
এড্যভোকেট গোলাম ফারুক ||
গত
এক স্বহস্রাব্দ কাল ধরে অবরোধবাসিনী নিরক্ষর, স্বাক্ষর, স্বশিক্ষিত,
স্বল্প শিক্ষিত থেকে অতি শিক্ষিত নারীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও
ব্যক্তিগত মেধা, সুযোগ সুবিধার দিকে পারিবারিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,
প্রশাসনিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার জন্য শাসক, শোষণ ও নির্যাতনের
বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় নারীরা। সূচনা হয় নারী জাগরণের। বর্ণভেদ, বাল্যবিবাহ,
লৌকিক ধর্মাচার, পর্দাপ্রথা, ফতোয়া, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা ও
শাসকের রক্ত চক্ষুর বিরুদ্ধে পড়তে হয়েছে নারীদের। এ লড়াইয়ের সাথে যুক্ত
হয়েছে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, আদিবাসী, কৃষক, শ্রমিক, সম্প্রদায়ভুক্ত
সব নারীদের অধিকার, উন্নয়ন, সমতা, প্রগতি ও ক্ষমতায়নের দাবী উত্থাপনের
প্রশ্নে সংগঠিত হয়ে সংগ্রাম করে নারীরা গড়ে তোলে এক সংঘবদ্ধ সামাজিক
আন্দোলন। এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রচিত হয় বর্তমান নারী প্রগতির অগ্রযাত্রার
এক অনবদ্য ইতিহাস। নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় মুসলিম ও হিন্দু
সমাজের নারীরা লড়েছেন সমান তালে। প্রথমেই মুসলিম নারীদের কথা বলছি শিক্ষা ও
শিল্পের প্রতি অনুরাগ শুধু পুরুষ এর মধ্যে এককভাবে সীমাবদ্ধ ছিল না।
নারীদেরও সংস্কৃতি ও শিক্ষা লাভ সমভাবে চলেছে পুরুষদের সাথে সাথে। সাহিত্য ও
বিজ্ঞান সাধনায় পুরুষদের মত নারীরাও উৎসুক ও নিবেদিত। নারীদের জন্য
প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব কলেজ ৬৮৪ হিজরীতে তেমনি সর্বজন বিদিত একটি প্রতিষ্ঠান
কায়রোতে স্থাপন করেছিলেন মামলুক সুলতান মালিক তাহেরের কন্যা। খলিফা হারুন
অর রশিদ এর স্ত্রী যোবায়দা অনেকগুলি আবাসিক আশ্রয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আজাদ্দুদৌলার স্ত্রীর স্থাপিত হাসপাতালটি তার স্বামীর স্থাপিত
প্রতিষ্ঠানকেও ছড়িয়ে গেছে। মালিক আশরাফের কন্যা দামেস্কে একটি বিখ্যাত কলেজ
স্থাপন করেছেন। আর একটি কলেজ স্থাপন করেছেন হেমসের নাসির উদ্দিনের স্ত্রী
জামরূদ খাতুন। কাব্যক্ষেত্রে ও বহু মুসলিম মহিলা প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কন্যা ফাতেমা (রাঃ) র স্থান কবিদের মধ্যে ছিল বেশ
উর্ধে। তেমনি আওরঙ্গজেবের কন্যা মখমী নামে অভিহিত জেবুন্নেছা দিওয়ান লিখে
সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আবকুহার্ট যখন তুরষ্ক ভ্রমণ করেন তখন সমধিক
প্রসিদ্ধ কবিদের মধ্যে তিনজন ছিলেন মহিলা এবং তাদের মধ্যে পেরীশেখ খানম
নামীয় কবি ছিলেন সুলতান মুস্তফার ঘনিষ্ট সহকর্মী। দুনিয়ার অন্ধকার যুগে
মুসলিম নারীরা জাতির মুক্তির দিশারী হিসেবে অসংখ্য নজির স্থাপন করেছে।
মুসলিম স্পেনে তাদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। খলিফা মোস্তাকফির কন্যা
‘ওয়াল্লাদা’ আরবীতে কবিতা লিখে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কর্ডোভার
প্রিন্স আহামেদের কন্যা আয়েশার বাগ্মিতা সর্বজন বিদিত ছিল। বিদূষী ‘লাবানা’
আল হাকামের একান্ত সহকারী ছিলেন। ইনি দর্শনশাস্ত্রে বিশেষ খ্যাতি লাভ
করেছিলেন। সেবিল নিবাসী ইয়াকুব আল আনসারের কন্যা ‘মরিয়ম’ সাহিত্য ও অলঙ্কার
শাস্ত্রে অধ্যাপনা করতেন। জয়নব উম্মে আল মুয়িদ একজন সুশিক্ষিত কর্মজীবী
ছিলেন। তাকিউদ্দিন ওয়াসিতির কন্যা ‘সিওল’ ফেকাহ শাস্ত্রের অধ্যাপিকা
ছিলেন।ওমর (রা:) এর বানিজ্য বিভাগ এর দায়িত্বে ছিলেন সাফিয়া বিন্তে
আব্দুল্লাহ। তার কর্মদক্ষতা এতই নিপুন ছিল যে ওমর (রা:) কখনো তার কোন কাজ
বা সিদ্ধান্ত দ্বিমত করতেন না। আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদ এর স্ত্রী
ছিলেন তার আমলে দক্ষ প্রশাসক। তিনি হলেন ‘‘যোবায়েদা’’। তার পরিকল্পনা ও
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৎসময়ে বাগদাদ হতে মক্কা পর্যন্ত ১৫০০ কিমি: রাস্তা
নির্মান করা হয়েছিল। যা সে সময়ে মুসলিম বিশ্বে বানিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্ব
পূর্ণ ভূমিকা রাখে এই রাস্তা নির্মানে তৎ সময়ে ব্যায় হয়েছিল ৫ হাজার ৯০০
কেজি স্বর্ন মূল্য মানের অর্থ। যোবায়েদা আরএকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল
যোবায়েদা নহর বা নহরে যোবায়েদা খনন।হজ্জ এর সময় হাজী সুপেয় পানির পানের
কষ্ট ভোগ করতেন। বাগদাদ থেকে বিশেষঞ্জ এনে প্রাম্ম করে পানি পহাড়ের উপরি
ভাগে তুলে নহর কেটে এই সুপেয় পানি আরাফাত এর ময়দান হতে কাবা ঘর পর্যন্ত
আনার ব্যবস্থা করে দিয়ে ছিলেণ।
স্পেনে মুসলিম সভ্যতার ইতিবৃত্তে দেখা
যায় সন্তানের শিক্ষার আগে মায়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হত, হতো বলেই
মুসলিম স্পেন শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে তৎকালীন বিশ্বে চরম শিখরে
পৌঁছেছিলেন। মুসলিম নারীদের ঐ অতীত গৌরব গাঁথা আজও বিশ্ব নারী সমাজের
আলোকবর্তিকা।
নারীদের মধ্যে নারীশিক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন, উদ্যোগ
নিয়েছেন বিবি তাহেরুন্নেছা, ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী, করিমুন্নেছা খানম, হুগলির
আগা মোতাহার এর মেয়ে জমিদার মুন্নুজান।
একেবারে অন্তঃপুরবাসিনী
ফয়জুন্নেছা নিজ চেষ্টায় পর্দার ভেতর থেকে বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি ও সংস্কৃত
ভাষার চর্চা করেছেন। ১৮৭৩ সালে তিনি ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন
করেন, স্কুলের সাথে হোস্টেল তৈরি করেন। তাঁর কর্মোদ্যোগের জন্য ১৮৮৯ সালে
মহারানী ভিক্টোরিয়ার নির্দেশে তাঁকে নওয়াব উপাধি দেওয়া হয়।
ভারতীয়
উপমহাদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে কিছু পরিবারও ভূমিকা রেখেছিল।
১৮৯৭ সালে মুর্শিদাবাদের নবাব বেগম ফেরদৌস মহলের উদ্যোগে বোম্বের পারসি
পরিবার এবং ১৯০৫ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মা সমাজকর্মী খুজিন্তা আখতার
বানুর উদ্যোগে মুসলিম বালিকাদের শিক্ষার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। তাঁর
প্রতিষ্ঠিত স্কুল বাংলাদেশের মুসলিম মেয়েদের জন্য প্রথম স্থায়ী স্কুল।
ফায়জী পরিবারের তিন বোন আতিয়া, জোহরা ও নাজলী মুসলিম মহিলাদের মধ্যে
সর্বপ্রথম উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে মোহামেডান
এডুকেশনাল কনফারেন্স থেকে মহিলাদের বাদ দেওয়া হলে আতিয়া ফায়জী তীব্র
প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তিনি দেশের সর্বত্র সভা করে প্রচার করেছিলেন নারীকে
তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। ঐ সময়ে একজন নারীর এ ধরনের প্রতিবাদ
অবশ্যই তাঁর দৃঢ়তার দাবি রাখে। এ সময়কালে বেগম রোকেয়ার আর্বিভাব ঊনিশ ও বিশ
শতকের মধ্যে সেতুবন্ধনের ভূমিকা নিয়েছিল
ফয়জুন্নেসার পর যে নারীরা এগিয়ে আছেন তারা হলেন-
মাদাম
কামা:বোম্বের পারশি পরিবারের অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ও মানবতাবাদী মহিলা
মাদাম কামা ১৯০১ সালে বিদেশ যান প্রবাসী বাঙালিদের সাথে যুক্ত হয়ে স্বদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য কাজ করতে। এর আগে তিনি আন্দোলনের পক্ষে দেশে
সোচ্চার ছিলেন। তিনি মার্কসবাদী দর্শনের অনুসারী ছিলেন। পাশ্চাত্য বিশ্বে
নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের সাথেও মাদাম কামা যুক্ত ছিলেন।
সরোজিনী
নাইডু :১৯১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর মন্টেগু চেমসফোর্ড মিশনের কাছে ভারতের
বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের প্রতিনিধিরা একটি স্মারকলিপি পেশ করেন সরোজিনী
নাইডুর নেতৃত্বে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা প্রতিনিধি মহিলারা নারী
সমাজের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মাতৃমঙ্গল ব্যবস্থা এবং ভোটাধিকার দাবি করেন।
অ্যানি
বেশান্ত: ১৯১৭ সালে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী মার্গারেট কানিজের উদ্যোগে
অ্যানি বেশান্তকে সভানেত্রী করে উইমেন্স ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন গঠন করা হয়।
আন্দোলনের প্রধান বিষয় ছিল নারীর ভোটাধিকার। নেতৃত্বে ছিলেন সরোজিনী নাইডু,
কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, রেনুকা রায়, রাজকুমারী অমৃত কাউর, রামেশ্বীনেহেরু,
বেগম হামিদা আলী প্রমুখ।
১৯১৮ সালে ভারতীয় মুসলিম লীগ ও ভারতীয় জাতীয়
কংগ্রেস নারীদের ভোটাধিকার দাবি সংরক্ষণ করেন। তাঁদের এই আভাস দেওয়া হয় যে,
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে এ দাবি পূরণ করা হবে না। বরং নিজস্ব বিষয়ে
ভারতের প্রদেশগুলোর আইনসভায় এ দাবি মেনে নেওয়া সহজ হবে। অবশেষে মহিলা
সমাজের তীব্র আন্দোলনের চাপে মহিলাদের ভোটাধিকারের বিষয়টি প্রদেশের
বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে মাদ্রাজের আইনসভায় প্রথম বারের মতো
মাদ্রাজের মেয়েদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়।
১৯২৫ সালে উড়িষ্যা ও বিহার
প্রদেশ ছাড়া ভারতের সব প্রদেশের আইনসভায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নারীর ভোটাধিকার
অনুমোদিত হতে থাকে। ১৯৩৫ সালে ইংরেজ সরকার ভারতের ৬০ লক্ষ নারীর
ভোটাধিকারের আইন পাশ করে এবং মেয়েদের জন্য রাজ্য পরিষদে ১৫০টি আসনে ৬ জন ও
কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫০ আসনে ৯ জন মহিলার আসন সংরক্ষিত হয়। এই নির্বাচিত
সদস্যদের মধ্যে শায়েস্তা একরামুল্লা ছিলেন অন্যতম।
সমাজ সংস্কারক ফয়জুন্নেছার আবদান:-
শিক্ষা
বিস্তারে ফয়জুন্নেছা ঃ ফয়জুন্নেছার জমিদারির অন্তর্গত ১৪টি মৌজায় তিনি
১৪টি প্রাথমিক মক্তব স্থাপন করে দিয়েছিলেন। মৌজা সমূহ হলো-১। সদর তালুক
(সদর পশ্চিমগাঁও, নিজ বাড়ী), ২। সদর খাস (পশ্চিমগাঁওয়ে), ৩। ভাটার (লাকসাম
জংশন ষ্টেশনের পাঁচ মাইল পূর্বে), ৪। মোহাম্মদগঞ্জ (লাকসাম থানার পূর্বে),
৫। ফোমগাঁও (লাকসাম থানার শেষ পশ্চিম প্রান্তে), ৬। কৃষ্ণপুর (লাকসাম থানার
পূর্ব দক্ষিণে), ৭। মানিকমুড়া (নাথেরপেটুয়ার পূর্বে),
৮। কুমিল্লা
উনিষা (দক্ষিণ চর্থা), ৯। ভাউকসার (বর্তমানে বরুড়া থানায়), ১০। বাংগড্ডা
(চৌদ্দগ্রাম থানায়), ১১। খাড়ঘর (চৌদ্দগ্রাম থানায়), ১২। সিজিরিয়া
(চৌদ্দগ্রাম থানায়), ১৩। বক্সগঞ্জ (নাঙ্গলকোট থানায়) ১৪। ছাতারপাইয়া
(নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানায়)। নিজ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ঃ বর্তমানে
পশ্চিমগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বলে যে স্কুলটি দেখা যায় যা বর্তমানে
উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত সেই স্কুলটি মূলত নওয়াব ফয়জুন্নেছা কতৃক
প্রতিষ্ঠিত নিজ গ্রামের শিশুদের প্রারম্ভকালীন পড়াশুনার অন্যতম কেন্দ্র।
দ্বীনিয়াত
শিক্ষা ঃ ফয়জুন্নেছা শিক্ষা বিস্তারে হাত দিয়ে প্রথমেই নিজ বাড়ীতে
দ্বীনিয়াত শিক্ষার শিক্ষালয় গড়ে তুলেছিলেন।
পারিবারিক
টোল থেকে হাইস্কুল ঃ ফয়জুন্নেছার পূর্ব পুরুষদের একটি পারিবারিক টোল ছিল।
টোলটি আগুনে পুড়ে গেলে সেখানে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাতার অনুরোধে
কন্যা বদরুন্নেছা ৯৫ ডিসিমেল জমি দান করে ১৯০১ সালে এই জমিতে একটি ইংরেজি
বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই স্কুলটির নাম হয় বদরুন্নেছা উচ্চ ইংরেজী
বিদ্যালয়। এই স্কুলটির সাথে ফয়জুন্নেছার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটি সংযুক্ত
হওয়ায় স্কুলটির নাম হয় ফয়জুন্নেছা-বদরুন্নেছা যুক্ত হাইস্কুল। বর্তমানে ও
এই নামেই আছে।
নওয়াব ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ঃ ১৮৩৭
খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে
ফয়জুন্নেছা কুমিল্লা শহরে তাল পুকুরের পূর্ব পাড়ে ৫ একর ভূমি দান করে
ইংরেজি মাধ্যমের এই স্কুলটি শুধুমাত্র মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্থাপন করেন।
বর্তমানে এটি সরকারী স্কুল এবং কুমিল্লা জেলার মেয়েদের জন্য অন্যতম শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান।
নানুয়ার দীঘির পাড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় ঃ এছাড়াও ফয়জুন্নেছা
কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দিঘীর পশ্চিম পাড়ে স্কুল স্থাপন করেছিলেন। এই
স্থানটিতে বর্তমানে শৈলরানী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় অবস্থিত। বর্তমানে
ফয়জুন্নেছার প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
নওয়াব
ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ ঃ ফয়জুন্নেছা নিজ বাড়ীর সন্নিকটেই ডাকাতিয়া নদীর
তীরে ফয়েজিয়া মাদ্রাসাটি স্থাপন করেছিলেন। এই মাদ্রাসাটি পরে ওল্ডস্কীম হয়ে
নিউস্কীম মাদ্রাসায় রূপান্তরিত হয়। পরে এই মাদ্রাসাটি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ
হয়। পর ডিগ্রী কলেজে উন্নীত হয়। এরপর ১৯৮২ সনে কলেজটি সরকারি করন করা হয়।
প্রবাসে
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঃ ফয়জুন্নেছা যে শুধু তার নিজ জমিদারিতেই বিভিন্ন
সামাজিক কর্মকান্ড ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তা নয়। তিনি নিজ
জমিদারির বাহিরে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। নিজ দেশের সীমানা
পেড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে স্কুল ঃ যত দূর জানা যায় দেশের সীমানার বাহিরে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কৃষ্ণনগর নদীয়াতেও তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা
করে গিয়েছেন।
পবিত্র মক্কা মদিনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঃ তিনি পবিত্র
হজ্জব্রত পালন করতে মক্কা শরীফ গিয়ে মক্কার মেছফালায় ‘মেছফালাহ মাদ্রাসা’ ও
অপরটি ‘মাদ্রাসা ই সাওলাতিয়া’ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। মক্কার ২টি
প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩০০ টাকা ও মদিনার একটি মাদ্রাসার জন্য ১০০ টাকা নিয়মিত
সাহায্যের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।
সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ঃ নওয়াব ফয়জুন্নেছা বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নিজ জমিদারি এলাকায় ও এর বাহিরে ও প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন।
লাকসাম
থানা দাতব্য চিকিৎসালয় ঃ ১৮৯১ সালের ৮ ই আগষ্ট তার জমিদারির সদর
পশ্চিমগাঁও সংলগ্ন দৌলতগঞ্জ বাজারের পশ্চিম অংশে এটি স্থাপিত করেন। এটি
লাকসাম উপজেলা দাতব্য চিকিৎসালয় নামে বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে।
কুমিল্লা
জানানা হাসপাতাল ঃ ১৮৯৩ সালে স্বামী গাজী চৌধুরীর ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত
দক্ষিণ চর্থায় তিনি এই হাসপাতালটি স্থাপন করেন। কুমিল্লা সদর হাসপাতালটি
১৯২৯ সালে গোমতী নদীর পাড় (গাংচর) হতে দক্ষিণ চর্থার আলা সাহেবের বাড়ীতে
(বর্তমান সদর হাসপাতাল) স্থানান্তরিত হলে ১০/৭/১৯২৯ তাং এ ফয়জুন্নেছার
কন্যা বদরুন্নেছা এক হেবা দলিল
এর মাধ্যমে সরকারকে হস্তান্তর করে
‘জানানা ওয়ার্ড’ নামে নামকরণ করে। ০৫/১২/২০০৪ সালে জানানা ওয়ার্ডটি ভেঙ্গে
সরকার কতৃক পুনঃ নির্মাণ করে দিলে বর্তমানে ইহা ‘ফয়জুন্নেছা ফিমেল ওয়ার্ড’
নামে পুনঃ স্থাপিত হয়েছে।
দীঘি ও পুকুর খনন ঃ ফয়জুন্নেছা তার ১৪টি
জমিদারি মৌজার ১১টিতে দীঘি কোথাও পুকুর খনন করে দিয়েছেন। পশ্চিমগাঁও এ তারই
নির্মিত মসজিদের পাশে মুসল্লিদের সুবিধার্থে একটি পুকুর ও পশ্চিমগাঁও এ ই
চারঘাট বিশিষ্ট বিশাল আকারের গোল পুকুর খনন করে দিয়েছেন।
মসজিদ স্থাপনঃ পশ্চিমগাঁওয়ে নিজ জমিদার বাড়ীর পাশ্বে মোঘল স্থাপত্যকলায় সুদৃশ্য জামে মসজিদ নির্মাণ।
মুছাফিরখানা স্থাপনঃ পশ্চিমগাঁওয়ে নবাব বাড়ীর পুকুরপারে মুছাফিরখানা স্থাপন করে ছিলেন।
পুল নির্মাণঃ লাকসাম সদর ও পশ্চিমগাঁও এর সংযোগের জন্য ডাকাতিয়া নদীর উপর ‘সাম্মির পুল’ স্থাপন করেন।
দেশের বাহিরে সেবাদান ঃ ফয়জুন্নেছা দেশের বাহিরেও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও কার্যাদি করে গেছেন।
নহরে
যোবায়দা পুনঃ খনন ঃ ফয়জুন্নেছা ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ হজ্জব্রত পালন করতে মক্কা
শরীফ গেলে ও তিনি ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে হজ্জব্রত পালন করার কারনে এক বৎসর কাল
মক্কায় অবস্থান করেন। সে সময় তিনি আব্বাসিয় খলিফা হারুন অর রশিদ এর
স্ত্রীর নামীয় ‘যোবায়দা নহর’টি পুনঃ খনন করে দিয়েছেন।
মক্কায়
মুসাফিরখানা ‘রোবাত’ স্থাপন ঃ তিনি মক্কায় যোবায়দা নহর পুনঃ খনন করেই
ক্ষান্ত হননি, তিনি মেছফালায় একটি মুসাফিরখানা ‘রোবাত’ স্থাপন করেছিলেন। এই
স্থান দিয়ে আরাফাতগামী একটি রাস্তা নির্মাণের কারণে এর বর্তমানে আর
অস্তিত্ব নেই। নোয়াখালীর ক্বারী নুরুল হুদা এর সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন।
পত্র পত্রিকায় পৃষ্ঠপোষকতা ঃ তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বান্ধব’
পত্রিকা, ‘মুসলমান বন্ধু’ ঢাকা প্রকাশ, সুধাকর ইত্যাদি পত্রিকা সমূহকে
নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
সমকালীন সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ ঃ তার
সমসাময়িক সাহিত্যিকদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। আনন্দ স্বামীর জামাতা জিলা
স্কুলের প্রধান শিক্ষক দ্বিজ দাস দত্ত, পন্ডিত পূর্ণচন্দ্র কাব্য তীর্থ,
পন্ডিত রেণুধর তর্ক তীর্থ এদের সাথে ফয়জুন্নেছার ঘণিষ্ট যোগাযোগ ছিল।
ফয়জুন
গাঠাগার ঃ ফয়জুন্নেছা তার ‘নবাব ফয়জুন্নেছা’ হাউজ সংলগ্ন স্থানে গড়ে
তুলেছিলেন ফয়জুন পাঠাগার। এই পাঠাগারের নিত্য দিন রুটিন মাফিক কয়েক ঘন্টা
করে সাহিত্য সাধনা করতেন।
রূপজালাল রচনা ঃ ফয়জুন্নেছার কাব্য সাধনার
অমর সৃষ্টি ‘রূপজালাল’ কাব্য গ্রন্থ। তিনিই বাংলায় প্রথম মহিলা কবি যার
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ফয়জুন্নেছার জীবনের হাসি, কান্না, সুখ,
দুঃখের কাহিনী রূপক বর্ণনা এই কাব্যগ্রন্থ। ‘রূপজালাল’ ১৮৭৬ সালে ঢাকা
গিরিশ মুদ্রাযন্ত্র থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পর ১০৮ বৎসর যাবৎ
‘রূপজালাল’ ঘুমিয়ে ছিল। এরপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লার এম.এ কুদ্দুস
সাহেব বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে উদ্ধার করে বাংলা একাডেমীর মাধ্যমে প্রকাশ করলে
রূপজালাল সূর্য্যরে মুখ দেখে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমগাঁও এ রূপজালাল
প্রকাশনার শতবর্ষ পালিত হয়েছে। ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমী রূপজালাল পুনঃ
প্রকাশ করেছে।
বিশ্ব ব্যাপি নারী মুক্তি আন্দোলন ও সমাজ সংস্কারে যে সকল
নারীর অবদান রেখেছেন। তারা প্রত্যেকেই সুনিদৃষ্ট ভাবে কোন একটি বিষয়ে উপর
অবদান রেখেছেন। তবে ফয়জুন্নেছা ছিলেন এর ব্যতিক্রম। ফয়জুন্নেছা
কার্য্যক্রম ছিল ব্যাতিক্রম এবং বিস্তৃত। এই বিষয় টি গ্ররুত্বের সাথে নিয়েই
ফয়জুন্নেছা কে প্রকৃত্ত অর্থে মূল্যায়ন করা আজ সময়ের দাবি।
লেখক ও গবেষক