
মোস্তফা হোসেইন ।।
একাত্তরের মার্চ মাসের ২৮ কিংবা ২৯ তারিখের ঘটনা। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার চরানল গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহান গিয়েছেন মুরাদনগরে বিয়ের দাওয়াতে। এর মধ্যেই শুনতে পান, পাকিস্তানীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে আসছে। পথে পথে তারা সাধারণ মানুষকে গুলি করে মারছেও।
মোহাম্মদ শাহজাহান বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। উদ্দেশ্য যে কোনো উপায়েই হোক বাড়ি চলে যাবেন। কিন্তু ২৫/৩০ মাইলের পথ। মুরাদনগর থেকে কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত রিক্সা পেয়ে যান। শুধু তাই নয় সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান বুড়িচং থানার চ-িপুর গ্রামের মোহাম্মদ আয়াত আলী ভূইয়াকে। দু’জন মিলে কোম্পানীগঞ্জ পৌঁছে দেখেন রাস্তায় মানুষ ছুটছে। ধাওয়া করছে পাকিস্তানীদের। জানতে পারেন, পাকিস্তানী বাহিনীর কিছু সৈনিক সামান্য দক্ষিণে হেঁটে যাচ্ছে। দা, কুড়াল, বল্লম জাতীয় দেশীয় অস্ত্র হাতে মানুষগুলো যেন ক্ষেপা বাঘ। সামনে পেলে টুকরো টুকরো করে ফেলবে পাকিস্তানীদের। এমন অবস্থায় কিশোর শাহজাহান ও আয়াত আলীও বসে থাকতে পারলেন না। যোগ দিলেন মানুষের মিছিলে। একবারও চিন্তা করলেন না তারা কোথায় যাচ্ছেন। আর তাদের পরিণতিও বা কী হতে পারে।
শুনতে পান পাকিস্তানীরা মিরপুর ও কয়েক জায়গায় গুলি করে মানুষ মেরে এসেছে। রক্ত টগবগ করে ওঠে শাহজাহানের। এগিয়ে যেতে থাকেন মিছিলের সঙ্গে। দেবিদ্বার থানার কাছে যাওয়ার পর সঙ্গী আয়াত আলী বলেন, থানায় যেতে হবে। বুঝতে পারছিলেন না শাহজাহান। থানার সামনে তখন অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে। আয়াত আলী ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে বলেন, হয়তো আপনারা এগিয়ে আসুন। না হয় অস্ত্র দিন। আমরাই পারবো ওদের রুখতে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, এভাবে কাউকে অস্ত্র দেওয়ার বিধান নেই। মানুষ তখন প্রচ- ক্ষেপে যায় পুলিশ কর্মকর্তার ওপর। নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চান, এখানে অস্ত্র চালাতে পারে এমন কেউ থাকলে তিনি অস্ত্র দেবেন। আয়াত আলী বলেন, তিনি অস্ত্র চালাতে জানেন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা পুলিশকে চাপ দিচ্ছিলেন বন্দুক দেওয়ার জন্য। আয়াত আলী অস্ত্র চালাতে জানেন একথা শোনার পর তারা অস্ত্র ছিনিয়ে নেবেন বলে হুমকি দেন পুলিশকে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র যুবকদের হাতে থানার অস্ত্রগুলো চলে যায়।
রাস্তা তখন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। মানুষ এর আগেই রাস্তা কেটে, রাস্তায় গাছ ফেলে অস্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এটা করেছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী। রাস্তাঘাট চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে একরাতেই ।
যুবকেরা মুহুর্মূহু স্লোগান দিচ্ছে- জয় বাংলা। আয়াত আলী আর শাহজাহান জোর কদম চালান পাকিস্তানিদের কাছাকাছি হতে। দ্রুত চলে আসেন মিছিলের সামনের দিকে। আর মাত্র একশ গজ দূরে পাকিস্তানি সৈন্যরা। মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছে।
দেবিদ্বার থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে কুড়েরপাড় নামক একটি গ্রামে এসে দেখেন, একজন কৃষক দিব্যি গরু দিয়ে জমি চাষ করছেন। ভাবলেন, এমন অবস্থায়ও কিভাবে ভদ্রলোক রাস্তার পাশেই জমি চাষ করতে পারেন। পাকিস্তানীরা কিছু করল না ওই কৃষককে। কিন্তু ওই কৃষকের একবারে কাছাকাছি হওয়ার পর দেখা গেলো তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছেন। হালের বলদগুলোকে দাঁড় করিয়ে দৌড়ে গেলেন রাস্তায়। পাকিস্তানীদের কয়েক ফুট দূরে। হাতে তার হাল চালানোর জন্য চিকন একটি লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে কৃষকটি এলোপাতারি পিটানো শুরু করেন পাকিস্তানী এক সৈন্যকে। কিন্তু এমন লাঠি দিয়ে কি আর কাউকে হত্যা করা যায়? কেউ মারা গেল না, কৃষকের লাঠিপেটা খেয়ে। পাকিস্তানী একজন সৈন্য কোমর থেকে বের করে আনে পিস্তল। একটি গুলি খরচ করে ঘাতক। সেখানেই ঢলে পড়েন কৃষক আব্দুল মজিদ।
দৌড়াচ্ছে মানুষ দৌড়াচ্ছে পাকিস্তানী সৈন্যরাও। কিছু দূর যেতেই দেখা গেল মধ্যবয়সী এক লোক লাকড়ি নিয়ে তেড়ে যাচ্ছে সৈন্যদের দিকে। আয়াত আলী দূর থেকে চিৎকার করলেন তাকে কাছে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই লোক কথা শুনছেন না। কাছাকাছি গিয়ে লাকড়ি দিয়ে আঘাত করেন সেই ব্যক্তি। একটি কি দুটি আঘাত একজন সৈন্যের গায়ে লাগে। ওমনি তাকেও গুলি করে পাকিস্তানী এক সৈন্য। শহীদের তালিকায় আরেকটি নাম যুক্ত হলো। তাঁর নাম মোহাম্মদ সৈয়দ আলী। গ্রামের ঠিকানা মনে নেই মোহাম্মদ শাহজাহানের।
সৈন্যরা যখন দেখে সামনেও তারা এগিয়ে যেতে পারছে না তখন তারা এক পর্যায়ে হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় আলেয়াবাদ এর কাছে একটা মসজিদের দিকে। গোমতী নদীর কাছেই মসজিদটি। মাইল দেড়েক দূরে জাফরগঞ্জ বাজার। ওরা নিরুপায় হয়ে ঢুকে পড়ে মসজিদের ভিতর। রাস্তার একবারে পাশেই মসজিদটি। মোহাম্মদ শাহজাহান ও আয়াত আলী ভূইয়া মসজিদের পাশে চলে যান। দেখতে পান মসজিদের উত্তর দিকের খোলা জানালায় তাক করা আছে পাকিস্তানী বাহিনীর রাইফেল। কিন্তু মানুষকে থামানো যাচ্ছে না। যেতে চাইছে মসজিদের আরো কাছে। মাইকের ঘোষণায়ও কাজ হচেছ না। এর মধ্যে দুয়েকটি গুলিও করছে মসজিদ থেকে। মোহাম্মদ শাহজাহান ও আয়াত আলী তখন জানালা বরাবর। তারা নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার জন্য উত্তর দিকে নদীর আইলের দিকে দৌড় দেন। ঠিক ওই সময় একটা গুলি এসে লাগে আয়াত আলীর গায়। তিনি সেখানেই লুটিয়ে পড়েন। আরেকটি নাম যুক্ত হলো শহীদের তালিকায়। আয়াত আলী মরদেহ সরিয়ে নিতে নিতেই জানতে পারেন আরো কয়েকজন সেখানে শহীদ হয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই সাধারণ মানুষ। দা, কুড়াল নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধা। তারপর চলে আরেক যুদ্ধ। বাঙালির অভিনব কৌশলের কাছে হার মানতে হয় পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্যদের।
লেখক- সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।