ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বিভূতিভূষন: সাহিত্যের বিরল ব্যক্তিত্ব
Published : Wednesday, 14 September, 2022 at 12:00 AM
বিভূতিভূষন: সাহিত্যের বিরল ব্যক্তিত্বজুলফিকার নিউটন ।।
১২৪তম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধার্ঘ
চিত্রা নামের নদীটি শান্ত, নিস্তরঙ্গ, সুন্দর বয়ে যায়। লোহাগড়ার রাস্তাটা ধুলো আর ওড়ায় না, নড়াইলের আকাশে মেঘ জমে। আমরা নৌকোয়, ঝিরঝিরে হাওয়া গা জুড়োয়, স্রোতের তির-তির রক্তে অনুভব করি। যদি বৃষ্টি আসে? আমাদের শরীর উন্মুখ বৃষ্টির জন্য, সারা দিনের গরমের পর আসুক বৃষ্টি, উদ্দাম উতরোল, এখন, এখানে, খোলা নৌকোয়। সকালে চোখ মেলেই দেখি রোদে ভরে গেছে ঘর, তারপর রোদ তপ্ত হয়েছে, হাওয়া শুষে নিয়েছে, আমাদের বোধে এসেছে দহন, আমাদের শরীর দাহ করেছে রোদ, আমাদের পুড়িয়েছে, আমরা অসহায় হয়ে দেখেছি। সেজন্য সন্ধ্যায় নদীতে মেঘ জমতে দেখে খুশি হচ্ছে মন, চোখ; আহা নামুক বৃষ্টি, বাতাসে উড়ে যাক রাশ-রাশ পাতা, নারকেল তাল আর সুপুরি গাছ হাওয়ার সঙ্গে উড়ে যেতে থাক, যত দূরে যেতে পারে বিভূতিভূষণের কল্পনা ছাড়িয়ে।
এটা নাকি বিভূতিভূষণের এলাকা, তাঁর নানা উপন্যাসের বীজ এখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করেছেন। এভাবেই বিভূতিভূষণের প্রত্যাবর্তন হতে থাকে আমার মধ্যে। তিনি এবং তাঁর চরিত্র সকল উঁকি দিতে থাকে দু’পাড়ের অন্ধকার বাড়ি-ঘর খেত-খামার থেকে জোনাক পোকার মতন। উত্তেজনাহীন, মানস সংঘাতহীন, যেন তারা প্রকৃতির বিভিন্ন নাম, কিংবা প্রকৃতিই তাঁর চরিত্র, তাকে তিনি আবিষ্কার করেছেন। এই আবিষ্কারে অসহায়ত্ব, বিড়ম্বনা, লজ্জা, ক্ষোভ, ঘৃণা, আর্তি সবই আছে, সব মিলিয়ে একটা ঘোষণা : মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃতি নষ্ট হয়। প্রকৃতি তাই মানুষের শৈশব, কিংবা অরণ্য কিংবা নদী; অনন্দ ও নিরবধিতেই তার তুলনা, মানুষ এ সবের পটে কাজ করে, রক্ত-মাংসের বোধ নিয়ে ক্রিয়াশীল, কিন্তু প্রকৃতিই স্থায়ী, সনাতন ও শান্তি।
কিন্তু প্রকৃতিতে যে ডোমের গন্ধ লেগেছে বিভূতিভূষণ কিছুতেই মানেননি। ডোমেরা হাত বাড়িয়ে প্রকৃতি লুণ্ঠন করছে, প্রকৃতির মধ্যে তৈরি হচ্ছে প্রলয়ঙ্কর হুঙ্কার, তাই প্রকৃতি উন্মত্তের মতন চিৎকার করে অধুনা আর এই চিৎকার না-আতঙ্ক, না-আনন্দ, না-আহ্বান, কিংবা এই সকলের সম্মিলিত ফল, আর মানুষ সচকিত হয়ে শোনে এই সম্মিলিত গীত, বিভূতিভূষণ এই গীত শুনেছেন, কিন্তু বিরত থেকেছেন তার প্রকাশে। তিনি চেয়েছেন বোধে, ভাষায়, লেখার গোটা প্রক্রিয়ায় মাটি নদী চিত্রা পরগনার বাংলাদেশ মুঠোর মধ্যে ধরতে। এই পরগনা চিন্তাভাবনা সৌন্দর্য অনুভূতির একটি স্রোত, একটি সনাতন আবহ : লোকজন, জীবনযাপন, জীবনচর্যা, সংস্কৃতি গাছপালা পাখপাখালি প্রকৃতি ঐতিহ্যের মৌল পটভূমিতে স্থির, আর সেখানে দেশের ঐতিহ্যগ্রন্থী থেকে ছিটকে পড়া আমরা অনবরত যেতে চাই, যেন আমরা শৈশবের কিংবা ছেলেবেলার গভীর আস্তিতে ফিরে যেতে চাই, রক্তমাংসবোধে ধরতে চাই।
বিভূতিভূষণ আবার সরলরেখার মতন আস্তিক নন। তাঁর মধ্যে দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব সক্রিয়, তাঁর মনোভঙ্গি শিথিল ও অস্বচ্ছ, সহস্র জটিলতা তাঁকে ঘিরে ধরে, সেজন্য প্রকৃতি সম্বন্ধে কিংবা সনাতন সম্বন্ধে নিরঙ্কুশ আশাবাদ অথবা সান্ত্বনার নক্সা তাঁর কাছে খুঁজে পাওয়া দুরূহ। তাঁর অপু বড়ো হয়ে অস্বচ্ছ হয়ে যায়, তিনি অরণ্য ছেড়ে আসতে বাধ্য হন, জীবনে বেড়ে-ওঠা কঠিন, প্রকৃতিতে বাস করা অসম্ভব, তবু তাঁর মধ্যে আছে এক পরিব্রাজক, যিনি কোথাও বসে থাকতে ইচ্ছুক নন, সুযোগ পেলেই যিনি বেরিয়ে পড়েন, অন্য কোথাও, দূরে। তিনি চেয়েছেন সবকিছু স্বচ্ছ চোখে দেখতে, কিন্তু ‘দেখাকে’ তিনি দেখেছেন বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পর্ব হিসাবে। প্রকৃতি কিংবা মানব স্বভাব মানুষকে ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ, ধ্বংসপ্লুত করে তোলে; আবার প্রকৃতি কিংবা মানব স্বভাব মানুষকে উন্মোচিত, উন্মীলিত করে তোলে, সেজন্য তাঁর অপুরা সতত, সর্বত্র ছক থেকে বেরিয়ে যায়, বেরিয়ে যেতে থাকে। সীমিত জীবনযাপন থেকে সীমানাহীন জীবনযাপনের একটা মোহ তিনি আমাদের মধ্যে জাগিয়ে দেন, ফলে আমাদের বৃত্তের প্রথম যাত্রাবিন্দু ছেলেবেলায় ফিরে যেতে থাকি, আরণ্যক নিসর্গে ফিরে যেতে থাকি, ফিরে যেতে থাকি প্রাত্যহিকতা থেকে দূরে।
কিন্তু দূরে গেলেও, শৈশব কিংবা নিসর্গে, অন্যায় দারিদ্র্য দুঃখের মধ্যে আমরা অস্তিত্বমান হয়ে থাকি। আমরা একা নই, আর আমরা বাকি মনুষ্যজাতি থেকে অন্ধ কিংবা বধির হয়ে নিজেদের মধ্যে মগ্ন থাকতে পারি না। আমাদের শৈশব নিসর্গ নদী পাহাড় এভাবেই অন্যায় দারিদ্র্য দুঃখ আক্রান্ত হয়ে যায়। আমরা পালাতে গিয়েও ফিরে আসি, ফিরে আসতে বাধ্য হই রক্তাক্ত শৈশবে ঠিকেদারের নিসর্গে মহাজনের নদীতে আমলার পাহাড়ে। রক্ত ছলাৎচ্ছল করে, নিসর্গ ছিনতাই হয়ে যায়, নদী নিলামে ওঠে, আর পাহাড়ে কেনাবেচার আড়ত হয়। কে বা কাহারা প্রকৃতিতে, সরল অভিজ্ঞতাকে দাড়িপাল্লায় তুলে বিকিয়ে দিতে থাকে, কে বা কাহারা সকল অভিজ্ঞতার মধ্যে বিচ্ছেদ আনে।
বিভূতিভূষণের অনুভূতিমালার মধ্যে এই সব বোধ কাজ করে। কিন্তু তিনি দুঃখ আর্তি যন্ত্রণা বোধে ধরার পরও মূলে, গভীরে যান না। তাঁর শত্রু অনির্দিষ্ট, শত্রুকে চিহ্নিত করার বদলে তাকে ছত্রাকার করে দেন অরণ্যে নদীতে পাহাড়ে, যে কেবল উঁকি দেয়। সেজন্য আমরা যখনি তাকে পড়ি, তিনি আমাদের তুষ্ট করেন, কিন্তু সব সত্ত্বেও এক ধরনের অসন্তোষ তাঁর বিরুদ্ধে তৈরি হতে থাকে। তিনি কি পারতেন না দুঃখ কিংবা আর্তি অথবা অন্যায় নির্দিষ্ট করতে? তিনি কি পারতেন না দুঃখ কিংবা আর্তি অথবা অন্যায় ব্যক্তির অস্তিত্বে গেঁথে দিতে? জানি তিনি পারতেন, কিন্তু তাঁর চেতনা গড়ন ভিন্ন, সেজন্য তাঁর ধ্যে জাগতিক সাংসারিক মানবিক বিভিন্ন বোধ উঁকি দেয়, তিনি সে-সব গ্রথিত করেন না। এমন চেতনা ছোট অথবা খারাপ, এ কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু তাঁকে যুক্ত করে দিতে চাই তাঁর ঐতিহ্যের সঙ্গে।
বিভূতিভূষণ এসেছেন কলোনীর বাঙালি গ্রামীণ ঐতিহ্য থেকে। সেই ঐতিহ্য তাঁকে নিবিড়ভাবে সংলগ্ন করেছে গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে, এই ঐতিহ্যের কাছ থেকে তিনি সমর্থন পেয়েছেন তাঁর চেতনার পরিসর তৈরির প্রসঙ্গে। সেজন্য শ্রেণী, সংস্কৃতি, দুঃখ, দারিদ্র্য তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিকভাবে, ব্যক্তিক সত্তার সমস্যা থেকে অবিচ্ছিন্ন হয়ে। তাঁর বিশেষ সামাজিক রূপান্তর যেন আধার সমাজ সংগঠনের বৈপরীত্যের গ্রাম/শহর, অঞ্চল/কেন্দ্র, গ্রামীণ চাষা ভুষো/শহরের বাবু; সেজন্য তাঁর মধ্যে কাজ করে গ্রামীণ সমাজবোধের পারস্পরিক সহমর্মীতা, নৈতিক মূল্যবোধ, এ সবের মধ্যে তিনি বেঁচেছেন, তিনি অভিজ্ঞ হয়েছেন। এভাবে তিনি গ্রাম আবিস্কার করেছেন, আমাদের উপহার দিয়েছেন জাঁকালো নৈতিক, প্রতীকী সরল ঐতিহ্য, সেজন্য তাঁর মধ্যে মানুষী কর্মতৎপরতার সমালোচনা অনুপস্থিত। কারণ তিনি যে ঐতিহ্যে গ্রথিত সেখানে এই সমালোচনা অবান্তর। তাঁর সমাজ রূপান্তরণের মধ্যে অন্তঃশীল তাঁর অনুভূতির কাঠামো: তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান গ্রামের বোধ বুকে করে, গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য তাই স্বাভাবিক, কিন্তু গ্রাম তাদের বুকের মধ্যে মাছের আঁশের মতন আমৃত্যু থেকে যায়, গন্ধ ছড়ায় : তার দরুন ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন হয় না, গ্রাম ও শহরের বিচ্ছেদ কলোনীর পটভূমিতে সোচ্চার হয় না, মানুষেরা সর্বত্র গ্রথিত থাকে এক সার্বজনীন অভিজ্ঞতায়। এই অভিজ্ঞতা গ্রামীণ অভিজ্ঞতারই সামান্যকরণ।
কিন্তু নিসর্গ/প্রকৃতি কি বিভূতিভূষণের কাছে গ্রামীণ বাংলার সামাজিক কাঠামোকৃত এক ভুবন? মনে হয় না। কারণ প্রকৃতি তাঁর কাছে ভাবাপ্লুত এক নৈতিকতার স্থান, সমাজতত্ত্বমূলক এক কানুন নয়। তিনি প্রকৃতিতে বার-বার ফিরে যান নেতিবাচক ভঙ্গিতে, সঙ্গে জড়িত মৃত্যু, শৈশবের প্রত্যাবর্তন, সমাজ থেকে দূরে অবস্থান, সেজন্য প্রকৃতি হয়ে ওঠে মৃত্যুজনিত ক্ষণ আশ্রয়, শৈশবের প্রত্যাবর্তনের দরুন নিসর্গ বোধ হয় নয়নাভিরাম, সমাজ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে তিনি, বিভূতিভূষণ সবকিছু দেখেন। এই দেখার ধরন রোমাণ্টিক নিঃসন্দেহে, মানবিক সন্দেহাতীতভাবে; আর তাঁর রোমাণ্টিক মানবিকতার কেন্দ্রীয় প্রতীক শৈশবের সরলতা, তিনি বার-বার, ফিরে-ফিরে এই সরলতাকে জটিল এক কাঠামোগত সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে সাবালক অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করেন। বালক বিচ্ছিন্ন, সে পৃথিবী, সমাজের শিকার, সে অক্ষম তার দেখার ধরণকে সামগ্রিক রূপ দিতে, সেজন্য সে প্রতিনিধি এক নৈতিক মূল্যবোধের কেন্দ্রের, কিন্তু এই কেন্দ্র, আবার নেতির প্রান্তবর্তী। বালকের নেতিবাচকতা বিভূতিভূষণের কলোনীর গ্রামীণ জীবনচর্যার সমালোচনাবিহীন মনোভঙ্গির ইঙ্গিতবহ, তিনি বাধ্য হন বার-বার অপর-বিশে^র নৈতিকতার মধ্যে বাসা খুঁজে নিতে, আর এই নৈতিকতা বালকের কলুষহীন ভালোত্বের মধ্যে অন্তরিত। বালকের অসহায়ত্ব তাঁর সামাজিক অবস্থানজনিত নির্যাতনের সূচি, সেই সঙ্গে বলীয়ান পৃথিবী থেকে তাঁর নির্লিপ্ততার ইঙ্গিতবহ। আবার বালক হয়ে ওঠে কেন্দ্র, এক নাটকের এক সংঘাতের যেখানে শৈশব সরলতা সততা ছিন্নভিন্ন ছত্রাকার, এভাবেই সমাজ যেন বিভিন্ন শক্তির নাটকীয় প্রক্ষেপক, যে-সব তাঁকে, বিভূতিভূষণকে পীড়িত করে সর্বক্ষণ, তিনি এই প্রক্রিয়ায় হয়ে ওঠেন শূন্য এক মঞ্চ যেখানে কলোনীর সামাজিক শক্তি দ্বন্দ্ব তৎপর। অপু অমন এক নেতিবাচক কেন্দ্র, তার দেখার ধরন ব্যক্তিক, আবার দেখার ধরনে অন্তরিত গ্রামীণ বাংলার শৈশব, কলকাতা, পাহাড়িয়া অঞ্চল; সে একই সঙ্গে দর্শক ও দৃশ্য, বাস্তব কলোনীর বাংলার সমাজ সম্পর্ক এক যাদুমন্ত্রে মায়াবী, নয়নলোভন, দুঃখ যন্ত্রণা দারিদ্র্য যেন নকশীকাঁথায় ঢাকা, তিনি এভাবেই বাস্তবকে স্বপ্নসদৃশ করে তোলেন। তাঁর কাজে তাই শৈশব সরলতার মাধ্যমেবানানো এক সামাজিক বাস্তবতা এবং অপর-বিশে^র নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যেকার বৈপরীত্যে উদ্ভাসিত। এই বৈপরীত্য, বস্তুত, বিভূতিভূষণের চেতনার কাঠামো, নোংরা রূঢ় কদর্য সমাজ বাস্তব অতিক্রমণ তাঁর দরকার, তিনি এই নোংরা পৃথিবী পেরিয়ে যান প্রথানুগ কলোনীর মধ্যবিত্ত নীতিবোধ ভর করে। ফল হচ্ছে তাঁর উপন্যাসের কাঠামোগত শিথিলতা। তাঁর পথের পাঁচালী-র দ্বিতীয় খণ্ডে কাঠামোগত ভাঙনের বীজ লুকানো, অপুর সরলতা নিরক্ততায় পর্যবসিত, সে অক্ষম তার অভিজ্ঞতাকে তাৎপর্যমণ্ডিত এবং আত্মসম্পর্কিত করতে, সেজন্য ঘটনা সব অভিজ্ঞতাকে আকার দেয় না, সম্পর্কিত করে না, ঘটনাবলি প্রবাহের মতন বয়ে যায়।
আমি একজন লেখক হিসেবে যখন এভাবে বিভূতিভূষণের কাজের মুখোমুখি হই তখন আমাকে বলতেই হয় তাঁর লেখায় অহংকার নেই। কিন্তু আমার কাছে লেখা অহংকার, আমার সম্মানবোধ। এই অহংকার, এই সম্মানবোধের বিরোধী যে-সমাজ তার সবকিছু আমি প্রশ্ন করি। লেখার এই ভার আমাকে সচেতন করে সবকিছু সম্বন্ধে। সেজন্য লেখা আমার কাছে আমৃত্যু এক সংগ্রাম, এক চ্যালেঞ্জ সমাজের বিরুদ্ধে, মনুষ্যজাতির বিরুদ্ধে। সমাজ আমার দেখার ধরন বদলে দিতে চায়, মনুষ্যজাতি আমাকে ক্ষুদ্র করতে চায়, কিন্তু আমার দৃষ্টিতে যে সবকিছু, সব গোপন, সব রহস্য, সব ক্ষমতার মূল উদ্ভাসিত, সেজন্য কোনো কিছু আমার কাছে পবিত্র, মহান কিংবা ঈশ^র নয় আর। যে-সমাজের আমি বাসিন্দা তার পরতে-পরতে প্রবিষ্ট আপস আর পলায়ন, বিভূতিভূষণ পালাতে চান অনবরত শৈশবে, অরণ্যে, সরলতায়; সেক্ষেত্রে আমি সম্মুখীন হতে চাই সকল বৈপরীত্যের, খুলতে চাই গিটের পর গিট। ঢেউয়ের মধ্যে যেমন সমুদ্র, তেমনি একজন লেখক, আমার মধ্যে এই যুগ, বিভূতিভূষণে এই যুগের বোধ শিথিল, ছিন্ন, কোনো ক্ষেত্রে একাকার।
আমি কি এতক্ষণ বিভূতিভূষণের মতাদর্শ সম্বন্ধে কথা বলেছি? শিল্প হচ্ছে কাজ, মতাদর্শ নয়, যদিও মতাদর্শের সঙ্গে শিল্পের বিশেষ ও নির্দিষ্ট সম্পর্ক আছে। শিল্প আবার জ্ঞান নয়, যদিও জ্ঞানের সঙ্গে শিল্পের বিশেষ ও নির্দিষ্ট সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক ভিন্নতর। শিল্প তাই আমাদের এমন কিছু দেখায়, অনুভব করতে শেখায়, যা কিনা বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। শিল্প আমাদের দেখায়, তার দরুন দেখানোর, অনুভবের ফর্মে বাস্তব আমাদের কাছে আসে, তা-ই মতাদর্শ; এভাবেই দেখা, অনুভব করা মতাদর্শ থেকে জন্মায়। এদিক থেকে বিভূতিভূষণের কাজ মতাদর্শের একটা ‘ভিশন’ আমাদের কাছে তুলে ধরে, যে-মতাদর্শের ইঙ্গিত থেকে আমাদের থেকে তাঁর কাজে মেলে, যে ‘ভিশনে’ উল্লিখিত একটা অভ্যন্তরীণ দূরত্ব, বাস্তব ও ব্যক্তির মধ্যে যে-দূরত্ব অবিরাম ক্রিয়াশীল। এভাবে তাঁর কাজ সকল আমাদের দেখায় ভেতর থেকে, অভ্যন্তরীণ দূরত্ব থেকে। বিভূতিভূষণ তাঁর কলোনীকালের গ্রামীণ বাংলার জ্ঞান আমাদের দেন না, তিনি আমাদের এই সময়ের পেটি বুর্জোয়া মতাদর্শের বাস্তবতা আমাদের দেখান, অনুভব করান। মতাদর্শে মানুষী অভিজ্ঞতা চালিয়ে যান, বিভূতিভূষণ এভাবে আমাদের দেখান গ্রামীণ সহমর্মীতার জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা, তিনি আমাদের কলোনীর গ্রামবাংলা সম্বন্ধে জ্ঞান দেন না; এই জ্ঞান প্রত্যয়ভিত্তিক যা তৈরি করে অন্তিম জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা, বিভূতিভূষণের কাজে মেলে তার বর্ণনা। সেজন্য, শিল্প, কাজের পক্ষে কি সম্ভব কলোনীর সম্পূর্ণ বোধ দেয়া, বিশ্লেষণ করে?
কিন্তু চিত্রা, এতক্ষণে, ঢেউয়ে মাতাল; নৌকায় ছলাৎচ্ছল ঢেউয়ের উদ্দামতা, বাতাসে উড়ে যেতে থাকে নারকেল আর সুপুরির ডাল-পালা, আহা বৃষ্টি আসে চিরকালের ক্ষান্তিহীন। দু’পাড়ের শান্ত সরল লজ্জা ভেঙে যায়, বেরোয় ক্রোধ, যন্ত্রণাদীর্ণ চেতনা, বল্লমের মতন বৃষ্টি বিধে দেয়, বিধে দিতে থাকে অস্তিত্বমান সনাতন। গ্রামের কৃষক কি চিরকাল দুঃখে মগ্ন থাকে, চুপচাপ থাকে খেতে না পেয়ে? সে সংঘবদ্ধ হয়, প্রতিবাদ করে, লড়াইতে নামে। লোহাগড়া-নড়াইল পরগণা, চিত্রার দু’পাড়ের গ্রাম সকল সনাতনের মধ্যে যোজনা করে অশান্ত উত্তালতা, থেকে-থেকে করেছে আবহমান, থেকে-থেকে করেছে দু’শ’ বছর, থেকে-থেকে করেছে গতকালও। ভাগচাষীর চিৎসারের মতন তীব্র বাতাস, গেরিলা যুবকের মুখের মতন মুখর অন্ধকার, কৃষক নেতার মর্মভেদী চোখের মতন স্রোত, কৃষক বধূর সতর্ক অস্তিত্বের মতন প্রকৃতি : বদলে যাচ্ছে, বদলায় বিভূতিভূষণের এলাকা আমাদের সংঘবদ্ধ শক্তির মধ্যে।