
যে
মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে, সে মানুষ বেঁচে থাকতে যেমন শান্তি পায়না,
মৃত্যুর পরও হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে। আর যে অন্যের জন্য বাঁচে অর্থাৎ
¯্রষ্টার সৃষ্টির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে সে অমর হয়ে থাকে। কেননা- গ্রহীতা
নয়, দাতার নামই কালের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণপাড়া
উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু তাহের ভাই-এর
চারিত্রিক দৃঢ়তা, ত্যাগের এক সোনালী দৃষ্টান্ত। ব্যক্তিগতভাবে ঠিকাদার
ব্যবসা করলেও নেশায় ছিল রাজনীতির মাধ্যমে মানব সেবা করা। আমি ২০০১ থেকে
২০১৫ পর্যন্ত শশীদল আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু তাহের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ
পদে এবং ওনি গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালে তাহের ভাইকে
কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে। সেইসব দিনগুলোকে এই লেখার মাধ্যমে
তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
২০০১ খ্রিস্টাব্দে শশীদল আলহাজ্ব
মুহাম্মদ আবু তাহের কলেজ করার জন্য জমি ক্রয় করেন আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু
তাহের ও আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু জাহের এই দুই সহোদর ভাই। এলাকাবাসীর মৌলিক
চাহিদার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আবদুল বারি স্যারের সম্মতিতে কলেজের যাত্রা
শুরু হয়। ওনার সুযোগ্য পরিচালনায় অল্প কয়েক বছরেই এই কলেজ লেখাপড়া,
খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে কুমিল্লা বোর্ডের অন্যতম সেরা কলেজ
হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই কলেজের শিক্ষক নিয়োগে তাহের ভাই দায়িত্ব
দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর মো. হারুনুর রশিদ স্যারকে। বিষয়ভিত্তিক
যে প্রথম হয়েছে তাকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, স্বজনপ্রীতি
ও ডোনেশান বাদ দিয়ে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তাহের ভাই বলতেন, নিয়োগ
প্রক্রিয়ায় যে প্রথম হবে সেই নিয়োগ পাবে এবং বাস্তবে তাই ঘটেছে। তাহের ভাই
জীবিত থাকাকালীন কলেজের অনুসৃত সকল কার্যক্রম চুলছেড়া বিচার বিশ্লেষণ ও
মূল্যায়ন করে পরিচালনা করেছেন। লেখাপড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,
বাৎসরিক মিলাদ ও জাতীয় দিবস উৎযাপন, কলেজের অন্যান্য অনুসৃত কর্মসূচি
বাস্তবায়নে বাজেট অনুমোদনে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও
শাহাদাৎ বার্ষিকী উদযাপনে যে বাজেট উপস্থাপন করা হতো কোনরকম বিচার বিশ্লেষণ
ছাড়াই তিনি অনুমোদন দিয়ে দিতেন আর এটাই ছিল তার বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা
এবং সত্যিকারের ভালোবাসার প্রমাণ। আর এসব ব্যাপারে অর্থনৈতিক যোগান দিতেন
উনার ছোট ভাই বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু জাহের সাহেব।
শশীদল কলেজ ছিল আবু তাহের ভাইয়ের প্রাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উনার কেহ বাড়িতে
মারা গেলে কুমিল্লা বাসা থেকে রওয়ানা হয়ে বাড়ি যাবার আগে কলেজে আসতেন,
তারপর বাড়িতে যেতেন। কলেজের একাডেমিক স্বীকৃতি এবং এমপিওভুক্তিতে অসুস্থ্য
শরীরে অসামান্য পরিশ্রম ও কষ্ট করেছেন। এক্ষেত্রে ওনার ছোট মামা শামসুদ্দিন
সাহেব, গাজীউল হাসান খান, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের অবদান
ছিল অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য, তাহের ভাই যেহেতু চট্টগ্রামস্থ দরবারে বারিয়া
শরিফের মুরিদ, সেহেতু বার্ষিক মিলাদ এমনকি আমি যেদিন ২০০১ সালের অধ্যক্ষ
হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করি সেদিনও বারিয়া দরবার শরিফের পীর সাহেব সৈয়দ
শামসুদ্দোহা বারি সাহেবের দোয়ার মাধ্যমে কলেজের সার্বিক কার্যক্রমের যাত্রা
শুরু হয়।
রাজনীতিবিদ হিসেবে তাহের ভাইকে দেখেছি নির্ভেজাল, বঙ্গবন্ধুর
আদর্শের সৈনিক, নীতির প্রশ্নে আপোষহীন, অকুতোভয় এবং অপ্রিয় সত্য কথা বলার
একজন পারদর্শী ব্যক্তি। কিন্তু শশীদল আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু তাহের কলেজে
তিনি যখন প্রবেশ করতেন তখন রাজনীতিকে কলেজ গেইটের বাহিরে রেখে প্রবেশ
করতেন। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ
বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালীন একাধিকবার কলেজ শিক্ষার্থীদের নবীন বরণ ও অন্যান্য
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে তাহের ভাইয়ের আমন্ত্রনে কলেজে এসেছেন। শুধু
তাই নয়, ব্যারিস্টার শফিক সাহেবের সহধর্মিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক
ডাকসুর ভিপি প্রফেসর মাহফুজা খানম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস
চ্যান্সেলর আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক অতিথি হিসেবে শশীদল আলহাজ্ব মুহাম্মদ
আবু তাহের কলেজে এসেছেন। তিনি রাজনীতিতে ব্রাহ্মণপাড়া-বুড়িচং আওয়ামীলীগের
সুখে-দুখে, দূর্দিনে নেতাকর্মী এবং জনগণের পাশে ছিলেন। উভয় উপজেলায় স্কুল,
কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, ঈদগাহ ও কবরস্থান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন।
নেতাকর্মী ও জনগণের অসুখ-বিসুখে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন। জনগণের সেবা করতে
গিয়ে নিজের শরীরের দিকে নজর দিতে পারেননি, ফলে নিজে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত
হন। পরের উপকার করতে ঢাকা যাওয়ার পথে দূর্ঘটনায় পতিত হন। জনগণের সেবায়
নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উজাড় করে দিয়েছেন। মনেপ্রাণে আওয়ামীলীগ করে ও আদর্শ
সত্য কথা বলার নীতিতে চলতে গিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী,
নেতাকর্মী যারাই অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে সবসময়
তার কণ্ঠ সরব ছিলো। সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা কেউ
দুর্নীতিতে জড়িত আছেন শুনামাত্রই সেখানে তিনি প্রতিবাদ করতে পিছপা হননি।
তাই জীবনের বেশিটা সময়ই ¯্রােতের বিপরীতে অবস্থান নিতে হয়েছে তাঁকে।
রাজনীতির অশান্ত সাগরে তাহের ভাই ছিলেন একজন দক্ষ নাবিক।
তাহের ভাই ৪০
বছর রাজনীতি করে অবশেষে বিপুল ভোটে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ব্রাহ্মণপাড়া
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁর প্রধান নির্বাচনী ওয়াদা ছিল
দুর্নীতিমুক্ত, মাদক মুক্ত এবং ইনসাফের ভিত্তিতে সমাজ কায়েম করা। প্রথমেই
প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে ব্রাহ্মণপাড়ার আটটি
ইউনিয়নে মাদকবিরোধী সমাবেশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। যা অতীতে কখনো
ব্রাহ্মণপাড়াবাসী দেখেনি এবং এই মাদক বিরোধী সমাবেশ সীমান্তবর্তী
উপজেলাগুলোর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তাহের ভাই বিভিন্ন
অনুষ্ঠানে যে আকর্ষণীয়ভাবে বক্তৃতা দিতেন তার আদব-কায়দা শিষ্টাচার দেখে অতি
সাধারণ মানুষও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বক্তৃতা শুনতেন। তাহের ভাইয়ের একটি
অসাধারণ গুণ ছিল বই পড়া। ধর্মীয়, রাজনীতিক ব্যক্তিবর্গের জীবনী, এমনকি
বিশ্বের বরেণ্য কবি সাহিত্যিকদের বই পড়তেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু বই
উনাকে উপহার দিয়েছি। উনি হাসিমুখে তা গ্রহণ করে পড়েছেন এবং পরবর্তীকালে
আমার সাথে ওই বইগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। তাহের ভাই এর বাসায় একটি মিনি
লাইব্রেরী আছে। আমরা প্রয়োজনে বা অবসর সময়ে যেতাম এবং ঘন্টার পর ঘন্টা
বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলতো। বিভিন্ন বিষয়ের উপর ওনার দক্ষতা ও জ্ঞান দেখে
আমরা সবাই প্রায়ই মুগ্ধ হতাম। ওনার আরেকটা অন্যতম সেরা গুণ ছিল অতিথি
পরায়ণতা, ওনি উনার বাসার মেহমানদেরকে খুব চমৎকারভাবে আপ্যায়ন করাতেন। রমজান
মাসে কলেজে ও বিভিন্ন স্থানে ইফতার মাহফিলের যে আয়োজন হতো আমার একাধিক
অনুষ্ঠানে তাহের ভাইয়ের সাথে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যা এখনো জীবন্ত বলে মনে
হয়। তাহের ভাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কুরআন ও হাদিসের আলোকে চমৎকার বক্তব্য
রাখতেন। “মানবতার সেবা করা হলো শ্রেষ্ঠ ইবাদত” এই বাক্যটি তিনি বিশ্বাস
করতেন এবং নিজের মনের মধ্যে ধারণ করতেন।
তিনি ছিলেন একজন দানবীর।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেহিসেবে দান করেছেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকেও মুক্ত
হস্তে দান করেছেন যা তিনি কখনোই তার হিসাব রাখেননি। দোষে-গুণেই মানুষ
সমৃদ্ধ এবং তাহাই মানবিক। একজন মানুষ দীর্ঘদিন সবাইকে খুশি রাখতে পারে না,
তাহের ভাইও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। অপ্রিয় সত্য কথা বলার কারনে কিছু কিছু
লোক হয়তোবা তাহের ভাইয়ের বিরাগভাজন ছিল। কিন্তু তাহের ভাই মারা যাওয়ার পর
তাদের অনেকেই তাহের ভাইয়ের জানাযার নামাজের পূর্বে ওনার ভূয়সী প্রশংসা করে
বক্তব্য দিতে দেখা গিয়েছে। আমি মনে করি, সব মানুষই তার কর্মের সন্তান।
তাহের ভাই তার কর্ম ও আদর্শের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরদিন। দেহনশ্বর হলেও
আত্মা অবিনশ্বর। তাহের ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে ওনার ছোট ভাই
আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু জাহের ভাই নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জীবনের
অপর নাম সংগ্রাম। জীবন সংগ্রামে জয় অথবা পরাজয় দুইয়েরই সম্ভাবনা আছে। কোন
জয় সংগ্রাম ছাড়া আসে না। তাহের ভাই জানতেন বাবৎু ংঁপপবংংভঁষ ংঃড়ৎু রং ধ
ংঃড়ৎু ড়ভ মৎবধঃ ভধরষঁৎব অর্থাৎ বড় সাফল্যের পিছনে আছে বড় ব্যর্থতার
কাহিনী। তিনি আরো জানতেন, পরাজয় মানেই সমাপ্তি নয়, যাত্রা একটু বিলম্ব হওয়া
মাত্র। তাইতো প্রথমবার নমিনেশন পেপার আইনি জটিলতায় বাতিল হলেও দ্বিতীয় বার
নির্বাচনে সুষ্ঠু কারচুপির জন্য সফল না হতে পারলেও হাল ছাড়েননি। তৃতীয়বার
বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়ে দেড় বছর সেবা করে দৃষ্টান্ত
স্থাপন রেখে গেছেন। জন্মের সম্প্রসারণের নামই মৃত্যু। তাহের ভাইয়ের মৃত্যুর
পর ব্রাহ্মণপাড়া কলেজ মাঠে জানাজার নামাজে হাজার হাজার মানুষের ঢল প্রমাণ
করে ওনার মৃত্যু যেন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় একটি বিশাল শুন্যতা সৃষ্টি
করেছে। তাহের ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা হারালাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং
পরীক্ষিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিককে। ব্রাহ্মণপাড়াবাসী হারালো একজন
দেশপ্রেমিক দানবীরকে।
সর্বশেষে তাহের ভাইয়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে
সৃষ্টিকর্তার নিকট আমি কায়োমনো বাক্যে প্রার্থনা করছি, তাহের ভাই যতগুলো
ভালো কাজ করে গেছেন তা যেন সদকায়ে জারিয়া হিসাবে মহান সৃষ্টিকর্তা কবুল
করেন এবং ওনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন-আমীন।
লেখক: অধ্যক্ষ, মাধবপুর আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু জাহের ফাউন্ডেশন কলেজ, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা।
মোবাইল ঃ ০১৭১৮-৩০১০৬০