বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বর ২০২৪
২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বাংলা ভাষার সুখ ও দু:খ
আনোয়ারুল হক
প্রকাশ: বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১১:৪৫ পিএম |



  বাংলা ভাষার সুখ ও দু:খ



গত বছরের মার্চে আমি এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা’ নামে একটি রচনা পাঠ করেছি। সেই নিবন্ধে বাঙালির আত্মত্যাগ, তার দুর্জয় সাহস এবং সংগ্রামে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ‘মাথা নোয়াবার নয়’ এই দৃঢ় প্রত্যয় ব’দ্বীপের বাঙালি জাতীর মহান বৈশিষ্ট তার উল্লেখ করেছি। ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতিয়তাবাদী চেতনায় আমাদের মাতৃভূমিকে দখলদারমুক্ত করেছি। দীর্ঘ সংগ্রামে আমরা নিজেকে চেনার বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছি। আজ বলতে চাই, প্রতিবছর ভাষাশহিদ দিবস এলে এই কথাটাই প্রথম মনে হয়, সবই আছে, সবই হচ্ছে, তবুও একটা অনীহা যেন থেকেই গেছে। বুদ্ধিজীবীরা বলেন, এটি আমাদের মজ্জাগত। দু’শবছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থেকে পরমুখাপেক্ষি দুর্বল মানসিকতা বাঙালির রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এই পরাধীন মানসিকতা বুঝি দ্বিতীয়বার বন্ধনমুক্ত হওয়ার পরও মুছে যায়নি।

তাই যদি না হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলো, বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হলো কিন্তু মায়ের ভাষার দু:খ আজও ঘুচলো না। এ দেশটির যারা আইন প্রণেতা, জনগণের নেতা অধিকাংশ রাজনীতিবিদ, উচ্চপদের সাহেব যারা, আমলা, কোটিপতি ব্যবসায়ী, বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সামরিক অফিসার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সকলেই তাঁদের নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে বাংলা মাধ্যমের স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করেন না। জীবন ও জীবিকার এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের  ভাষা হিসেবে তাঁরা মনে করেন এবং পছন্দ তালিকায় প্রথম স্থান দেন ইংরেজি ভাষাকে। দ্বিতীয়ত ধর্ম এবং পরকালের ভাষা হিসেবে আরবিকে মনে করেন অবলম্বন। কেবল একুশ এলে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ এবং ভালোবাসা জেগে উঠে। শহিদ মিনারে ফুলের মালা দেওয়া, কালো ব্যাজ ধারণ করা, কালো পোশাক পরিধান করা, উপযুক্ত সাজে সেজে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে না পারলে আজকাল মনে করি, একুশের শহিদ ও বাংলা ভাষার প্রতি বুঝি যথাযথ সম্মান এবং দায়িত্ব পালন করা হলো না। অন্তত এই একটি দিনতো আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।

সকলেই লক্ষ করে থাকবেন, একুশের প্রথম প্রহরে বা সকালে শহিদ মিনারে যত ভাষাপ্রেমী মানুষের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে থাকলে চলমান ভাষাজ্ঞান কান পাতলে, কথা শুনলে টের পাওয়া যায়। অভিভাবক থেকে আরম্ভ করে  স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, করেছে এমন ছেলেমেয়েদের নির্ভুল বানানে কিছু লিখতে দিলে তাদের ভাষাপ্রেমের দুর্বলতা চোখের আড়াল থাকে না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে বেদনার সঙ্গে অনুধাবন করছি, ভাষাশহিদ দিবস একুশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় দিবস পর্যন্ত মুক্তির জন্য রক্তস্নাত দিনগুলোর তাৎপর্যকে আমরা পুরোদস্তুর একদিনের অনুষ্ঠানে পরিণত করে ফেলেছি। যেজন্যে বিজ্ঞজনেরা বলেন, উন্নতি অনেক হয়েছে আমাদের কিন্তু ব্যবস্থাটা বদলায়নি। ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য, বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানী আমলের তুলনায় আমাদের তো এখন বারবার বক্তৃতা, বিবৃতি দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবুও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, আদালতের নির্দেশ পেতে হয়। সংবিধান দেখিয়ে কথা বরতে হয়। কেন ?

অনুসন্ধানে বলে, তার কারণ সম্ভবত এই, এই দেশের সাধারণ মানুষই আসলে বাঙালি। খাঁটি বাঙালি। বাংলা তাদেরই ভাষা। প্রাকৃত জনের ভাষা।  ইতিহাস বলে, অতীতে যারা নিজেদের অভিজাত বলে মনে করেছেন তারা এ দেশের মাটিতে জন্ম গ্রহণ করলেও নিজেদের তারা বাঙালি বলে মনে করতেন না। তাঁরা মনে করতেন, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা অন্য জায়গা থেকে এসেছেন। এত বছরেও শোণিতের সেই ধারা শেষ হয়ে যায়নি। তাই আজকের ধনী ও শিক্ষিত, মানে যারা নিজেদের অসাধারণ বলে ভাবেন, তারা বাঙালি থাকতে চায় না। তাদের কেউ বিদেশে যায়, যারা যায় না তারা দেশে থেকেই বিদেশী হয়ে যায়, অথবা বিদেশী হতে চায়। তারা বিদেশী পণ্য ব্যবহার করে না শুধু, তারা বিদেশী ভাষাও ব্যবহার করে। তাদের আদর্শ এই গরিবের দেশ বাংলাদেশ নয়। তাদের মন পড়ে থাকে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি বিদেশের মাটিতে, মনোরঞ্জনে। তাদের আদর্শ পুঁজিবাদী বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ কর্তা প্রভুরা।

বলা হয়েছে, আমরা যাদের বাঙালি বলি, এই বাঙালিকে আমরা চিনি চেহারা দেখে নয়, পোশাকেও নয়। কেননা, চেহারা ভিন্ন হতে পারে, পোশাক-আশাকও একরকম নাও হতে পারে।  চিনি মুখের ভাষা দিয়ে। আর আজকাল ভাষাও যথেষ্ঠ নয়, চেনার আরও একটি নিরিখ হলো, ভালোবাসা দিয়ে। বাঙালির প্রতি ভালোবাসা। সে-ই বাঙালি, যে বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং বাঙালিকে ভালোবাসে। মনে-প্রাণে ভালোবাসে। যে ভালোবাসা না থাকলে সবই মেকি। প্রকৃতপক্ষে, এই ভালোবাসার অভাববোধই সব থাকা সত্বেও আমরা যেন না বাঙালি কিংবা অবাঙালি। কিছুতেই বাঙালি নয়। দেশ-মাটি-মা আর নিজের মা, সে একই। ভালোবাসা ছাড়া যার মূল্য হয় না।

এজন্যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, সম্ভবত আঠার কোটি বাঙালির মধ্যে কতজন আমরা বাংলা বলি ? উত্তর খুব সহজ। অধিকাংশই যে বাংলা বলে তা ঠিক। কিন্তু শুদ্ধভাবে বলে না। এবং মনে হয় যেন, না পারতে বলে। শিক্ষিতের হার বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের শিক্ষা নেই। অজ্ঞ। ভাষাজ্ঞান যাদের নেই তারাই কেবল বাংলা বলে। আর যারা শিক্ষিত, তাদের ভাষায় ইংরেজির মিশেল বাড়ছে, কেবলই বাড়ছে। এতো বেশি ইংরেজি শব্দ, বাক্যাংশ, এমন কি আস্ত বাক্য প্রবেশ করছে যে, কখনো কখনো মনে হয়, বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশে নি, ইংরেজির সঙ্গে বাংলা মেশানো হয়েছে। এ যেন দুধে পানি নয়, পানিতে দুধ মেশানো হয়েছে। পারলে তারা ইংরেজিতেই কথা বলতো। পারে না, সাহস নেই। ভয় পায়, পাছে লোকে কিছু বলে! এজন্যে। প্রকৃতপক্ষে তারা না ইংরেজি, না বাংলা কোনটাই ভাল জানে না, বলতে পারে না। পণ্ডিতেরা মনে করেন, বাঙালি নিজের পায়ে দাঁড়াতে বড় ভয় পায়। এই ভয় বাঙালির এক ঐতিহাসিক গ্লানি। যুগযুগান্তরের পরাধীনতার কারণে। কথায় আছে, কাঁধের বোঝাকে ফেলে দেওয়া যায় কিন্তু চেতনার রোগ সারবে কী দিয়ে ? যে বাঙালি চেতনার কথা আমরা বলি, সে তো মুখে উচ্চারণ করলেই হয় না। অন্তরে প্রোথিত হওয়া চাই। ভালোবাসা চাই। কিন্তু সেই মনের ভিতরে, কাঁধে যে ঠাঁই নিয়েছে প্রভুত্বের জোয়াল। তাকে সরাবে কে ? তা না হলে সংবিধান বলছে, আইন বলছে তবুও মানছে না কেন ? তার উত্তরও জোগান আছে। মানবেই বা কেন ? আমাদেরই যে মুখে এক, কাজে আরেক নীতি, গলদ তো সেখানে!

এই যে, সংবিধানে আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা প্রচলনে আছে আইন। সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন বিষয়ে এবং বেতার ও টিভিতে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ রোধে উচ্চ আদালতও আদেশ দিয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়। আইনের প্রবর্তন ও কার্যকরী- সংক্রান্ত ৩(১) ধারা বলছে, এই আইন প্রবর্তনের পর দেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকরি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।

২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতেই বিধ্বংসী’ শিরোনামের নিবন্ধ আদালতের নজরে আনা হলে আদালত স্বত:প্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন। তাতে বলা হয়েছে, বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষায় সর্ব্বোতভাবে চেষ্টা করতে হবে, যাতে এ ভাষার প্রতি আর কোন আঘাত না আসে, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। হ্ইাকোর্ট বেতার ও প্রচার মাধ্যমে বিকৃত উচ্চারণ, ভাষা ব্যঙ্গ ও দূষণ করে অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেন। বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সেজন্যে আদালত বাংলা একাডেমিকে কমিটি গঠন করতে পরামর্শ দেয়।

তারপর কমিটি হয়েছে। কমিটির সুপারিশে, ভাষার দূষণ ও বিকৃতি রোধে আইন তৈরি করে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল এবং দেশীয় বেতার ও টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক প্রমিত বাংলা ভাষার কোর্স চালু এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পঠন-পাঠন প্রবর্তনের উদ্যোগ, বেতার ও টেলিভিশনে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ভাষায় বিদেশী শব্দের অকারণ মিশ্রণ দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

আমরা মনে করি, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আজ বাংলা ভাষা সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আগামীতে আমরা ভাষা-সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৪৯ সালে বিপ্লবের পর নয়চীন সরকার তাদের দেশে আমেরিকা পরিচালিত ইংরেজি স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়। এর পরিবর্তে বাধ্যতামূলক ম্যাণ্ডারিণ ভাষা চালু করে। এই ঘটনার পঞ্চাশ বছর পরে আজকের চীনের অবস্থা দেখলে বুঝা যায়, তাদের ভাষানীতি কীভাবে তাদের জ্ঞানচর্চায় অবদান রেখেছে। একুশ শতকে এসে চীন অর্থনৈতিক বাণিজ্যেও বর্তমান বিশ্বকে শাসন করতে চলেছে সন্দেহ নেই।

আর আমরা স্বাধীনতার পর এতগুলো বছরে কী করেছি, তা সীমিত আকারে খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা প্রথমে নব্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সম্প্রসারণে অভিজাত ধনীদের জন্য লেখাপড়া শেখার মাধ্যম ‘ও লেভেল, এ লেভেল’ চালু করেছি। এই মনে করে এটা চালু হয়েছে যে, সমাজে এলিটরা আছে, তাই তাদের একটা ভাষা থাকতে পারে। কিন্তু তারপর সরাদেশে পরিচালিত বাংলা মাধ্যম সাধারণ স্কুল-কলেজে সরকারিভাবে বাংলা ভাষার বইগুলো ইংরেজি করে ‘ন্যাশানাল কারিকুলাম ইংরেজি’ নামে আরেকটি মাধ্যম চালু করেছি। এর ভোক্তা মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওরাই, যারা উপরে উঠতে পারে না, নিচেও নামতে পারে না। মধ্যবিত্ত থেকেও তার আলাদা হতে চায়। যার ফলে বাংলা ভাষার বুনিয়াদ যাদের হাতে পোক্ত হওয়া, গড়ে ওঠার কথা ছিল তার সম্ভাবনা ব্যহত হয়েছে। এতে বাংলা প্রায় না জানা, আধেক ইংরেজি জানা আরেকটি জেনারেশন আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। এদের বাংলা ভাষার বুনিয়াদ প্রকৃতই দুর্বল। ইংরেজিও। দেশের সবাইকে যদি ইংরেজি শেখানো যেতো তাহলে এই মাধ্যম ভালো ফল দিতে পারতো। দেশের নিম্নশ্রেণি থেকে আম জনতা সবাই ইংরেজি শিখতো। দেশ আন্তর্জাতিক ভাষা মান অর্জন করতো। কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। বরং ইংরেজি ভুলভাল শেখা আরেকটি শ্রেণি দিনে দিনে বেড়ে উঠছে। যেহেতু, আমাদের প্রাইমারি স্তরে ইংরেজি জানা শিক্ষকের অভাবে শেখানোর ব্যবস্থাটি অতীতের তুলনায় যথেষ্ঠ দুর্বল। এই অবস্থায়, বাংলা ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ শ্রেণির ভাষায় পরিণত হচ্ছে। বলা যায়, এই পরিস্থিতি উত্তর ঔপনিবেশিক নয়া-ভাষা সংকট।

উপর্যুক্ত প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় আলোকপাত করা যায় তা হলো, মধ্যম এবং নিম্ন আয়ের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য পরিচালিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনের কলেজগুলোতে আংশিকভাবে বাংলা মাধ্যমে পরীক্ষার উত্তরপত্র লেখা হয়। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, পরিভাষার অভাব, যেজন্যে বাংলায় উচ্চশিক্ষার গ্রন্থ লেখা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি ভুল ধারণা। গ্রন্থ লেখার সুযোগ তৈরি করা, ব্যবস্থা করা এবং নিয়মিত লেখার তাগিদ থাকলেই পরিভাষা তৈরি হবে, হতে পারতো। পরিভাষা সৃষ্টি করে বই লেখা অবাস্তব পরিকল্পনা। চীনের মত বৃহৎ জনসংখ্যা ও দেশ যদি ইংরেজিতে জোর না দিয়ে আজকের বিশ্ব শাসন করতে পারে আমরা বাংলা শিখে পারবো না কেন ? চীন ইংরেজি শিখেছে সীমিত আকারে জরুরি প্রয়োজনে। আমাদেরও সেটা চালু রাখার জন্য ও লেভেল, এ লেভেল ছিলো। যার প্রয়োজন সে ইংরেজি শিখবে। কিন্তু কেন যে আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সকলের জন্য লেখা বইগুলো ইংরেজি করার দরকার পড়লো বুঝা দুষ্কর। সচেতন বাঙালি হিসেবে দু:খজনক উপলব্ধি আমাদের, এইসব প্রয়াস স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার একেবারে বিপরীত প্রয়াস। এই প্রয়াস যাদের লালনে পালনে চর্চিত হচ্ছে, চলছে, মনে করি, তাঁরা মুখে বাঙালি বটে, মননে নয়, মা ও মাটিকে ভালবেসে নয়।

সমাজবিজ্ঞানী বলছেন, যাদের দ্বারা এই প্রয়াস আব্যহত আছে, আদালত, সংবিধান কোনটাই যাদের নজরে পড়ে না, তারা মুখে বাঙালি জাতীয়তাবাদী কিন্তু অন্তরাত্মায় পুঁজিবাদী। আমরা ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের কথা জানি। বর্তমান সময়ে এই মজিদেরাও কিন্তু এখন আর আগের মতো অবস্থায় নেই। আর্থিক দিক থেকে তাদের যথেষ্ঠ উন্নতির ফলে বিত্তবান হয়ে তারা শাসক শ্রেণির ক্ষমতার সঙ্গে মিশে গেছে। সাতচল্লিশের সেই মজিদ এখন আরও ভয়ংকর। কেননা, সে স্থানীয় তো বটেই, বিদেশী মুরব্বিরাও এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ওরা এখন আন্তর্জাতিক। মজিদেরা এখন প্রযুক্তির ব্যবহার জানে এবং তার হাতে আছে বিস্তর টাকা।  মাতৃভাষা থেকে প্রকৃত জ্ঞানের শিক্ষা এদের দ্বারাও আক্রান্ত। তাই বলা হয়েছে, পুরাতন রাষ্ট্রটি আকারে ভেঙ্গেছে, স্বভাবে ভাঙ্গেনি। সামাজিক সম্পর্কগুলোও আগের মতোই রয়ে গেছে, মালিক ও ভৃত্যের। যেজন্যে মালিক ও মালিকের ছেলে-মেয়েরা ইংরেজি স্কুলে পড়বে। মজিদের সন্তানেরা আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। আর ঐ প্রভুদের যারা ভৃত্য, তাদের ছেলেমেয়েরাও কী প্রভুদের সন্তানের মতো হবে ? তা কী করে হয় ? তারা পড়বে সাধারণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, যেগুলিতে শিক্ষার নামে চলবে অর্ধশিক্ষার রান্নাবান্না। যে উদাহরণ আগে দিয়েছি।

স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা ইংরেজি শিক্ষার বিরোধীতা করি না। মনে করি, গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হতে পারে। প্রয়োজনের ভাষা হতে পারে। কেননা, প্রতিযোগিতার বিশ্ব বাজারে কে কোন দেশে লেখাপড়া করেছে সেটা বিবেচ্য নয়। জব মার্কেটে আমার দেশের ছেলে-মেয়ে এবং আমেরিকা-কানাডা-ইউরোপ থেকে পাশ করা ছেলে-মেয়ে সকলেই পণ্য। ব্যবসা ও গবেষণা সেক্টরে তারা একে অন্যের প্রতিযোগী। সেজন্যে উচ্চশিক্ষার ভাষা আন্তর্জাতিক হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আমাদের প্রজন্মদেরও আন্তর্জাতিক হওয়া চাই। তবে এ কথাও ঠিক, উচ্চশিক্ষা সবার জন্য জরুরি নয়।

আর এই কথাটাই আমরা ভাবিনি। আমরা সকলকে উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রতিযোগিতায় নেমেছি। যার ফলে নিজেদের অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে। তবুও আমরা আশার আলো দেখি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দুর হবে। শিক্ষার নিম্নস্তর থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত মাতৃভাষা শিক্ষার স্তরগুলোর মধ্যে যে বৈপরীত্য আছে তার মীমাংসা করা হবে। কেবলমাত্র ভাষার মাস এলে আহ্লাদ না দেখিয়ে বাংলা ভাষাকে যুগপোযোগী করার জন্য বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানের, বুদ্ধিজীবীদের কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত মনে করি। যে ভুল দিনের পর দিন ভারী হচ্ছে তার জঞ্জাল সরিয়ে ফেরবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যাদের হয়ে বলেছেন,

 

‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে

তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে।’

 

প্রত্যাশা করি, আমাদের ছেলে-মেয়েরা জেগে উঠবে। দেশমাতার মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আত্মসচেতন হবে। বুঝতে হবে, আমার ভাষা আমার শেকড়, আমার অন্তরাত্মার প্রাণবায়ু। যাকে লালন-পালন করে সমৃদ্ধ করতে না পারলে নিজের অস্তিত্ব বিপদের মুখে পড়বে। ঔপনিবেশিক দাস চেতনা থেকে মুক্ত হতে না পারলে স্বাধীনতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিজয় সম্পূর্ণ হয় না। পুঁজিবাদী আগ্রাসন থেকে বের হয়ে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা, মুক্তির স্বাদ পেতে হলে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এর ডাক আমাদের মর্মে ধারণ করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, আশ্রয় ও অবলম্বন হিসেবে মাতৃভাষার বিকল্প নেই।

 

এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।

এই মুক্তি যে কেবল ভূখণ্ড নয়। সব রকমের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মনের শিকলটাকেও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, যার ফলে একজন বাঙালি হয়ে উঠবে একই সঙ্গে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক। ভাষা আন্দোলনে যে রক্ত মাটিতে পড়েছে তারই প্রজন্ম তো আমরা। স্বজন হারানোর বেদনা ও দু:খের সঙ্গে আমাদের সুখও তো এই, শহিদ সন্তানেরা দিয়ে গেছে- এই মাটি, এই ভাষা, এই আলোকিত ভূবন ও প্রকৃতি যেখানে শ্বাস নিই সকাল-বিকেল-রাত্রি, বেঁচে থাকি বেঁচে আছি প্রতিটি নতুন সূর্য উদয়ে, চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে। সে তাঁদের জন্য, যাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের অহংকার। মহান প্রিয় অর্জন লাল সবুজের পতাকা।

 














সর্বশেষ সংবাদ
নতুন বইয়ের বর্ণিল নতুন বছর
নৌকায় ভোট নিতে ভাতার কার্ড আটকে রাখার অভিযোগ
শান্তির নোবেলজয়ী থেকে দণ্ডিত আসামি
শ্রমিক ঠকানোর দায়ে নোবেলজয়ী ইউনূসের ৬ মাসের সাজা
ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা অধ্যক্ষ পদে অধ্যাপক ডাঃ রুহিনী কুমার দাস এর দায়িত্ব গ্রহণ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু নিহত
বরুড়ায় শ্রমিকদল নেতাকে ছুরিকাঘাত
অর্ধেক দামে ফ্রিজ বিক্রি করছেন ফ্রিজ প্রতীকের প্রার্থী
বাড়ির জন্য কেনা জমিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যাওয়া একই পরিবারের ৪ জনের কবর
৫৫ কেজি সোনা চুরি, ফের রিমান্ডে দুই রাজস্ব কর্মকর্তা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২