
স্বতঃস্ফূর্ত
নেতৃত্বের সাফল্য সেখানেই, যেখানে নেতারা জনমতকে শ্রদ্ধা করেন। ওপর থেকে
নিচে কিছু চাপিয়ে না দিয়ে বরং নিচ থেকে ওপরে উঠে আসা শক্তির ওপর ভর করে
প্রবাহিত হওয়া ক্ষমতার স্রোতকে স্বাগত জানানোই যথার্থ নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য।
আসন্ন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ
যাঁদের মনোনয়ন দিয়েছে, তাঁদের বয়স ও শারীরিক সক্ষমতাকে বিবেচনায় আনলে যে
কেউ উপলব্ধি করবেন, এখানে সেই নেতৃত্বের অনন্য বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতই
অনুপস্থিত।
কারণ, এই পদে আওয়ামী লীগ যাঁদের মনোনয়ন দিয়েছে, তাঁদের
বেশির ভাগই বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের গড় বয়স ৬৮
বছরের বেশি।
এর মধ্যে ৮০ বছরের বেশি বয়সী রয়েছেন ৫ জন। সত্তরোর্ধ্ব
রয়েছেন ২০ জন। স্থানীয়ভাবে তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘বঞ্চিত’ নেতা
হিসেবে পরিচিত। এই বঞ্চনার জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার মানসেই তাঁদের
মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে দলের নেতারা বলছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন
জেলা পরিষদ (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) বাদে বাকি ৬১ জেলা পরিষদের
নির্বাচন আগামী ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা ছাড়া বাকি ৬০
জেলায় আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে।
মাথায় রাখা দরকার, জেলা পরিষদে সাধারণ
ভোটাররা ভোট দেন না। উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন
পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এখানে ভোটার। দেশের বাস্তবতা হলো, এই
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত।
যেহেতু তাঁরাই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ভোট দেবেন, সেহেতু
আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া লোকেরাই প্রায় নিশ্চিতভাবে নিরঙ্কুশ জয়
পাবেন। তার মানে, জেলা পরিষদ প্রবীণ ও প্রৌঢ় নেতাদের নেতৃত্বে থাকছে।
ক্ষমতাসীন
দলের স্থানীয় যেসব নেতা দলের প্রতি অনুগত থেকেছেন কিন্তু সেভাবে মূল্যায়িত
হননি, সংসদ সদস্য হতে পারেননি কিংবা ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাঁদের
মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম, এমন নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ
স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্তর জেলা পরিষদকে কার্যত বয়স্ক ও বঞ্চিত
নেতাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র করা হয়েছে।
জেলা পরিষদ কার্যত একটি আলংকারিক
প্রতিষ্ঠানে রূপ নিলেও আইন অনুযায়ী, এটি জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম
পর্যালোচনা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ ১২ ধরনের
বাধ্যতামূলক কাজ করে। এ ছাড়া সাতটি ক্ষেত্রে ৬৮ ধরনের ঐচ্ছিক কাজ করার
সুযোগ রয়েছে। জেলা পরিষদগুলোর বরাদ্দও কম নয়। বয়স্ক চেয়ারম্যানদের পক্ষে
এসব কাজের চাপ সামলানো কঠিন।
জনগণের পরিষেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই
জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হয়। শুধু ব্যক্তির বঞ্চনাবোধকে প্রশমন করতে
গিয়ে সেই আসনে একজন অক্ষম ও অযোগ্য মানুষকে বসিয়ে দেওয়া কোনো বিবেচনায়
ন্যায্যতা পেতে পারে না।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে,
আওয়ামী লীগ যাঁদের মনোনীত করেছে, তাঁদের মধ্যে এমন লোকও আছেন, যাঁরা
স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন।
এমনিতেই জেলা পরিষদ
একটি অকার্যকর ও অথর্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার
মধ্যে এই প্রৌঢ় নেতৃত্ব সেই অসারতাকে আরও গভীর করবে। সে কারণে এই মনোনয়নকে
পুনঃপর্যালোচনা করাই বিধেয় হবে।