
১ লাখ ৩০ হাজার দর্শকের গর্জন
তো শোনা গেল দিনজুড়ে কতবারই। তবে একসঙ্গে এই লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাস কেমন
হয়, নীরবতার ভাষা কেমন আর হাহাকারের শব্দ, শেষ পর্যন্ত সবকিছুরই স্বাক্ষী
হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের
নীল উচ্ছ্বাস থামিয়ে, ভারতজুড়ে উৎসবের আবহকে ম্লান করে ফাইনালের মহামঞ্চে
উড়ল হলুদ জার্সির বিজয় কেতন। দুর্দান্ত বোলিং-ফিল্ডিংয়ের পর ট্রাভিস হেডের
স্মরণীয় সেঞ্চুরিতে ওয়ানডের শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে পেল অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়ার
চেনা পেশাদারিত্বে পিষ্ট হলো ভারতের তৃতীয় শিরোপার স্বপ্ন। ফাইনালে ৭
উইকেটের জয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দল জিতে নিল তাদের ষষ্ঠ শিরোপা।
টুর্নামেন্টের
একমাত্র অপরাজিত দল হয়ে ফাইনালে আসা ভারত, টানা ১০ জয়ের পথে যাদেরকে মনে
হচ্ছিল অপ্রতিরোধ্য, কোনো প্রতিপক্ষকেই যারা সেভাবে পাত্তা দেয়নি, সেই দলই
ফাইনালে উড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার কাছে।
সেই অস্ট্রেলিয়া, বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচ হারার পর যাদেরকে মনে হয়েছিল ছন্নছাড়া। সেই দলটিই টানা ৯ জয়ে এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
বিশ্ব ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার শ্রেষ্ঠত্বও তাতে প্রতিষ্ঠিত হলো আরেকবার। গত জুনে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাও জিতেছিল তারা।
টেস্টের
সেই ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ১৭৪ বলে ১৬৩ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা
হয়েছিলেন ট্রাভিস হেড। এবার ওয়ানডের বিশ্বমঞ্চেও তিনিই নায়ক। শুরুতে রোহিত
শার্মার অসাধারণ এক ক্যাচ নিয়ে ম্যাচের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি।
ধারাভাষ্যকার ইয়ান স্মিথ তখনই বলেছিলেন, ‘এটিই হতে পারে ম্যাচের টার্নিং
পয়েন্ট।’ তবে কাজ বাকি ছিল এরপরও। সেটুকুও তিনি করেছেন। গ্যালারি ঠাসা
দর্শকের সামনে প্রবল চাপের মধ্যে খেলেছেন ১২০ বলে ১৩৭ রানের ম্যাচ জেতানো
ইনিংস।
অথচ চোটের কারণে এই বিশ্বকাপ নাও খেলতে পারতেন তিনি। হাত ভাঙার
পরও তাকে দলে রেখেছিল অস্ট্রেলিয়া। প্রথম পাঁচ ম্যাচ তিনি খেলতেই পারেননি।
পরে ফিরে প্রথম ম্যাচেই করেন ঝড়ো সেঞ্চুরি। সেমি-ফাইনালে দুর্দান্ত
অলরাউন্ড পারফরমান্সে ম্যাচের সেরা ছিলেন তিনিই। এবার ফাইনালেও সেরা। কী
বলা যায় একে, হেড-রূপকথা!
ম্যাচ জেতানো জুটিতে হেডের সঙ্গী যিনি, সেই
মার্নাস লাবুশেন তো শুরুতে বিশ্বকাপ দলেই ছিলেন না। অ্যাশটন অ্যাগারের চোটে
তার জায়গা হয় বিশ্বকাপে। ফাইনালে তিনিই দলের জয়ে রাখলেন বড় অবদান।
আলাদা
করে বলতে হবে প্যাট কামিন্সের কথাও। উইকেট ও কন্ডিমন নিখুঁতভাবে বুঝে টস
জিতে আগে বোলিং নেওয়া, নিজে দুর্দান্ত বোলিং করার পাশাপাশি বোলিং পরিবর্তন,
মাঠ সাজানো, সবকিছুই ছিল প্রায় নিখুঁত। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপজয়ী অধিনায়ক
এখন ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কও। ফাস্ট বোলাররা ভালো অধিনায়ক হন না, এই
ধারণাকে এখন তিনি ভুল বলতেই পারেন!
উইকেট শুরুতে মন্থর হবে, রাতের
শিশিরে ব্যাটিং সহজ হবে, এই ভাবনা থেকেই শুরুতে বোলিং নিয়েছিলেন কামিন্স।
দারুণ বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে তারা ভারতকে আটকে রাখেন ২৪০ রানে। রান তাড়ায় তারা
ম্যাচ শেষ করে ৪২ বল বাকি রেখেই।
অস্ট্রেলিয়ার রান তাড়ার শুরুটা হয়
নাটকীয়। ইনিংসের প্রথম বলে জাসপ্রিত বুমরাহর দুর্দান্ত সুইঙ্গিং ডেলিভারি
ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে যায় স্লিপে। কিন্তু ভিরাট কোহলি ও
শুবমান গিল তাকিয়ে দেখেন, দুজনের মধ্য দিয়ে ব্যাট চলে যায় বাউন্ডারিতে।
পরের বলে আসে তিন রান। ওই ওভারেই দুটি চার আসে হেডের ড্রাইভে।
পরের
ওভারেই শামির বলে স্লিপি ক্যাচ দেন ওয়ার্নার। মিচেল মার্শ উইকেটে গিয়ে একটি
করে চার ও ছক্কা মেরেই বিদায় নেন। টিকতে পারেননি স্টিভেন স্মিথও। রিভিউ
নিলে তিনি বেঁচে যেতেন। কিন্তু তিনি যখন ফিরে যান, ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে
অস্ট্রেলিয়া তখন বিপদে।
হেডও তখন খোলসে ঢুকে যান। শামি-বুমরাহদের সুইং
বোলিংয়ের সামনে বেশ নড়বড়ে মনে হচ্ছিল তাকে। তবে ঠা-া মাথায় তিনি কাটিয়ে দেন
সময়টুকু। তাকে সঙ্গ দেন মার্নাস লাবুশেন। আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে জুটি।
ভারতীয়
স্পিনারদেরও তারা সামাল দেন দারুণভাবে। ক্রমে বাড়তে থাকে রানের গতি।
শিশিরের প্রভাব পড়ার তো আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হেড খেলতে থাকেন একের
পর পর শট। জুটি ভাঙতে যখন দ্বিতীয় স্পেলে আনা হয় পেসারদের, সবাইকেই তিনি
প্রথম বলে চার মেরে চাপে ফেলে দেন। সেই চাপ থেকে ভারত বের হতে পারেনি।
এই
জুটিই অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে যায় জয়ের দুয়ারে। জয় যখন স্রেফ এক শটের ব্যাপার,
তখন সীমানায় ক্যাচ দিয়ে ফেরেন হেড। ১৫ চার ও ৪ ছক্কার ইনিংস খেলে মাঠ
ছাড়েন তিনি মাথা উঁচু করে। একটু পরই ধরা দেয় জয়। এক প্রান্ত আগলে রেখে ১১০
বলে ৫৮ রানের মহামূল্য অপরাজিত ইনিংস খেলেন লাবুশেন। ম্যাচের শুরুর সময়টাও
ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। টস হেরে আগে ব্যাটিং পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন রোহিত। তার
চাওয়া ছিল আগে ব্যাটিং করাই।
ম্যাচের প্রথম বলটিই ছোবল দেয় রোহিতের
পায়ে। তবে মিচেল স্টার্কের বলটি একটু বেশি সুইং করায় রক্ষা পান ভারতীয়
অধিনায়ক। এরপর তিনি চড়াও হন জশ হেইজেলউডের ওপর। এই পেসারের দুই ওভারে তিনটি
চার একটি ছক্কা মারেন রোহিত।
সেমি-ফাইনালে ৮ ওভারে ১২ রান দিয়েছিলেন হেইজেলউড, ফাইনালে তার ২ ওভার থেকেই আসে ২২।
এর ফাঁকে শুবমান গিলকে ফিরিয়ে দেন স্টার্ক। তবে তার ওই ওভারেই বল গ্যালারিতে পাঠিয়ে রোহিত জানিয়ে দেন, তিনি খেলার ধরন পাল্টাবেন না।
রোহিতকে
থামাতে একটি ‘জুয়া’ খেলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক কামিন্স। পাওয়ার প্লের
মধ্যে দুই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের সামনে বোলিংয়ে আনেন অফ স্পিনার
ম্যাক্সওয়েলকে। অনুমিতভাবেই তাকে পাওয়া বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন রোহিত।
তবে টানা দুই বলে ছক্কা ও চার মারার পর আরেকটি ছক্কার চেষ্টায় ভুল করে
ফেলেন। অনেকটা পেছনে দৌড়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়ে ট্রাভিস হেড ফেরান রোহিতকে।
বাজি জিতে উল্লাসে ফেটে পড়েন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক।
সেমি-ফাইনালে ২৯
বলে ৪৭ করেছিলেন রোহিত, ফাইনালে ৩১ বলে ৪৭। আসর শেষ করলেন তিনি দ্বিতীয়
সর্বোচ্চ ৫৯৭ রান নিয়ে, স্ট্রাইক রেট প্রায় ১২৬!
অধিনায়ককে হারানোর পর
কামিন্সের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে শ্রেয়াস আইয়ারকেও হারায় ভারত।
ওভারপ্রতি রান তখন আট, কিন্তু উইকেট নেই তিনটি।
উইকেটে যাওয়ার পরপরই
স্টার্কের এক ওভারে তিন চার মারা ভিরাট কোহলিও এরপর সতর্ক হয়ে যান। জুটি
গড়ার জন্য লোকেশ রাহুল বেছে নেন অতি সাবধানী ব্যাটিং। অস্ট্রেলিয়ান
বোলাররাও চেপে ধরেন তাদের। একটু একটু করে দলকে এগিয়ে নেন দুজন। এই সময় টানা
১৬ ওভারে আসেনি কোনো বাউন্ডারি!
কোহলি এর মধ্যেও ফিফটিতে পৌঁছে যান
৫৬ বলে। চলতি আসরে ১১ ইনিংসে তার নবম ফিফটি ছোঁয়া ইনিংস! প্রথম ভারতীয়
ব্যাটসম্যান হিসেবে পঞ্চাশ ছুঁলেন তিনি সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে।
ভিত
শক্ত হওয়ার পর যখন রানের গতি বাড়ানোর পালা, তখনই লাখো দর্শকের নিশ্চুপ হয়ে
যাওয়ার মুহূর্ত। শর্ট অব লেংথ থেকে একটি ডেলিভারি লাফিয়ে তোলেন কামিন্স,
সেটিতেই আলগা করে ব্যাট পেতে দিয়ে বল স্টাম্পে তুলে আনেন কোহলি।
এরপর
আবার ১২ ওভারের বাউন্ডারি খরা। এর মধ্যেই রবীন্দ্র জাদেজাকে ফেরান
হেইজেলউড। লোকেশ রাহুল একপ্রান্ত আগলে রেখে ফিফটি করেন বটে, তবে বল লেগে
যায় ৮৬টি।
রাহুলের দিকে দল তাকিয়ে ছিল শেষ দিকে দ্রুত রানের জন্য। সেই
দাবি তিনি মেটাতে পারেননি। বলা ভালো, মেটাতে দেননি স্টার্ক। রাউন্ড দা
উইকেটে করা তার অসাধারণ ডেলিভারির জবাব পাননি ১৩৩ মিনিট উইকেটে কাটানো
রাহুল। তার ৬৬ রানের ইনিংস আসে ১০৭ বলে।
এরপর ভারতের আশা হয়ে টিকে
ছিলেন কেবল সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ। কিন্তু পরিকল্পিত বোলিং করে আর ফিল্ডিং
সাজিয়ে তাকে আটকে রাখে অস্ট্রেলিয়া। শেষ পর্যন্ত তিনি করতে পারেন ২৮ বলে
১৮। শেষ জুটির কিছুটা চেষ্টায় ভারত যেতে পারে ২৪০ পর্যন্ত।
শেষ পর্যন্ত
তা যথেষ্ট হয়নি। ট্রাভিস হেড খেলা শেষ করে আসতে পারলেন না, এই আক্ষেপ তার
থাকতে পারে। তবে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের শটে শেষ হওয়াও মন্দ হলো না।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য সেই ইনিংসের পর ফাইনালে এটুকু সম্মান
তিনি পেতেই পারেন!
ম্যাচ শেষে মাঠে বয়ে যায় বিপরীত অনুভূতির খেলা।
হতাশায় নুইয়ে পড়েন ভারতীয়রা। মোহাম্মদ সিরাজের চোখে দেখা যায় পানি।
অশ্রুষিক্ত দেখা যায় মার্নাস লাবুসেনকেও। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কান্না
বড় সুখের!