ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
নিজেকে ভালোবাসুন
Published : Saturday, 30 July, 2022 at 12:00 AM
নিজেকে ভালোবাসুনজুবাইদা নূর খান ||
শরীরের বিশাল ওজন নিয়ে যখন আমার পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে দোতলা পর্যন্ত ওঠাও কষ্টকর ছিলো, হাঁটু ব্যাথা, কোমর ব্যাথা ইত্যাদি নানাবিধ ব্যাথার ভারে যখন শারীরিক - মানসিক দুটোরই অত্যন্ত বেহাল দশা ছিলো তখন কোনো এক বিকেলে জনৈক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই ; ব্যাথা নিরাময়ের পাশাপাশি ওজন কমানোর ঔষধ প্রদানের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করি। উক্ত চিকিৎসক আমাকে উত্তরে বলেছিলেন --" নিজেকে ভালবাসুন।"
ঔষধ প্রদানের পরিবর্তে এহেন নীতিবাক্যে আমি যারপর নাই বিরক্ত হয়েছিলাম। কিসের মধ্যে কি?
চাইলাম কি? আর দিচ্ছেনইবা কি? প্রচন্ড হতাশ হয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, " আপনি ঔষধ না দিলে আমার বয়েই গেলো! ইন্টারনেট আছে না!"
ঔষধ প্রাপ্তির গোপন উৎস আবিষ্কারে বলতে গেলে তখন আমি একটু উচ্ছ্বসিতই বোধ করছিলাম। তবে সেটা প্রকাশ না করে করুন মুখে চিকিৎসকের দিকে যখন তাকিয়ে ছিলাম, তিনি আবার বলতে শুরু করলেন -" প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটুন; ওজন কমান; ঔষধ লাগবেনা; ঔষধ তো ভালো জিনিস নয়।"
বাসায় ফিরে আসলাম। যথারীতি কষ্ট করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলাম। ব্যাথায় পা দুটো টনটন করছিলো। কাপড় বদল করে শরীর এলিয়ে দিলাম। সেই সময়গুলোতে আমি অল্পতেই ক্লান্তি বোধ করতাম এবং ঘন ঘন বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা বোধ করতাম। সেই বিশ্রামের এক ফাঁকেই চিকিৎসকের কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে লাগলাম। ভাবনার জগতের চারদেয়ালে একটি বাক্যেরই কেবল অনুরণন হচ্ছিল  -" নিজেকে ভালোবাসুন।" আর মনের অজান্তেই 'অনন্ত প্রেম' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  সেই লাইনগুলো পাঠ করছিলাম --

"তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার –
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।"

স্কুল জীবনে আমাদের পাঠ্যসূচিতে 'ভাব সম্প্রসারণ ' নামক একটি টপিক অন্তর্ভুক্ত ছিলো। একটি মাত্র লাইনকে আমরা সম্প্রসারিত করে ২/৩ পৃষ্ঠা লিখে ফেলতাম। সেদিনও ঐ চিকিৎসকের একটি মাত্র বাক্য আমাকে চিন্তার অতল সাগরে ডুবিয়ে দিলো।সত্যিই তো! আমরা কত কিছুই না ভালোবাসি! ভালোবাসার মানুষ,  ভালোবাসার উপকরণের জন্য আমরা কী না করি! যেমন আমরা আমাদের সন্তানদের ভালোবাসি। সন্তানের মঙ্গলের জন্য নিজের আরাম- আয়েশ ত্যাগ করি। কারণ, ওদের দেখভালের দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমাদের উপর। সন্তানের সফলতা আমাদের হাসায় ; তদ্রূপ ওদের কষ্টও আমাদের কাঁদায়। পিতামাতা হিসেবে সন্তানের শারীরিক - মানসিক সুস্হতাকে কেন্দ্র করেই আমাদের চিন্তাজগতের আবর্তন।
তাহলে, আমার নিজের বেলায় আমি নিজে কেনো তৎপর থাকবোনা? আমার শরীর, আমার মন -- সকল কিছুর দায়িত্ব তো আমার। শরীর- মনকে ভালো রাখা, শরীরকে সঠিক আকৃতিতে রাখা, কর্মক্ষম রাখার জন্য তো আমি এককভাবে দায়ী। অনেক শখের একটা জিনিসকে আমরা যত্নে রাখি; ধুলোবালি মুক্ত রাখি; ধুয়েমুছে পরিষ্কার রাখি। দেখে প্রশান্তি অনুভব করি। আমার দেহায়বও তো এর ব্যতিক্রম নয়। এরও সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজন। স্নানের মাধ্যমে শরীরের বাহ্যিক কাঠামোটিকে আমরা পরিষ্কার করি; সজীবতা লাভ করি; সতেজ অনুভব করি। ঠিক তেমনি এর অভ্যন্তরস্হ বিষাক্ত অথবা অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলো বের করে দেয়ারও তো উপায় আছে। শরীরের ভেতরকার মেদ শুধু যে আমাদের ওজন বৃদ্ধি করে তা কিন্তু নয় বরং এটি বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ। আর এই সমস্যা থেকে মুক্তির একমাত্র এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন উপায় হলো কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে অতিরিক্ত মেদ ঝরিয়ে ফেলা।
সকালে আরামের বিছানা ছেড়ে ওঠা কষ্টকর হলেও যদি এটিকে অভ্যাসে পরিণত করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, এ প্রাতভ্রমণ শুধু  আমাদের শরীরেই ইতিবাচক পরিবর্তন আনেনি; বরং আমাদের মনের প্রশান্তিও বহুগুণে বৃদ্ধি করে। প্রত্যুষে প্রকৃতি নির্মল থাকে; কোলাহল মুক্ত থাকে। বাতাসের প্রতিটি ঝাপটায় স্বর্গীয় এক বোধ অনুভূত হয়। পাশাপাশি নানান পাখির কিচিরমিচির আমাদের কর্ণকুহরে এক অদ্ভুত লহরী সৃষ্টি করে। হাঁটার পথে দেখা হয় কতো পরিচিত - অপরিচিত জনের সাথে। কুশল বিনিময় হয়। কেউ হাঁটেন ধীর গতিতে; কেউবা হাঁটেন দ্রুততার সাথে; কেউ কেউ আবার দলবদ্ধভাবে জগিং করেন; কেউ আবার একাকী।
বোরখায় আবৃত করে কোনো ষাটোর্ধ নারী তসবিহ হাতে ধীরগতিতে হেঁটে যান; আবার বিপরীত দিক থেকে হয়তো কপালে- নাকে তিলক আঁকা কোনো রমনী মালা জপতে জপতে কী এক অদ্ভুত প্রশান্তি মুখে এগিয়ে যান। ২/৩ টা আলাদা আলাদা দল আবার ব্যায়ামের বিভিন্ন কসরত চালিয়ে যান ঘড়ির কাঁটা ধরে। ব্যায়াম শেষে তারা আবার সমস্বরে প্রাণ খুলে হাসেন। তাদের অট্টহাসিতে আকাশ - বাতাস প্রকম্পিত হয়। সকলের উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই -- ঘাম ঝরিয়ে শরীরকে কর্মক্ষম রাখা; সুস্হতার সাথে দিন অতিবাহিত করা। কেউ কেউ হাঁটা শেষে গোল হয়ে বসেন; বাদাম ভাগাভাগি করে খান; দেশ- বিদেশ, পরিবার নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেন।
একদিনকার ঘটনা। সকালবেলা এক মাকে দেখলাম স্কুল পোশাক পরিহিত ছোট্ট একটি শিশুকে কোলে করে হেঁটে যাচ্ছেন। শিশুটি তার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। সেদিন ঐ মায়ের মুখে যে মায়ার খেলা আমি দেখেছিলাম-- তা মনে হলে আমি আজও শিহরিত হই। মা তো এমনই। সন্তানের জন্য সকল কষ্ট তিনি অকপটে মাথা পেতে নেন।
আর একদিন। উদ্যানে দেখলাম একজন অশীতিপর বৃদ্ধ হুইল চেয়ারে বসে আছেন। সাথে তার ১৮/১৯ বছরের নাতি। সকালের রোদে বৃদ্ধ অচল দাদার আরাম হবে; দাদা কিছুটা হলেও ভালো বোধ করবেন -- এইসব ভেবে কিশোরটি দাদার পাশে বসে দাদার দেখভাল করছে। একটু পরপর দাদাকে বহনকারী হুইলচেয়ারটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে যাতে করে দাদার সমস্ত শরীর রোদ থেকে ভিটামিন গ্রহণ করতে পারে। অদেখা ছেলেটির পরিবার, তার বাবা- মায়ের প্রতি আমার অন্তরে শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলো। ক্ষনিকেই ছেলেটির প্রতি একটা মায়া জন্ম নিলো।
আজ আমি অনেকটাই ভারমুক্ত।  শরীরকে অনেকটাই মেদ মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। ঔষধ বিহীন, প্রায় ব্যাথা মুক্ত জীবন যাপন করছি। এখন আমি চাইলেই দৌড়াতে পারি। প্রাতভ্রমণ এখন আমার যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ। স্বামী বিবেকানন্দের সেই যে উক্তিটি --
"জীবে দয়া করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। "
আমি মর্মে মর্মে অনুধাবন করছি যে - নিেেজকে ভালোবাসলে অন্যকে ভালোবাসা সহজতর হয়।দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী, সমাজসেবী ইত্যাদি হিতকর কাজের জন্য শারীরিক সুস্থতা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

আমি হাঁটি একাকী। আমার সাথে চলে পাতা ঝরানো, মিষ্টি রোদ মাখা আঁকা-বাঁকা, সরু- সোজা  কত রকম পথ। এই পথ আমায় দেখায় কত জন! কত ফুল - ফল! কত পাখি! মাধবীলতার দোলে আমার কিশোরী বেলার কতো শত স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে। পথের ধূলিকণা, ছোট্ট ঘাসফুল, মাটির সোঁদা গন্ধ, মাথার উপর সাদা বকের সারি আমায় যেনো ফিসফিস করে বলে --
" হাঁটতে থাকো; আরো জোরে! আরো জোরে! কুড়িয়ে নাও জীবনের অমূল্য সব রতন; আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠো; স্রষ্টাকে খুঁজে নাও; হাঁটতে হাঁটতে অনন্তে লীন হওয়ার নির্ভীকতা সঞ্চার করো।"
আমি হাঁটতে থাকি আর মনে মনে গাইতে থাকি রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি -

"আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।।
কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে,
খুশি রই আপন মনে-- বাতাস বহে সুমন্দ।
সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,
শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা।
ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন মনে,
ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ।।"

লেখক:সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ