
জুলিফিকার নিউটন ||
সব মহৎ রচনার মতো সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) উপন্যাস “চাদের আমারবস্যা”-রও সার্বকালিক ও সার্বজনিক গূঢ়ার্থ আছে, কিন্তু প্রথম পাঠেই আমার মনে হয়েছিল দরিদ্র, অনবিজ্ঞ, শূন্যস্বাস্থ্য, গ্রামবাসী, ‘বয়োতীত’ যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর কাহিনীতে বিশেষভাবে সমকালীন বাংলাদেশের আত্যন্তিক সংকটই উদ্ভাসিত হযেছে। অথচ কৌতূহলী হয়ে যাকেই প্রশ্ন করি তিনি বলেন “চাঁদের অমাবস্যা” এক দুর্বোধ্য উপন্যাস। এটির লেখক দীর্ঘকাল যাবৎ প্রবাসী হওয়ার ফলে দেশের বাস্তব অবস্থা বিষয়ে অজ্ঞ এবং অনবহিত, তাঁর অনাশ্রয় কল্পনা তৎকালীন পশ্চিমী সাহিত্যের অনুচিকীর্যু।
অথচ “চাঁদের অমাবস্যা” কোনও অর্থেই রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। উপন্যাসটির সংক্ষিপ্ত ভূমিকা থেকে জানা যায় যে এটির ‘বেশিরভাগ ফ্রান্সের আলপস পর্বত অঞ্চলে পাইন-ফার-এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে লেখা হয়।’ এটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ঢাকায় ১৯৬৪ সালে।
আরেফ আলি বিশেষ স্থানকালের বিশেষ একজন মানুষ। ‘কোপন নদীর ধারে ক্ষুদ্র চাঁদপারা গ্রামে তার জন্ম’, ‘দরিদ্র সংসার, হাতের তালুর মতো একটুকরো জমিতে জীবনধারণ চলে না’, ‘কষ্টেসৃষ্টে নিকটে জেলা-শহরে গিয়ে আই-এ পাশ করেছে’, ‘বযস বাইশ-তেইশ, কিন্তু তার শীর্ণ মুখে, অনুজ্জ্বল চোয়ালে বয়োতীত ভাব’, গ্রাম্যস্কুলের শিক্ষক, গ্রামের বড়বাড়ির কর্তা দয়াশীল ও ধর্মপ্রাণ দাদাসাহেবের আশ্রয়ে সে-বাড়ির বাইরের ঘরে তার বসবাস, মাইনে বাবদ যে-সামান্য টাকা পায় গ্রামে বুড়ি মায়ের হাতে দিয়ে আসে। কিন্তু একই সঙ্গে আরেফ আলি সব দেশের ভীত, সঙ্কুচিত, দুর্বল, অসহায়, কল্পনাপ্রবণ, অনুভূতিশীল, বিবেকী কিন্তু নিরুদ্যম, সহৃদয় ও ম্রিয়মাণ সাধারণ মানুষেরই প্রতিভূ। ওয়ালিউল্লাহ-র মহত্ত্ব এইখানে যে সংকটাক্রান্ত আরেফ আলীর আর্ত অপহ্নবের প্রয়াসকে তিনি যেমন দুর্লভ নিপুণতায় অপাবৃত করেছেন, তেমনি পরিশেষে তার অনভিভাবনীয়, অঘোষিত, প্রত্যাশারিক্ত, শঙ্কাদীর্ণ দায়িত্ববোধের অনাদৃত প্রকাশকেও আমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস্য করে তুলেছেন। ওয়ালিউল্লাহ সার্থক শিল্পী ও যথার্থ মানবতন্ত্রী।

‘চাঁদের অমাবস্যা”-র আখ্যানিক পরিণাহ মোটামুটি এই মতো: শীতের এক উজ্জ্বল জ্যোৎøারাতে আরেফ আলী ‘শারীরিক প্রযোজনে’ ঘুম ভাঙলে আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। শিক্ষকতা করা সত্ত্বেও তার মনে ‘জ্যোৎøারাতের প্রতি আকর্ষণ’ এখনও পর্যন্ত ‘অদমনীয়’। তার মনে হয় এত সৌন্দর্য অর্থহীন নয়, তা মহারহস্যের ইঙ্গিতবাহী, এই রকম রাতে ‘বিম্বভূমন্ডল রহস্যময় ভাষায় কথালাপ করে’। কিন্তু এ সব ভাবনা সে গোপন রাখে। সে নিঃসঙ্গে, বন্ধুহীন। শারীরিক প্রয়োজন মিটিয়ে ঘরে না ফিরে সে দাঁড়িয়ে জ্যোৎøার রূপ দেখে। সেই সময় তার চোখে পড়ে যে তার আশ্রয়দাতা আলফাজউদ্দিন চৌধুরী বা বড়বাড়ির দাদাসাহেবের ছোট ভাই কাদের চৌধুরী বাড়ী থেকে বেরিয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। কাদের নিষ্কর্মা, দিনের বেশিরভাগ সময় বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে থাকে, কখনও বা সারাদিন পুকুরধারে ছিপবড়শি নিয়ে কাটায়, কারও সঙ্গে মেশে না, হঠাৎ রেগে ওঠে বিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও বউয়ের উদাসীন, রাতে বেরিয়ে যায় এবং সকালে যখন ফেরে ‘তার মুখ ফ্যাকাসে রক্তহীন, কিন্তু চোখে অত্যুজ্জ্বল দীপ্তি অলৌকিক তৃপ্তি-সন্তোষ-ভাব’। দাদাসাহেব তাঁর এই অদ্ভুত প্রকৃতির ভাইটিকে নিজের পরিবারে ও সমাজে গ্রহণীয় করবার জন্য রটিয়েছে যে কাদের ‘দরবেশ মানুষ’, রাতে সে ‘বুজুর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়’। কথাটা তিনি নিজে ‘সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন, তা নয়’, তবে বিশ্বাস করতে চান, অন্তত অন্যদের বিশ্বাস করাতে চান, যদিও ছোট ভাইকে তিনিও আদৌ বোঝেন না।
জ্যোৎøালোকে কাদেরকে দেখে আরেফ কৌতূহলী হয়ে তাকে অনুসরণ করে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে হারিয়ে ফেলে। তারপর হাটতে হাটতে নদীর ধারে বাঁশবন থেকে সে চাপা ভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ভয় পেয়ে সে ‘হাততালি দিয়ে রাখালের মতো গোরুডাকা আওয়াজ করে ওঠে।’ পরক্ষণেই বাঁশবনে একটি মেয়েমানুষের সভয় চিৎকার এবং পাথরচাপা দেওয়া স্তব্ধতা-সাপের মুখে ঢোকা ব্যাঙের ঢাক হঠাৎ থেমে যাওয়ার মতো। অবশদেহ আরেফ শুনতে পায় বাঁশবন থেকে কে যেন সরে যাচ্ছে। মনে জোর করে এগিয়ে যেয়ে দেখে যে বাঁশঝাড়ের ‘আলো-আঁধারের মধ্যে একটি যুবতী নারীর মৃতদেহ, অর্ধউলঙ্গ, পায়ের কাছে এক ঝলক আলো’। বিভ্রান্ত অবস্থায় বাঁশঝোপ থেকে বেরিয়ে দ্রতপায়ে হাঁটতে আবার সে হঠাৎ দেখে সামনে দাঁড়িয়ে কাদের। আরেফ ‘কখনও বিজন রাতে বাঁশজাড়ের মধ্যে যুবতী নারী মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই।’ ‘সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে শুরু করে’। সে বাড়ি ফেরার পর শেষ রাতে কাদের তার ঘরে আসে, প্রশ্ন করে, আরেফ বাঁশবনে কী করছিল, কেন সে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আরেফ উত্তর না দিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কাদের ঘর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে যায়।
রাতের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সারাদিন আরেফকে ভাবায়, অভিভূত করে রাখে। সে ‘একটা গোলকধাঁধা ঢুকেছে যার আকৃতি-পরিধি কিছুই জানে না, যার অর্থ সে বোঝে না।’ নিজেকে সে বোঝাতে চেষ্টা করে বাঁশজাড়ের ঘটনাটি যতই বীভৎস হোক, সে নিজে ‘দর্শক মাত্র’, এই দৃশ্যের ‘পাপ-নৃশংশতা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না’। কিন্ত রাতে কাদের আবার তার ঘরে আসে, ‘যন্ত্রচালিতের মতো বিমূঢ়’ আরেফকে সঙ্গে নিয়ে যায়, বাঁশঝাড় থেকে মৃতদেহটি তুলে নদীর জলে ভাসিযে দেবার কাজে আরেফকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করে। আরেফ কাদেরের অন্ধকার মুখে দেখতে পায় আরেফের প্রতি তার ‘পরম ঘৃণার ভাব’। কাদের চলে যায়, আর তারপর থেকে শুরু হয় আরেফের নিজের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই।
আরেফ মনের অন্তঃস্থলে জানে কী ঘটেছে, কে খুনি, নিহত নারীর শব যে সে দেখেছে এবং সেই শব নদীর পানিতে বাসিয়ে দেওয়ার কাজে খুনিকে সে যে যত অনিচ্ছাতেই হোক, যত বিমূঢ় দশাতেই হোক, সহায়তা করেছে, এ সত্য প্রকাশ্যে স্বীকার করা তার অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব, এ কথা প্রকাশ না করলে ওই নারীর মৃত্যু অর্থহীন, এবং তার নিজের জীবনের শূন্যগর্ভতা অসহনীয়। অপরপক্ষে দাদাসাহেব এবং কর্তৃপক্ষের কাছে একথা বলবার অবশ্যম্ভাবী ফল কী তা নিয়েও তার মনে সন্দেহ নেই। দরিদ্র, নিরাশ্রয়, নির্বান্ধব মানুষ সে। তার আশ্রয গুচবে, চাকরিটি যাবে, দয়ালু শক্তিমান আশ্রয়দাতা তার শত্রু হয়ে উঠবে, কর্তৃপক্ষ খুব সম্ভবত তার কথা আদৌ বিশ্বাস করবে না, তার আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীরা তার এই সত্যকথনের সমর্থন তো করবেই না, উলটে তার নির্বুদ্ধিতার নির্দয় সমালোচনা করবে, তার আচরণের পিছনে কোনও কুৎসিত কারণ খুঁজবে। আরেফ জানে যে সে ‘ভীত, দুর্বলচিত্ত, অসহায় মানুষ।’ এখানে অন্তত সে নিরাপত্তা, বাসস্থান ও যত কম মাইনের হোক একটি চাকরি পেয়েছে। দাদাসাহেবের ‘øেহশীল ছাতার’ নীচে থেকে সে তার ‘জীবনে সর্বপ্রথম বেদনাদায়ক অভাব-অভিযোগটা যেন ভুলেছে’। মাকে মাইনের ‘টাকা দেবার সময় জীবনে এই প্রথম সে সুখবোধ করছে।’ অতএব আর পাঁচজনের মতো আরেফ আলীও নানাভাবে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে যে-ভয়ানক ঘটনা সে দেখেছে ভাবছে তা হয়তো আসলে এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন মাত্র, অথবা হয়তো কাদের সত্যিই দরবেশ এবং এই খুন সে করেনি, অথবা সংসারের অন্তহীন রহস্যের মতো এও এক রহস্য যার অর্থ তার অবোধ্য, অথবা হয়তো কাদেরের আচরণের পিছনে একটি স্বল্পভাষী, গোপনস্বভাবের প্রেমিকমানুষের অথবা হয়তো প্রচণ্ড প্যাশন এবং আত্মকর্তৃত্বহীন দিশেহারা আকস্মিক ভয় কাজ করেছিল, অথবা সত্য প্রকাশের দ্বারা কারও উপকারের সম্ভাবনা নেই, এবং আশ্রয়দাতা দাদাসাহেবকে তার দ্বারা নিষ্ঠুর আঘাত করা হবে, কাদেরের চরম শাস্তি হতে পারে, এবং তার নিজেরও সমূহ সর্বনাশ ঘটবে।
কিন্তু নিজেকে বিভিন্ন ‘কাল্পনিক অথবা’ দিয়ে নানাভাবে বুঝিয়েও সে না পারে আপন চেতনায় সত্যকে চাপা দিতে না পারে নিজের দায়িত্ববোধকে এড়িয়ে যেতে। শীতকালের শান্ত নিস্তেজ নদীতে স্টিমারের উজ্জ্বল সাদা সন্ধানী আলোয় মেয়েটির ফেঁপে ফুলে ওঠা বিবস্ত্র শব আবিস্কৃত হয়। জানা যায় মেয়েটি ওই গ্রামেরই করিম মাঝির বউ। কাদের নিজেই তার কাছে রাতের গোপনে দু’-এক কথায় স্বীকার করে যে, সে ভয় পেয়ে পারিবারিক সুনামের কথা ভেবে তার উপযাচিকাকে খুন করেছে। তার স্ফীত, রক্তবর্ণ, ঘুর্ণ্যমান চোখ দেখে আরেফের মনে কোনও সংশয়ের অবকাশ থাকে না যে ‘কাদেরের পক্ষে দরিদ্র মাঝির বউয়ের প্রতি কোনও ভাবাবেগ বোধ-করা সম্ভব নয়’। কাদের আবার রাতে এসে তাকে শাস্তির ভয় দেখায়। কোনও রকমের স্তোভ থেকেই আরেফ আলী শান্তির বা স্বস্তি পায় না। তাকে নিজের কাছে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে যে ‘আত্মরক্ষার প্রবল বাসনা’ থেকেই তার এই অধ্যবসায়ী আত্মপ্রবঞ্চনার উদ্ভব; ‘ভীতির নগ্ন চেহারা দেখে বিবেকের কণ্ঠস্বর স্থব্ধ হয়েছে’। কিন্তু যে মানুষ জীবিত থাকবার জন্য সত্যকে অস্বীকার করতে প্রস্তুত এবং নিহত নারীটির জন্য যার মনে সমবেদনার বোধ পর্যন্ত নেই সে ‘নামেই শুধু জীবিত’। আসলে তেমন মানুষ মৃত, তার জীবন ‘ধার করা জীবন’।
এতএব আরেফ আলী শেষ পর্যন্ত দাদাসাহেবের কাছে সত্যকথাটি নিবেদন করে, তারপর ‘বিসদৃশভাবে উঠে দাঁড়িয়ে’ তাঁর কাছে বিদায় নেয়। সে হাঁটতে শুরু করা মাত্র স্তম্ভিত বড়বাড়ি থেকে দাদাসাহেবের গুরুগম্ভীর ডাক আসে। ভীত আরেফ আলী তখন ছুটতে শুরু করে। থানায় গিয়ে সমস্ত ঘটনার কথা পুলিশকে জানায়। কিন্তু পুলিশ কর্মচারীটি তাকে ধমকায়, বাঘাগলায় বলে ‘চালাকি করতে চেয়েছিলেন,’ থুথু ছিটিয়ে আবার বলে, ‘কী, অপরাধ স্বীকার করতে রাজি আছেন’। তাকে ভয় দেখায় ‘আজগুবী কথা’ না ছাড়লে আরেফের নিজেরই ক্ষতি হবে বলে সতর্ক করে। তাকে মনে করিয়ে দেয় তার বৃত্তান্তের পক্ষে কোনও সাক্ষী নেই, সে নিজে কাউকে খুন করতে দেখেনি, কিন্তু যুবতীয় লাশের পাশে তার উপস্থিতি কাদের স্বচক্ষে দেখেছে। পুলিশের এ সব যুক্তিই আরেফ আগে থেকে জানে, তার কাজের ‘কী পরিণাম হবে, কেন হবে, কী কী ভাবে হবে-সে সব কথা উপলব্ধি করে তার ভীতির শেষ থাকে নাই। ....তা এমনই একধরনের ভীতি যা শরীরে কোথাও গভীর ক্ষতের মতো লেগে আছে, উপড়ানো যায় না, অস্বীকার করাও যায় না’। তবু সেই নারীর প্রাণহীন দেহের স্মৃতি তাকে তাড়িত করেছে, সত্যকে স্বীকার না করে, দায়িত্বপালন না করে, নিজে শাস্তি নিয়েও ওই মৃত্যুকে নিরর্থতা থেকে রক্ষা না করে তার পক্ষে মানুষ হিসেবে বাঁচা সম্ভব নয়। পুলিশ কর্মচারীর ব্যঙ্গ, অবিশ্বাস, ভয় দেখানো তার মনে কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। তার ‘গায়ের জীর্ণ আলোয়ানটি ঘরের উজ্জ্বল আলোয় অতিশয় জীর্ণ মনে হয়’।
আরেফের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিষ্ঠুর সত্য এবং প্রতিশ্রুতিরিক্ত দায়িত্ব-চেতনাকে এড়াবার জন্য তার আপ্রাণ চেষ্টা, সেই প্রয়াসের ব্যর্থতা, এবং ভয়ে, সঙকোচে, অন্চিছায় তবু ভিতরকার তাগিদেই তার আশাহীন সততার প্রকাশ-আসাম্য নিপুণতায় ধাপে ধাপে আরেফের আচরণ, কল্পনা, অনুভূতি এবং আত্মবিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে ওয়ালীউল্লাহ্ এ সব ফুটিয়ে তুলেছেন। জাতশিল্পী এবং নিঃসন্দেহে প্রতিবাবান হওয়া সত্ত্বেও হয়তো দীর্ঘদিন জন্মভূমি থেকে দূরে থাকার ফলে তাঁর বাংলা শব্দের কান যথেষ্ট শীলিত হবার সুযোগ পায়নি। শ্রুতিসুভগ ধ্বনি-বিন্যাসের চাইতে ব্যঞ্জিত বাকপ্রতিমা উদ্ভাবনে তিনি বেশি সিদ্ধহস্ত। কিন্তু “চাঁদের অমাবস্যা”য় তিনি যে-মানবীয় সংকটকে তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়রূপে নির্বাচন করেছিলেন এবং সেই গভীর ও জটিল, ব্যক্তিক ও সার্বিক বিষয়টিকে তিনি যেভাবে তীক্ষè অন্তর্দৃষ্টি ও সুবেদী কল্পনা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নিতান্ত দুর্লভ। অন্তত বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে যাঁরা স্বকিৃতভাবে তাঁর প্রধান পূর্বসূরী-বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও মানিক-তাঁদের উপন্যাসরাজিতে এই বিষয়টি এভাবে সার্থকতার সঙ্গে কোথাও পরিচিন্তিত ও পরিদৃশ্যমান হয়নি।
আরেফের সংকটাক্রান্ত অস্তিত্বের যেটুকু তার চেতনায় এবং আমাদের নজরে প্রত্যক্ষ, তার আড়ালে আরও অনেক দিকের ইঙ্গিত এই উপন্যাসে ছড়ানো আছে। আর আছে কিছু ছোট বড় চরিত্র, কেউবা দাদাসাহেব আর তার ভাই কাদেরের মতো জটিল এবং মোটা ও সরু দুরকম তুলির টানে আঁকা, কেউ বা আরবীর মৌলবী অথবা দাদাসাহেবের মেয়েপক্ষের নাতি আমজাদ বা একচোখেকানা কর্কশকণ্ঠ মুয়াজ্জিনের মতো স্কেচ মাত্র। ক্যানভাস বড় নয়, বিষয়টি বড়, এবং সেই বড় বিষয়কে পরিদৃশ্যমান করা হয়েছে অকম্প্য নিপূণতায়, গভীর অন্তর্দৃষ্টির সামর্থ্য,ে উদাত্ত কল্পনার স্বয়ম্ভরতায়। ওয়ালীউল্লাহর জীবনদর্শন সমকালীন ফরাসী অস্তিত্ববাদীদের ভাবনাচিন্তা থেকে কিছু গ্রহন করেছিল; কিন্তু তাঁর নিজস্বতা প্রশ্নাতীত। “চাঁদের অমাবস্যা”র জগৎ একদিকে স্বয়ংসিদ্ধ; অন্যদিকে তা বিশিষ্টভাবে ব্যক্তিসাক্ষিক, বাংলাদেশী, এবং আমাদের অধন্যতম সংকটেও প্রাসঙ্গিক। আমার বিচারে ‘চাঁদের অমাবস্যা” ওয়ালীউল্লাহর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম।