
খুচরা
ব্যবসায়ী শামসুল আলম বসে ছিলেন একটি লাকড়ির দোকানে। দোকানটি তার শ্যালকের।
কিছুটা অলস বিকেলে হয়তো আড্ডার মুডেই ছিলেন তারা। শালা-দুলাভাইয়ের খুনসুটিও
হয়তো চলছিল। হঠাৎ উড়ে আসে একটি লোহার পাত। পড়ে একদম তার মাথায়। হাসপাতালে
নেওয়ারও সময় পাওয়া যায়নি। তার আগেই উড়ে গেছে প্রাণপাখি।
সালাহউদ্দিন
একটি কার্পেট কারখানার গুদামের অফিস সহকারী। ৪ মার্চ বিকেলে তিনি তার
কারখানার সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ উড়ে আসা একটি লোহার পাত
আঘাত হানে তার মাথায়। হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তিনি প্রাণ হারান।
আমরা
কথায় কথায় সাবধান থাকার কথা বলি। দেখেশুনে পথ চলার পরামর্শ দেই। কিন্তু এই
শামসুল আলম বা সালাউদ্দিন তো সাবধানেই ছিলেন। দোকানে বসে থাকা বা নিজের
অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তো কোনো অপরাধ নয়। তারপরও এই দুজনকে প্রাণ দিতে
হলো কেন?
লোহার পাতই বা উড়ে এলো কোত্থেকে? তাদের কোনো দোষ নেই। তাদের
কিছু করারও ছিল না। তারা যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার থেকে অন্তত আধা
কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর কদমরসুল এলাকায় সীমা
অক্সিজেন লিমিটেডে বিস্ফোরণ ঘটে।
বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে আশপাশের অন্তত দুই
কিলোমিটার এলাকা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি। বিস্ফোরণে লোহার পাত কাগজের মতো
উড়ে যায় দূর-দূরান্তে। কেড়ে নিয়েছে শামসুল আর সালাউদ্দিনের প্রাণ। শুধু এই
দুজন নয়, এই বিস্ফোরণে প্রাণ গেছে আরও ৬ জনের। ময়নাতদন্তের পর রোববার (৫
মার্চ) তাদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। আহত হয়েছে অন্তত
৫০ জন। সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। (ঢাকা পোস্ট, ৫ মার্চ ২০২৩)
যে অক্সিজেন
মানুষের জীবন বাঁচায়, সেই অক্সিজেন প্ল্যান্টই কেড়ে নিলো মানুষের প্রাণ!
সীতাকুণ্ড নামটি মনে এলেই আমার কেন যেন অগ্নিকুণ্ডের কথা মনে হয়।
২০২২
বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে বিএম ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ
বিস্ফোরণে ৫০ জন। বিএম ডিপো আর সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের দূরত্ব মাত্র
পৌনে এক কিলোমিটার। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে সীতাকুণ্ডের এমন দুটি ভয়াবহ
বিস্ফোরণের ঘটনায়ও কি আমাদের টনক নড়বে না?
সীতাকুণ্ডে নানারকম
শিল্প-কারখানা আছে। দেশের উন্নয়নে শিল্প-কারখানার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু
নিরাপত্তা তো সবার আগে। তবে আমাদের দেশে নিরাপত্তার প্রশ্নটি থাকে সবার
শেষে।
স্পর্শকাতর শিল্প-কারখানায় যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার
কথা, অল্পকিছু খরচ বাঁচাতে আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায়ই রাখি না।
নামকাওয়াস্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখলেই হবে না, সেটা নিয়মিত বিরতিতে
আপডেটও করতে হবে।
বিএম ডিপো বা সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের বিস্ফোরণ
‘দুর্ঘটনা’ হিসেবেই বিবেচিত হবে। কিন্তু এটা আসলে আমাদের খামখেয়ালির ফল।
নিরাপত্তা প্রায়োরিটি না দেওয়ার মূল্য।
তবে মারা তো যায় সব সাধারণ
মানুষ। তাই কর্তাদের টনক তেমন নড়ে না। বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর
সীতাকুণ্ডের ভারী শিল্প এলাকায় অগ্নিনিরাপত্তাসহ কর্মসহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে
তদারকি শুরু করেছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তাতেও থামানো যায়নি মৃত্যু।
সীতাকুণ্ডে
৬ জনের মৃত্যুর শোক সামলানোর আগেই ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় একটি
তিনতলা ভবনে বিস্ফোরণে তিন জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন অন্তত ১৪ জন।
পুরান
ঢাকায় বারবার কেমিক্যাল কারখানায় আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যায়। কিন্তু
কেমিক্যাল কারখানা সেখান থেকে সরে না। নিয়মিত মনিটরিং করলে আস্ত একটা
অক্সিজেন প্ল্যান্ট উড়ে যাওয়ার কথা নয়।
ফায়ার সার্ভিস প্রথমে এসি থেকে
বিস্ফোরণের কথা বললেও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল
ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল দাবি করেছে, সুয়ারেজ লাইনে জমে
থাকা গ্যাস থেকে ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে। একই সময়ে গুলশানে একটি বাসায় এসি
বিস্ফোরণে একজন মারা গেছে। এরপরই ঘটে গুলিস্তানের ঘটনা।
গুলিস্তানের
সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৬ জন নিহতের
খবর পাওয়া যায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম
ফারুক বলেছেন, আমাদের যারা এক্সপার্ট আছেন, তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে
দেখেছেন এটা কোনো নাশকতামূলক ঘটনা না। অনেক সময় নানা কারণে বিস্ফোরণ হয়,
কখনো মিথেন গ্যাস, কখনো এসির গ্যাস। এটা গ্যাসজনিত কোনো বিস্ফোরণ হতে পারে।
এরপরও তদন্ত করে দেখা যাবে যে এটা নাশকতা, নাকি দুর্ঘটনা। (ঢাকা পোস্ট, ৭
মার্চ ২০২৩)।
সীতাকুণ্ড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজার
বা গুলশান কোনোটিই কিন্তু নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা। আর আগেই যেমনটি বলেছি,
এইসব দুর্ঘটনা আসলে আমাদের খামখেয়ালির জন্য ঘটে। কিছু অর্থ বাঁচাতে আমরা
গোটা দেশটাকেই পারলে বোমা বানিয়ে ফেলি।
পুরান ঢাকায় বারবার কেমিক্যাল
কারখানায় আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যায়। কিন্তু কেমিক্যাল কারখানা সেখান থেকে
সরে না। নিয়মিত মনিটরিং করলে আস্ত একটা অক্সিজেন প্ল্যান্ট উড়ে যাওয়ার কথা
নয়।
সুয়ারেজ লাইনটা নিয়মিত পরিষ্কার করলেই তো সেখানে গ্যাস জমার কথা না। আর গ্যাস জমতে না দিলে তিনটা মানুষের প্রাণ এভাবে উড়ে যেত না।
আমাদের
দেশে মানুষ বেশি। তাই বলে মানুষের জীবনের দাম তো আর কম নয়। পৃথিবীতে
প্রত্যেকটা মানুষের জীবন অমূল্য। বাংলাদেশেই যেন ব্যতিক্রম।
বারবার দুর্ঘটনার নামে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়। এই বিস্ফোরণ, এই আগুন বড় কাউকে স্পর্শ করতে পারে না বলে কোনো প্রতিকারও হয় না।
দুর্ঘটনার
পর প্রথম দুয়েকদিন হইচই হবে, তারপর সব থেমে যাবে। এই দেশে আসলে স্বাভাবিক
মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নাই। আপনি নিজের অফিসে থাকেন আর দোকানে থাকেন; আধ
কিলোমিটার দূর থেকে লোহার পাত উড়ে এসে আপনাকে হত্যা করে ফেলবে। মৃত্যুই যেন
আমাদের সাথে ঘুরছে।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ