
বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মানুষের আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীকে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়।
কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। চাহিদা সামনে রেখে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনেছেন- এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করেন। ব্যবসায়ীর কারসাজিতে বাধ্য হয়েই ভোক্তাকে এসব পণ্য কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অক্টোবর ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৯.৯৩ বা প্রায় ১০ শতাংশ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। স্বাভাবিকভাবেই বাজারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সব সময় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বলা হয়ে থাকে। গত কয়েক বছর যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু অজুহাত। প্রথমে করোনা, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
অতি সাম্প্রতিক অজুহাত হচ্ছে বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলার সংকট। সেটি তো হতেই পারে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানীকৃত পণ্যের দাম বাড়তে পারে। কিন্তু ডলারের সংশ্লিষ্টতা নেই এমন পণ্যের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে কেন? উদাহরণ হিসেবে দেশে উৎপাদিত চার পণ্য- দেশি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, আলু ও মোটা চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এই চার পণ্যের দাম তিন বছরের ব্যবধানে ২০ থেকে ২২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
দেশের কৃষি উৎপাদন গ্রামনির্ভর। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হয়, প্রাথমিক কৃষিপণ্যগুলোর বিক্রয়মূল্য শহরের তুলনায় গ্রামে কম হবে, কিন্তু বাস্তবতা একেবারে উল্টো। যেমন- অক্টোবরে শহরাঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.১১ শতাংশ হলেও গ্রামাঞ্চলে ছিল ১২.৫৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে শহরাঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.০১-এর বিপরীতে গ্রামাঞ্চলে ছিল ১২.৫১ শতাংশ।
বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয় এমন কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে মজুদদারদের কারসাজি আছে। আলুর মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বাজারে আলুর উচ্চমূল্যের পেছনে হিমাগার মালিকদের কারসাজি রয়েছে। বেশি মুনাফার আশায় এজেন্টের মাধ্যমে কৌশলে আলুর দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটছেন তাঁরা। এতে পাইকারি ও খুচরা বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির জন্য চাহিদা ও সরবরাহ দুটি কারণই দায়ী। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আমদানি ঠিক রেখে সাপ্লাই চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের, বিশেষ করে কৃষিপণ্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন, মজুদ এবং নিরাপদ ও অবাধ পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে।