
রেকর্ড
দ্রব্যমূল্যের বোঝা মাথায় নিয়ে শুরু হচ্ছে এবারের রমজান মাস। তেল, চিনিসহ
নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। ব্রয়লারসহ সব ধরনের মাংসের
দাম অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে। পণ্যের দাম নিয়ে অস্বস্তিতে সাধারণ
মানুষ। তারা বলছেন, এবার হতে চলেছে দেশের সর্বকালের খরুচে রমজান।
আন্তর্জাতিক
বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী রমজানে পণ্যের দাম কমে।
ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। সাধারণত রমজান এলেই এদেশে বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম।
কয়েক বছর ধরে চালু হয়েছে নতুন প্রবণতা। ঠিক রমজানের কাছাকাছি সময়ে নয়,
দু-এক মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখেন ব্যবসায়ীরা। যাতে নতুন করে রমজানের
সময় খুব বেশি বাড়াতে না হয় কিংবা বাড়ানোটা চোখে না পড়ে।
চলতি বছরও
এক-দেড় মাস ধরে রোজায় বেশি ব্যবহৃত পণ্য খেজুর, ছোলা, ডাল, চিনি ও সয়াবিন
তেলের দাম বাড়তি। একই সঙ্গে বেড়েছে মাছ, মাংস, ডিম, বিভিন্ন ধরনের ফল ও
ইফতারের অন্য উপকরণের দামও।
বাজার তথ্য বলছে, এখন খোলা চিনির দাম
১১৫-১২০ টাকা কেজি ছুঁয়েছে, যা গত বছরের রমজানে ছিল ৮০ টাকার মধ্যে।
অর্থাৎ, চিনির ক্ষেত্রে ভোক্তার খরচ বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। যদিও সরকার নির্ধারিত
চিনির দাম ১০৭ টাকা, কিন্তু এ দামে ক্রেতারা কিনতে পারছেন না কোথাও।
একই
অবস্থা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রেও। খোলা সয়াবিন ১৬৭-১৭২ টাকা লিটার দরে
বিক্রি হচ্ছে, যা গত রমজানে ১৪০ টাকার কমে পাওয়া যেত। বোতলজাত সয়াবিনের দাম
প্রায় একই সময়ের ব্যবধানে ২০ টাকা বেড়ে এখন ১৮৫ থেকে ১৮৭ টাকায় কিনতে
হচ্ছে। অর্থাৎ, দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি।
আবার বাজারে ইরাকের জাহেদি
খেজুর (বাংলা খেজুর) ছাড়া ভালো মানের কোনো খেজুর ৪শ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে
না। আমিরাতের নাগাল, দাবাস ও লুলু খেজুরের দাম ৬শ টাকা ছাড়িয়েছে। আর সৌদি
আরবের আজওয়া, আম্বার কিংবা জর্ডানের মরিয়ম খেজুর কিনতে হলে গুনতে হবে হাজার
টাকার বেশি। কেজিতে এগুলো যে পরিমাণে ধরে তাতে একটি খেজুরের দাম পড়ে ৮-১৬
টাকা পর্যন্ত।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি বলছে,
গত বছরের চেয়ে চলতি বছর খেজুরের দাম ২০ শতাংশ বেশি। বর্তমানে বাজারে ১৫০
থেকে ৪৫০ টাকা দরে খেজুর পাওয়া যাচ্ছে, যা গত বছর ১০০ টাকা পর্যন্ত কম ছিল।
যদিও বাজারে এখন টিসিবির দামে খেজুর পাওয়া যায় না।
বাজারে ছোলা ও
অ্যাংকর ডাল কিনতে গুনতে হচ্ছে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৩৩ ও ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ
বেশি। এ দুই পণ্যের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। বেড়েছে
সব ধরনের আমদানি ফলের দামও। বাজারে মানভেদে আপেলের দাম ২৫০-৩২০ টাকা, গত
বছর ছিল ১৫০-২৩০ টাকা। বিভিন্ন ধরনের মাল্টা ও কমলা মিলছে ২০০-৩০০ টাকায়,
গত বছর যা ছিল ১৪০-২২০ টাকার মধ্যে।
অন্যদিকে সোমবার (২০ মার্চ) প্রতি
কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। এখন ব্রয়লার মুরগির দাম সর্বকালের
সর্বোচ্চ। রমজান শুরুর কারণে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম
বাড়তে বাড়তে এখন প্রতি কেজি প্রায় স্বাভাবিক দামের চেয়ে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা
বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল
১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। এখন ২৮০-২৯০ টাকা।
টিসিবির তথ্য, বর্তমান ব্রয়লারের দাম আগের বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। যদিও সোমবারের বাড়তি দাম এখনো টিসিবির হিসাবে আসেনি।
এদিকে
চিনি, তেল ও মুরগির মাংসের মতো গরুর মাংস, খাসির মাংস, মাছ, ডিম, খেসারি
ডাল, সুগন্ধি চাল, অধিকাংশ শাক-সবজি, আদা-রসুনসহ অন্য মসলা, ফলমূলের দামও
গত কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে।
এসব বিষয়ে আবুল
কালাম নামে একজন কলেজ শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, সরকার রমজানের আগে নানা
প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতো আমরা কোনো সুফল পাইনি। এখন প্রায়
সব পণ্যের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এ বিষয়ে সব তদারকি ও জনগণকে দেওয়া
প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, এ অবস্থায় আমাদের মতো হিসাবে
সংসার চালানো মানুষ এখন দিনে রোজা রাখবে। রাতেও না খেয়ে রোজা থাকবে। তাতে
কারও কিছু যায় আসবে না।
বর্তমান বাজারদর নিয়ে জানতে চাইলে সেগুনবাগিচা
বাজারে মহিন জেনারেল স্টোরের আবু হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, রোজার মাসে
ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি সমালোচনা এড়াতে কোম্পানিগুলো রমজানের অনেক
আগেই দাম বাড়িয়ে রেখেছে। রমজানের পণ্যের দাম বিগত সব সময়ের মধ্যে বেশি।
সরবরাহ
কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত কোনো পরিবেশক প্যাকেট চিনি দিচ্ছে না।
একটি-দুটি কোম্পানি ছাড়া কারও কাছে তেল নেই। পাইকারি বাজারেও কিনতে হচ্ছে
বাড়তি দামে।
পাইকারি বাজারের বড় ব্যবসায়ী ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির
সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা জাগো নিউজকে বলেন, কোম্পানি পণ্যের ডিওতে
সরকার নির্ধারিত দাম লিখছে, কিন্তু আন্ডার ইনভয়েসে পণ্যের দাম বেশি
নিচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে এ অভিযোগ করেছি। কিন্তু
কোনো প্রতিকার হয়নি। মূল্যবৃদ্ধির জন্য কয়েকটি কোম্পানির সিন্ডিকেট দায়ী।
কোম্পানিগুলোর আস্থা আছে যে তাদের কিছুই হবে না। জেল-জরিমানা হবে শুধু
বাজারের ব্যবসায়ীদের।
সার্বিক বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব
বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, শিথিল
পর্যবেক্ষণের মধ্যে বাজারে কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নেই। বাজার তদারকির
অভাবে দিন-দুপুরে মানুষের পকেট কাটছে ব্যবসায়ীরা। সরকার দাম নির্ধারিত করে
দিলেও সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এসব নজির দেখে সবাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
তিনি
বলেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং প্রতিযোগিতা কমিশন বাজারে
প্রয়োজনীয় তদারকি করতে পারছে না। তাদের জনবল নেই। কাজ কিছু হচ্ছে, তবে
সেটা অপ্রতুল।
নাজের হোসেন বলেন, গত দেড় মাসে মুরগির দাম কেজিতে ১০০-১২০ টাকা বেড়েছে, কিন্তু আমরা সরকারের কোনো যৌক্তিক উদ্যোগ খুঁজে পাইনি।
রোববার
(১৯ মার্চ) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা
সংক্রান্ত সভায় অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে জানানো
হয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় গতবারের তুলনায় এবার রোজায়
ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম থাকবে। কিন্তু দেশে এখন কোনো
পণ্যের চাহিদার ঘাটতি নেই। বরং বাড়তি রয়েছে।
প্রতি মাসে এক লাখ ৪০ হাজার
টন থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টন ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকলেও রোজায় তা দ্বিগুণ
বেড়ে তিন লাখ টনের চাহিদা তৈরি হয়। এখন সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম
গ্রুপ, আদানি গ্রুপের বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও বসুন্ধরা গ্রুপ মিলিয়ে
ভোজ্যতেলের মজুত রয়েছে তিন লাখ দুই হাজার ১৬৩ টন, পাইপলাইনে আছে দুই লাখ ৭৫
হাজার ৮৪৫ টন।
দেশে বছরে ২০ লাখ টন চিনির চাহিদার বিপরীতে আখ থেকে আসে
৩০ হাজার টন। সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ,
আব্দুল মোনেম গ্রুপ ও দেশবন্ধু গ্রুপ মিলিয়ে চিনির মজুত আছে দুই লাখ ২৫
হাজার ৫৬৩ টন, পাইপলাইনে আছে পাঁচ লাখ ৯৯ হাজার ৫০ টন, যা চাহিদার চেয়ে দুই
লাখ টন বেশি।
দেশে মসুর ডালের চাহিদা আছে ছয় লাখ টন, স্থানীয়ভাবে
উৎপাদন হয় দুই লাখ ২০ হাজার টন, আমদানি হয় প্রায় চার লাখ টন। মাসিক চাহিদা
৪০ হাজার টন হলেও রোজার মাসে চাহিদা হয় এক লাখ টন। মজুত রয়েছে এরচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে,
চলতি বছর ভারত থেকে প্রচুর ছোলা এসেছে। ছোলার বার্ষিক চাহিদা দেড় লাখ টন,
এর মধ্যে কেবল রোজার মাসেই এক লাখ টনের চাহিদা তৈরি হয়। প্রতিবছর প্রায় দুই
লাখ টন করে ছোলা আমদানি হয়।
সভা শেষে সাংবাদিকদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু
মুনশি বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়েছে, আমাদের যা প্রয়োজন তার মিনিমাম
দেড়গুণ মজুত রয়েছে। ক্রেতাদের প্যানিক হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। প্যানিক
হয়ে কেউ কিনতে যাবেন না। আমরা যেভাবে কিনি, সেভাবে কিনবো। যথেষ্ট মজুত আছে।