ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
যে সাফল্যে ‘এক’ হলো পুরো বাংলাদেশ
Published : Thursday, 22 September, 2022 at 12:00 AM
যে সাফল্যে ‘এক’ হলো পুরো বাংলাদেশ
সকালের রোদের মসৃণ ভাবটা তখন নেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে রোদের উত্তাপও বাড়ছিল। তখন থেকেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবাদকর্মীদের ভিড়। সাফজয়ী বাংলাদেশ নারী দল বেলা পৌনে দুইটায় নেপাল থেকে দেশে ফিরবে। তাদের প্রত্যাবর্তনের গল্পটা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই সংবাদকর্মীদের এ জটলা।

তখনো সাধারণ মানুষের ভিড় ঠিকমতো জমেনি। দুপুর ১২টার দিকেই বিকেএসপির একটা দল এল দল বেঁধে। ক্রিকেট, জুডো, সাঁতার, ফুটবল—সব বিভাগের ছাত্রীদের ভিড় সেখানে। তাঁদের মুখে একটাই স্লোগান—‘বাংলাদেশ!’ ‘বাংলাদেশ!’

কিছুক্ষণ পর শোনা গেল বাঘের হুংকার। ‘বাঘ’ মানে ক্রিকেট মাঠের চেনা মুখ টাইগার শোয়েব আলী! ফুটবলের সাফল্য ক্রিকেট মাঠের চেনা মুখকে টেনে নিয়ে এসেছে বিমানবন্দরে। বিকেএসপির ছাত্রীদের মতো তাঁর মুখেও বাংলাদেশের আবহ সংগীত।

ঘণ্টাখানেক পর বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল তাসকিন আহমেদকে। জাতীয় ক্রিকেট দলের এই পেসার কদিন আগে সৌদি আরব গিয়েছিলেন ওমরাহ পালন করতে। আজ দেশে ফিরেছেন এমন দিনে, যে দিনটা বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকেরাও তাসকিনকে পেয়ে ক্যামেরা নিয়ে ঘিরে ধরেন।

সংবাদকর্মীদের জটলা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাসকিনও জানিয়ে যান নারী ফুটবলারদের অর্জনে নিজের খুশির কথা, ‘এটা আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় পাওয়া। অনেক খুশির বিষয়। আমি নিশ্চিত, ওরা সামনে আরও ভালো খেলবে ইনশা আল্লাহ।’

বিমানবন্দরের ভেতর চ্যাম্পিয়নদের অপেক্ষা বাড়ছিল তখন থেকেই। কখন আসবেন সাবিনা, মারিয়া, কৃষ্ণারা—সবার মুখে তখন একই প্রশ্ন। ওদিকে ভিআইপি গেটের বাইরে সমর্থকদের ভিড় বাড়ছিল।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বিমানবন্দরে পা ফেলার জায়গাও যেন গায়েব। সমর্থকদের ভিড়টা মূলত ছাদখোলা বাসকে ঘিরে জমেছিল। ‘চ্যাম্পিয়নস’ লেখা বিআরটিসি বাস ফুলে ফুলে সেজে নারী ক্রিকেটারদের অপেক্ষায়। বাসের আশপাশে থাকা মানুষের ভিড়, সাবিনাদের বরণ করে নিতে সবাই নেমেছেন রাজপথে।

বাংলাদেশের মেয়েরা সাফ ফুটবলের ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরেছেন, উন্মাদনা তো কাজ করবেই। কিন্তু সেটা যে এত বড় হবে, সেটি হয়তো নারী দলের খেলোয়াড়েরাও আঁচ করতে পারেননি।

ট্রফি উঁচিয়ে, গায়ে চ্যাম্পিয়ন লেখা রিবন জড়িয়ে মেয়েরা যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন অনেকের চোখমুখের অভিব্যক্তিতে ‘অবিশ্বাস’! গোলকিপার ঋতুপর্ণা চাকমা যেমন বলছিলেন, ‘আমরাও ভেবেছিলাম, অনেক মানুষ থাকবে (বিমানবন্দরে)। কিন্তু এত বেশি হবে, সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।’

অবিশ্বাস্যেরও তো একটা মাত্রা আছে। বিমানবন্দর থেকে চ্যাম্পিয়নদের ছাদখোলা বাস যখন বেরিয়ে এল, তখন সে মাত্রাও যেন ছাড়িয়ে গেল। রাস্তার দুই ধারে মানুষের ঢল তো ছিলই। বড় বড় ভবনের ছাদ, বারান্দায় দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন অনেকে।

চোখ আটকে গেল বিমানবন্দরের সংস্কারকাজে ব্যস্ত শ্রমিকদের কর্মকাণ্ড দেখে।

মেয়েদের ছাদখোলা বাস দেখেই কাজকর্ম বন্ধ করে সারিবদ্ধ হয়ে হাততালি দিতে থাকলেন সবাই। শামুকের মতো এগোতে থাকা বাসটা যতক্ষণ না পর্যন্ত দৃষ্টিসীমার বাইরে গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত চলল শ্রমিকদের অভিনন্দন। একই দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কর্মরত শ্রমিকেরাও।

সাবিনারাও হতাশ করেননি। ট্রফি উঁচিয়ে, হাত নেড়ে সাড়া দিচ্ছিলেন তাঁরা। অনেকে তো গানের তালে তালে নেচেছেন মন খুলে। ছাদখোলা বাসের পেছনেই সমর্থকদের একটা ট্রাকে বারবার বেজে উঠছিল ‘জ্বলে ওঠো, বাংলাদেশ’ গান। গানের কথাগুলোর সঙ্গে যেন পুরো আবহ মিলেমিশে একাকার, ‘লাল সবুজের বিজয় নিশান, হাতে হাতে ছড়িয়ে দাও।’

ক্রিকেট মাঠের ডিজে সাধারণত ওভারের ফাঁকে ফাঁকে এই গান চালিয়ে দর্শকদের চাঙা রাখার চেষ্টা করেন। কাল ফুটবলের সাফল্যে বাজল একই গান। শামুকের গতিতে এগিয়ে যাওয়া ছাদখোলা বাস আর রাস্তাভর্তি মানুষের হইচই দেখে মনে হলো, সাফল্যের জাদু বোধ হয় এটাই। সমাজের সবাইকে এক করে ফেলে মুহূর্তেই, বিকেএসপির সেই ছাত্রীদের দলটার মতো। ফুটবল, ক্রিকেট—খেলা যা–ই হোক, এ সাফল্য যেন পুরো বাংলাদেশের।

এমন ছবি বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে সচরাচর দেখা যায় না। স্মৃতি ঘেঁটে ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের কথা মনে পড়ল। আরেকটু পেছনে গেলে ২০১৮ মেয়েদের এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের শিরোপা জয়ের কথাও।

কিন্তু আজ যেন নিকট অতীতের দুটি বড় সাফল্যকে ছাপিয়ে গেল নারী ফুটবল দলের এ সাফল্য।ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মুকুট বাংলাদেশের মেয়েদের দখলে। আর সে আনন্দে মাতোয়ারা পুরো দেশ। আর সাফল্যবুভুক্ষু একটি জাতির জন্য এ যেন বিরাট এক পাওয়া।