গল্প.
কালের চশমা

কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||
আহাদুল
ইসলাম কিছু ক্রয় করবে মনে করে ঘর থেকে বের হয়েছে। বের হওয়ার পর ভুলে গেছে
কী ক্রয় করবে। ইদানিং মন খুব ফাঁকি দেয়। আহাদুল ইসলাম চোখে কম দেখে। বয়সের
ভারে এখনো নত হয়নি। বড় ছেলের নিষেধ আছে ঘর থেকে বের হওয়ার। ঘরের সকলকে
অদেখাতে রেখে বের হয়ে পড়েছে সে। মনে সামান্য আনন্দ আছে। চলতে চলতে ইতোমধ্যে
দুইবার হোঁচট খেয়েছে। বৃদ্ধ বয়সের হোঁচট মেনে নিতে হয়। আহাদুল ইসলাম
ওভাবেই চলছে। তৃতীয়বার পড়তে পড়তে ওঠে দাঁড়ালো। এবার সে চারদিক দেখলো, কেউ
তাকে দেখছে কি না। পাশে দিয়ে একটা অটো রিক্সা সাঁই করে চলে গেছে। অল্পের
জন্য বেঁচে গেছে। অটোর আরোহী তার ড্রাইভারকে ধমক দিয়েছে। ড্রাইভার বলেছে,
‘এমন বুড়া লোক পথে বের হয়েছে কির লাই¹া?’
শেষ কথা আহাদুল ইসলাম
শোনতে পায়নি। অটো তাকে পাশে রেখে অনেকটা পথ চলে গেছে। চতুর্থ বা পঞ্চম বা
সপ্তম বারের সময় আহাদুল ইসলামকে এক তরুণ গফ্ করে ধরে ফেলে, বলে, ‘আপনি আহাদ
কাকা না, সাইফুল ভাইয়ের আব্বা।’
আহাদুল ইসলাম একবারে থতমত খেয়ে ওঠে।
‘ তুমি কে? কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তোমাকে তো সাইফুলের সঙ্গে কখনো দেখিনি, তোমার নাম কী?’
‘আমার
নাম আপনাকে বলবো। অবশ্যই বলবো। আপনি আমাকে সাইফুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখেননি,
ঠিক বলেছেন। আমি সাইফুল ভাই থেকে একটু দূরে দূরে থাকি। আপনার এ ছেলের
মেজাজা একটু গরম না?
‘ বাব্বা! তুমি আমার ছেলের মেজাজের খবরও জান দেখছি। আর কী জানো বল দেখি।’
‘
আমি অনেক কিছু জানি। এই যেমন আপনি ঘর থেকে বের হয়েছেন চশমা কিনবেন বলে।
কিন্তু ঘর থেকে বের হয়ে ভুলে গেছেন। কী কিনবেন মনে করতে গিয়ে বার বার
আনমনা হচ্ছেন আর কিছুক্ষণ পর পর হোঁচট খাচ্ছেন। অথচ আপনার পকেটে চশমার জন্য
ডাক্তারের প্রেসক্রিপসান। আপনে একটা ভুলুমনা।’
আহাদুল ইসলাম চলতে
চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। এটা হতে পারে না, একটা লোক , একটা তরুণ ছেলে বা
যুবক ছেলে তাকে নামতার মতো পড়ছে। আহাদুল ইসলাম ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে ছাগলের
ঘরে না ফেরার খুঁটির মতো করে দাঁড়ায়।
‘ তোমার পরিচয় না দিলে আমি তোমার সঙ্গে যাব না।’
‘ খোদার কসম করলাম আমি আমার নাম বলবো। শুধু একটু নিরিবিলি জায়গায় অথবা রবিনের চশমা দোকানে গেলে আমি আমার নাম বলবো।’
‘ আমি রবিনের চশমা দোকানে যাচ্ছি বা যাবো এ কথা তুমি কী করে জানলে।’
‘ আমি অনেক কিছু জানি, আপনি একটু ধৈর্য ধরলে জানতে পারবেন।’
‘ ঠিক আছে বলো।’
‘আপনি
কালো রঙের মোটা ফ্রেমের একটা চশমা কেনার জন্য সিদ্বান্ত নিয়ে আছেন। নিজে
চোখে ভালো করে না দেখলেও রবিনকে গিয়ে বলবেন এমন একটা চশমা দাও। এই চশমার
ভেতর দিয়ে আপনি শিল্পী শাহাবুদ্দীনকে দেখবেন। শিল্পীকে ফ্রান্সে পাঠানোর
ব্যবস্থা করা হচ্ছে, ঠিক বলছি তো?’
‘ বলতে থাকো শয়তান।’
‘ এই চশমার ভেতর দিয়ে আপনি আনিসুল হকের বাবা সিরাজুল হককে দেখবেন। দুজনকে এক নদীতে সাঁতার কাটছে দেখবেন। ঠিক বলছি তো?’
‘ একজন সিরাজুল হক, অন্যজন কে?
‘অন্যজন কে আমাকে বলতে হবে?’
‘
না না যুবক বলতে হবে না। তোমাকে বলতে হবে না। আমি সব দেখতে পাচ্ছি। তুমি
বলো একজন লোক এতোবার জেলে যায়, আর ঘুম থেকে ওঠে হরতন রুহিতনরা বলে তাদের
দেশ। জানো যুবক মহানন্দা নদীর পাড়ে সিরাজের হত্যার আয়োজনকারীদেও আমি দেখছি।
জানো যুবক মধুমতির পাড়ে বড় হওয়া সেই সিংহ.. .. যুবক আধুনিক ভদ্রতায়
অশ্রুবিসর্জন অশোভন হয়ে গেলো, তুমি আমার বুকে হাত দিয়ে দেখো, দেখছো কেমন
ধরফর করছে। গ্লুকোমা ছিল তাঁর । আর ছিল শামসুর রাহমানের। আমি তো সামান্য
নিম অন্ধ। বলো , তোমার কথা শোনি।’
‘ আপনি আসলে পূর্ণ অন্ধ হতে চান।
আপনি ঘরের সকল ওষুধ জানালা দিয়ে বাগানে ফেলে দিয়েছেন। চশমা আপনি কিনবেন না।
আর কিনলেও চোখে দিবেন না। কারণ আপনি নিজের উপর প্রতিশোধ নিতে চান। বিচার
হওয়ার পরও আপনি বিচারের দীর্ঘ বিলম্বের কারণ মানতে পারছেন না। এই বিলম্ব
এখানকার সব উলট পালট করে দিয়েছে।’
‘ তুমি শাহবুদ্দীনের সেই ছবিটা
দেখেছো, লুটিয়ে পড়ে আছেন তিনি। এই মাতৃভূমির প্রতি কে এমন হয়েছে আনত সমস্ত
জীবনের বিনিময়ে। আমাকে আশপাশে কোথাও নিয়ে চলো। আমি রবিনের দোকানে যাব না।
চশমা আমার লাগবে না। আমার মনে হচ্ছে সেই চশমা, কালো ফ্রেমের মোটা চশমাটা
আমার দু চোখের উপর বসে আছে।’
‘চলেন আমরা গোমতীর পাড়ে যাই।’
দুজনে
রিক্সা করে গোমতীর তীরে আসে। গোমতীর দক্ষিণ তীরের পানি মাপার ঘরটার
দুইদিকে বেহাই লতার ঘন পরত। মাঝখানের স্কেলটা লাপত্তা। নদী এখানে চরা হয়ে
গেছে। অগভীরও হয়েছে। গোমতীর সেই যৌবন নেই। রিক্সা এখানে ছেড়ে দিয়ে দুজনে
উত্তরমূখী হয়ে পাশাপাশি বসে। নদীর উত্তর দিক থেকে গরম বাতাস আহাদুল
ইসলামের নাকে মুখে লাগে। আহাদুল ইসলাম গোমতীকে মধুমতি মনে করে।
আহাদুল বলে ,
এই জল, জলের শরীর বেয়ে নদী থেকে নদী
সমুদ্র থেকে মহা সমুদ্রে নিয়ে যায় কালের ধ্বনি
এখানে বসে আছি আমি এক নিম অন্ধ
কে আমাকে নিয়ে যায় পেছনের সোপানে, বন্ধ
রোধির কারাগারে,
হতে চেয়েছিলাম পূর্ণ অন্ধ
তোমাকে দেখবো বলে সেইতো আছি পরে
কালের কাঁন্দনসহ এক কালো মোটা ফ্রেমে
আহাদুল ইসলাম শক্ত করে ধরে রাখে যুবকের হাতে। যুবকের নাম জানেতে চায় আহাদুল ইসলাম। ‘বলো তোমার নাম বলো?’
যুবক বলে, ‘প্রস্তুত হন। এখন আমি আমার নাম বলবো।’
আহাদুল বলে ‘আমি প্রস্তুত।’
যুবক বলে, ‘আমার নাম আহাদুল ইসলাম।’
নাম শোনে আহাদের হাত ফসকে যায়। আহাদ থেকে আহাদ ছুটে যায়।
পেছন থেকে আহাদুল ইসলাম ডাকে - এই আহাদ দাঁড়াও। দাঁড়াও বলছি।
আহাদ ডাকে আহাদকে ।
আহাদ দেখে আহাদকে।
কালের চশমার এমন হেকমত
মেঘের অনেক রং

আরিফুল হাসান ।।
আকাশের
পরতে পরতে মেঘ। মেঘের অনেক রং। মেঘ ভাঙে মেঘের সীমানা। দিগন্ত ছাড়িয়ে একটি
চিল ক্লিইইক, ক্লিইইক করে কেঁদে যায়। হাসিম ও আবু জয়নবের দোকানে বসে চা
খায়। মাটির খোরাটাকে সামনে এগিয়ে দিয়ে আবু বলে, কি হইছে জয়নব বু, চায়ে এত
কম চিনি দিলা? জয়নব নিঃশব্দে চায়ের খোড়াটা টেনে নিয়ে আরেকটু চিনি দিয়ে
নাড়তে থাকে। নাড়তে নাড়তে খোরা থেকে চা লাফিয়ে পড়ে প্লাস্টিকের ট্রে-টার
উপর। জীর্ণ ন্যাকড়া দিয়ে অন্যমনস্কের মতো মুছে তা। কাপটিকে ন্যাকড়ায় চেপে
ধরে তলার ফোঁটা ফোঁটা চা শুষে নিতে সময় দেয়। তারপর কেরোসিন স্টোভের আগুনের
দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কোথায় যেনো হারিয়ে যায় জয়নব। আবুকে চা-টা দিতে ভুলে যায়।
আগুনের আভায় জয়নবের মুখ টকটকে লাল রং দেখায়। এ রংটাকে ভয় পায় আবু, সে আর
দ্বিতীয়বার চা চাইতে দ্বিধা করে। কিন্তু হাসিমের তাড়া আছে। সে গলা খাকাড়ি
দেয়, জয়নব বু, চা-টা দিবা না? নিতে পারিস না, যত্তসব! Ñখেকিয়ে উঠে জয়নব।
জয়নবের
খুঁপড়ি চা’র দোকান থেকে বেরিয়ে হাসিম ও আবু নৌকার দড়ি ছাড়ে। হাতে বৈঠা
নিয়ে কাঁদাজলে কাঁজা দেয়। হুড়হুড় করে নৌকা নামে জলে। একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো
ভাসতে থাকে ভরা নদে। হাসিম গিয়ে নৌকার মাঝখানে বসে। নদীতে স্রোত প্রচুর।
ক্ষেতের ফসল বোধয় বাঁচানো যাবে না। কিন্তু এই চিন্তায় হাসিম ও আবু অস্থির
নয়। তারা অন্য একটি চিন্তায় মগ্ন। তাইলে কি জুলমত ফিরা আইবো? না না, তৌবা
তৌবা! এই খবর সত্যি যেনো না হয়। কিন্তু জয়নব বুবুর মুখ দেখে তাদের আর
অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। জয়নব বুরে প্রশ্ন করতে পারেনাই ঠিকই, কিন্তু
এই নদের মাঝখানে চড়ে, তারা তার যে মুখ দেখেছে তাতে আর সন্দেহ করার সুযোগ
নাই। Ñতাইলে, তাইলে আমাদের প্রস্তুতি লইতে হইবো। হ্যা, আবার, আবার। একবার
যখন মরতে মরতে জিতে গেছি। বানের জলকে ভয় পাই নাই। তাইলে আমাগোর মারনের
শক্তি নাই অশুরের। হাসিম ও আবু নৌকার মাঝখানে বসে শপথ নেয়।
আবুদের
নৌকাটা শিয়ালকাটা মোড় পেরুলে তারা দেখতে পায় বড় একটি ট্রলার চরের দিকে
আসছে। নানান রঙে রঞ্জিত ট্রলার দেখতে মনোহর। কে যায়? কে যায় এমন ট্রলারে
চড়ে? বোধয় নববধু হবে। কিন্তু চরের এমন কার শক্তি আছে ছেলের বিয়ার বৌ
ট্রলারে চাপাইয়া আনে? তাদের দ্বন্ধ লাগে। এক পর্যায়ে তাদের মনের মধ্যে একটি
সন্দেহ জেগে উঠে এবং পরক্ষণেই তা আতংকে পর্যবশিত হয়ে দপ করে নিভে যায়।
একটি সাহস তখন মেঘের ভেতর থেকে এক চিলতে রোদের মতো জ্বালিয়ে দেয়। বুক টান
করে চোখের উপর হাত রেখে ট্রলারটার ভেতরে দেখার চেষ্টা করে হাসিম। না, কাউকে
তো দেখা যায় না। শুধু শাহী ছইয়ের নিচে পুটলির মতো কি যেনো একটা পড়ে আছে।
আরেকটু এগুলো তার দৃষ্টিভ্রম কাটে। আসলে পুটলির মতো দেখতে যা ছিলো তা একজন
মানুষ। কেমন কুণ্ডুলি পাকিয়ে কুকুরের মতো শুয়ে আছে। হাসিমের একবার তাকে মনে
হয় মানুষ। আরেকবার মনে হয়, না মানুষ না, এটি আসলে একটি সাপ। পেঁচিয়ে
পেঁচিয়ে বিষ বিস্তার করছে। আবার মনে হয়, এটি সত্যি সত্যি কুকুর। বড়সড় কোনো
হিংস্র বিলিতি কুকুর। কিন্তু কুকুর না। আবু দেখিয়ে দেয়। Ñও....ই, আইছে! এতো
তাড়াতাড়ি দুঃস্বপ্নের মতো চলে আইলো? হাসিমের মাথায় ধরে না। Ñনা, এতো
তাড়াতাড়ি আইতে পারে না। হেয় তো পাকিস্তানে থাহে হুনছি। তাইলে ক্যামনে কী?
তাইলে জুলমত কি আগেভাগেই দেশে আইছিলো? আর ঘুঁপছি মাইরা ছিলো, যে রকম
শেয়াল-খাটাসেরা থাহেÑ সন্ধ্যে নামার পর থেকেই গেরস্তের ঘাটায়? হাসিম আবু
আবু নৌকাটিকে থামানোর চেষ্টা করে না। তারা জানে, শিয়াল খালি হাতে আইছে না।
আর একাও আইছে না। নিশ্চয় পাটাতনের নিচে আরও অন্তত জনাদশেক ষণ্ডাপাণ্ডা আছে।
তাদের অনুমান সত্য হয়। পিঁপড়ের মতো একজন লোক পেছনের দরজার কাছে পাটাতনের
নিচ থেকে ভুতুরে মুখ বের করে। হ্যা, হাসিম তারেও চিনে। কাইদরা! কসাই
কাইদরা! হাসিমদের একবার ইচ্ছে হয় নৌকার মুখ ঘুরিয়ে আবার চরের দিকে যাত্রা
করে। কিন্তু না, এই অবস্থায় গেলে শুধুমাত্র জান দেওয়া ছাড়া আর কোনো ফলাফল
হইবে না। তারা নৌকার মুখ ঘুরায়, ঈষৎ। তারপর একটু দূরত্ব রেখে অতিক্রম করে
জুলমতের ট্রলারটি। আবুর বৈঠাটি হঠাৎ অকারণে জলে ভেসে যায়। লগি হাতে হাসিম
সেদিকে নৌকা চালনা করে।
একটা মেঘখণ্ড ভেসে যাচ্ছে স্বপ্নচরের কাছে।
হাসিম আবু কবজিতে জোর পায় না। দু’ঘন্টার পথ তারা চার ঘন্টায় পেরোয়। তাহলে
কি খবরটায় আর মিথ্যে নেই? যেতে যেতে হিসাব করে, আইজ জয়নব বু’র কী হইবো! কী
হইবো স্বপ্নচরবাসীর! তবে যেমনটা ভাবা তেমনটা হয় না। জুলমত স্বপ্নচরে তেমন
কোনো নির্যাতন চালায় না। শুধু রাতের অন্ধকারে ঝাঁপলাগিয়ে জয়নব বুকে পুড়িয়ে
মেরে ফেলে। হাসিম আবু অবশ্য এতে খুশিই হয়। Ñহ, জয়নব বু, তোমার চইলা যাওয়াই
ভালা। অন্তত পিশাচেরা তোমারে বাঁচাইয়া রাইখা বারবার মারতে পারবো না।
যেমনটা
ভেবেছিলো তারা তেমনটা বাস্তবায়ন করতে পারে না। জুলমতের ত্রাস সকাল হওয়ার
পর থেকেই প্রকাশ হতে থাকে। সমস্ত চরে ছাগল গরু মিলিয়ে মাত্র তেত্রিশটা
গবাদি ছিলো। জুলমত পরদিন তেরোটি গরু কোরবানি দেয়। অবশ্য অর্থকড়ি সামান্য
গো-মালিকদের দিয়েছে। শোনা যায় সামান্য নয়, অসামান্যই দিয়েছে। প্রতিটা গরুর
চারগুন, পাঁচগুন দাম ধরে পাওনা মিটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তবু গো-মালিকরা তাদের
গরু জুলমতের খাদ্য হতে দিতে পারে না। তারা আশি গুণ লাভ পেলেও এ কাজে মন
থেকে সায় দেবে না। Ñদুুপুরে খাবারের আয়োজন, চরের সব মানুষকে দাওয়াত দিয়েছে
জুলমত। আপাতত ইস্কুল ঘরেই আছে জুলমত। তার চেলারা স্কুলমাঠে বড় বড় গর্ত করে
উনুন তৈরি করে। দাউদাউ আগুন বাতাসের সাথে দোলে মাটির ইস্কুলটার একটি অংশে
কালো দাগ ফেলে। কালো দাগ বড় হতে থাকে। পেতলের সসপেনে সিদ্ধ হতে থাকে
চরবাসীর পুত্রবৎ গরু। এমন উত্তাল গন্ধে চরের শিশুরা খুশি। তারা খাবার
পাইবে, তাও আবার গোশত দিয়া! এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। তারা লাফায়।
মোকলেস মিয়া ঠাস করে চর মারে পুত্রের গালে।
হাসিম আবুদের গ্রাম থেকে
স্বপ্নচর ছয় মাইল দূরে। এই বিশাল জলরাশির ভেতর একটা হাহা শূণ্যতা সর্বক্ষণ
বিরাজ করতে থাকে। হাসিমদের গ্রাম থেকে ছয়জন, আর স্বপ্নচরের বারোজন মিলিয়ে
মোট আঠারোজন গিয়েছিলো ভারত। জয়নব বু’র স্বামী হয় তাদের কমাণ্ডার। দেশে আসলে
ফুরিনপুর অপারেশনে জয়নব বু’র স্বামী মারা যান। গুলিটা করেছিলো জুলমত। আমরা
অবশ্য যুদ্ধে জিতেছি। জুলমত পালিয়ে বেঁচেছে। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু
শক্তহাতে ভাঙাদেশ গড়ায় লেগেছেন। আর এমন ক্ষণে হঠাৎ এমন দুঃসংবাদ, হঠাৎ করে
জুলমতের আগমন, সব কেমন ধাঁধার মতো ঠেকে। তারা রাতের অন্ধকারে ঘাটায় বসে
আলাপ করে, না, এই জুলমতকে এবার আর জান নিয়ে পালিয়ে যেতে দেবে না, পিতৃঘাতী
পিচাশদের কোনো মুক্তি নেই।