
সাম্প্রতিক
সময়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে।
বাংলাদেশের এমন অগ্রগতি সারা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। জাতি হিসেবে আমরা
গর্ব অনুভব করছি। অন্যদিকে যে বিষয়টি আমাদের সীমাহীন লজ্জায় ফেলছে, আমাদের
মাথা নত করে দিচ্ছে, তা হলো রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের লাগামহীন দুর্নীতি।
বিশেষজ্ঞরা
মনে করছেন, দেশে উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছে, তার সাফল্য অনেকাংশেই
ম্লান করে দিচ্ছে প্রশাসনের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। প্রশাসনের এমন কোনো শাখা
নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত এসব খবর আসছে। সর্বশেষ
সেই তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির
প্রতিবেদনে। তাতে দেখা যায়, রাষ্ট্রের সেবা পেতে ৭০.৯ শতাংশ খানা বা
পরিবারকে দুর্নীতির শিকার হতে হয়। আর ৪০.১ শতাংশ পরিবারকে সেবা পেতে ঘুষ
দিতে হয়।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের
অবস্থান ছিল নিচের দিক থেকে এক বা দুই নম্বরে। অর্থাৎ দুর্নীতিতে আমরা
ছিলাম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সেখান থেকে আমাদের সামান্য উন্নতি হয়েছে। আমাদের
অবস্থান ১৭-১৮ কিংবা কাছাকাছি থাকছে। দুর্নীতি রোধে বিচার বিভাগ, দুর্নীতি
দমন কমিশন (দুদক) এবং অন্যান্য দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার অব্যাহত প্রচেষ্টা
কিছুটা হলেও সুফল দিচ্ছে। কিন্তু সেসব প্রচেষ্টা অতি নগণ্য বলেই মনে করছেন
বিশেষজ্ঞরা। আর সে কারণেই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ২০টি দেশের মধ্যেই থেকে
যাচ্ছি। গত বুধবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে
টিআইবি দেশের দুর্নীতি সম্পর্কিত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০২০ সালের
ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত এই জরিপে উঠে
এসেছে, রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়ার জন্য গড়ে প্রতিটি পরিবারকে ছয় হাজার ৬৩৬ টাকা
ঘুষ দিতে হয়েছে। শহরের মানুষের (৩৬.৬%) তুলনায় গ্রামের মানুষকে (৪৬.৫%)
বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে। ২০১৭ সালের তুলনায় বর্তমান জরিপ সময়ে দুর্নীতির শিকার
হওয়া পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। সেবা প্রদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতার
অভাব দেখা গেছে। ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও তা পুরোপুরি কার্যকর
নয়। আর তারই সুযোগ নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি বহাল রাখা হয়েছে। এমন সংস্থা বা
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে—আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট,
বিআরটিএ ইত্যাদি। টিআইবির সেবা খাতে দুর্নীতি-২০২১ জরিপের ফলাফল অনুযায়ী
সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা। এখানে সর্বোচ্চ ৭৪.৪
শতাংশ পরিবারকে দুর্নীতির শিকার হতে হয়।
এরই মধ্যে সরকারি প্রশাসনের
কিছু অংশ থেকে টিআইবির এই প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অনেক
অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। আমরাও বলছি না টিআইবির প্রতিবেদন সর্বাংশে
সত্য। কিন্তু যাঁরা প্রশাসনের দুর্নীতির শিকার, সেই পরিবারগুলোর বক্তব্য
পুরো অস্বীকারও করতে পারছি না। অস্বীকার করতে পারছি না বিভিন্ন সময়ে
গণমাধ্যমে উঠে আসা দুর্নীতির প্রতিবেদনগুলো। তাই কেবল অস্বীকার নয়,
দুর্নীতির যে অভিযোগগুলো বা ধারণাগুলো তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো রোধে আরো কী
কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেদিকেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। দুর্নীতি রোধে
টিআইবি যে ১০ দফা সুপারিশ করেছে সেগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা চাই,
দেশ দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হোক।