আবার কলকাতার কোলাহলে চলে যান। এতে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য, গাম্ভীর্য এবং রাবীন্দ্রিক আদর্শ কতটুকু যাপিত হচ্ছে- এখানে প্রশ্ন জেগে ওঠে। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল টাকা প্রতি বৎসর বরাদ্দ করলেও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কারণে সব টাকা খরচও করা যায় না। কারণ সর্বত্রই একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সাইনবোর্ড লিখা রয়েছে- ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম, ঐতিহ্যের প্রাঙ্গণ’। সেজন্যই দু’তলার উচ্চ দালান নেই, আঙ্গিক, সৌষ্ঠবের মধ্যে রাবীন্দ্রিক আদল ও নান্দনিক ছাপ। এমন কী রং এর ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধ রয়েছে। এছাড়া এখানকার বাড়ির নামকরণেও রবীন্দ্র-ব্যবহৃত শব্দের বাহুল্য। আবাসিক এলাকার নাম ‘সোনারতরী’। এ নামে ৪টি পাশাপাশি এলাকায় শতাধিক দৃষ্টিনন্দন পাকা বাংলো এবং আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ। তবে এগুলো শান্তিনিকেতনের বাইরে অবস্থিত, ব্যক্তিগত।
আমার জীবনে প্রথম কলকাতা যাওয়া মাত্র ২১ দিনের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিহার অর্থাৎ গয়াধামে গিয়েছি। এছাড়া তিনদিন বাদ দিলে ১৮ দিন এখানেই ছিলাম। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছে গিয়েছি অনেকটা দায়বদ্ধতায়, অনেকটা প্রাণের টানে। তাঁদের আদর আপ্যায়ন ছিল আন্তরিক। এ মিলনপর্ব ছিল স্মৃতিবিজরিত ও আবেগঘন, সেজন্য বাসে-ট্রেনে-যাতায়াত করেছি বিরামহীন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় এবং এখনও বর্ষাকালে প্রবল জলস্রোত দেখে দেখে অভ্যস্ত, জনস্রোত হতে পারে- তা আমার জানা ছিল না। ট্রেনে-বাসে তিল ধরনের স্থান নেই- এরই মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাস খেলা, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক, অন্ধভিক্ষুকদের প্রাণমাতানো গান-বিশ্বাস করতেও মন সায় দেয় না, যদি চোখে না দেখতাম। পশ্চিমবঙ্গ বৃহৎ বাংলাদেশেরই একটি অংশ, মাতৃভাষা বাংলা। সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতির কথা শুনেছি, সেখানকার সাহিত্য সম্ভার তো আমার বাংলাদেশে সয়লাপ হয়ে আছে, অথচ চলতে গিয়ে তাদের মুখের ভাষায় বাংলা হোঁচট খাচ্ছে, তাদের জাতীয় ভাষা হিন্দী যেন গ্রাস করছে। হিন্দী লিখতে পারে না হয়ত অনেকেই, সাবলীলভাবে বলছে পরস্পরে, প্রাণ ভরে কীনা জানি না কারণ গভীরে যে মাতৃভাষার বীজ উপ্ত আছে। তাই নিভৃত আলাপচারিতায় ভাষা ব্যবহারে একটি সংকট যেন রয়ে গেছে বলে মনে হলো। বিশ্বজিৎ ঘোষের ভাষায় বলছি, ‘ধর্মান্তরিত হওয়া সহজ, ভাষান্তরিত হওয়া সহজ নয়’। এ দিকটা আমাকে পীড়া দিয়েছে। সেজন্য পারিবারিকভাবে ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনায় ইংরেজিটা এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে, যেন মাতৃভাষাকে হার মানায়। ভেবেছি তাহলে অনাগত দশ বছর পর পশ্চিমবঙ্গবাসী কী বাংলা বলা ভুলে যাবে? এরূপ একটি কষ্ট বেদনা নিয়ে এসেছি। তবে বার বার অনুভব করেছি-আমি বাংলাদেশের লোক, আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ, মাতৃভাষা বাংলা- আমি পশ্চিমবঙ্গের অতিথি মাত্র। আতিথ্যে মন ভরেছে, মাটিতে আকর্ষণ অনুভব মোটেই করিনি। কারণ শিকড়ের টান যে প্রাণের সাথে মাটির, একেবারে নাড়ির।

তথ্যসূত্র-
১. শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন পরিচয় - কমলাপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়
২. উত্তরায়ণ-রবীন্দ্রভবন-সুপ্রিয়া রায়
৩. রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন - প্রমথনাথ বিশী।
৪. পিণ্ডক্ষেত্র পুণ্যধাম গয়া-সুমন গুপ্ত
[শারদীয়া বর্তমান-১৪২৩]

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
 মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫