
দেশে
'জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২'-এর প্রাথমিক যে তথ্য বুধবার প্রকাশ হয়েছে, তা
বেশকিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জনশুমারিটি গত মাসের ১৫ থেকে ২১ জুন এমন
সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন সারাদেশে বর্ষাকাল। বর্ষাকালে বন্যাসহ আবহাওয়াজনিত
কারণে সব মানুষের কাছে পৌঁছা সহজ হয় না। অন্যদিকে শীতকালে এ ঝুঁকি থাকে
না। আমরা দেখেছি, জনশুমারি চলাকালে সিলেটসহ দেশের উত্তরাঞ্চল ছিল
বন্যাকবলিত। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে তথ্য সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হয়। যদিও সেখানে
জনশুমারির সময় বাড়ানো হয়েছিল, তারপরও প্রশ্নটি এড়ানোর সুযোগ সামান্যই। তা
ছাড়া আমরা দেখেছি, বর্ষা মৌসুমে এ শুমারি করতে গিয়ে ছাতা কেনা ও যোগাযোগে
অতিরিক্ত বরাদ্দের কারণে বাড়তি অর্থও গুনতে হয়েছে।
সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই যেমন লিখেছেন, তেমনি সাংবাদিকদের কাছেও অনেকে অভিযোগ
করেছেন, তথ্যের জন্য তাঁদের কাছে যাওয়া হয়নি। আবার কোথাও জনশুমারি কর্মীরা
গেলেও ঠিকভাবে তথ্য না নিয়ে চলে এসেছেন। জনশুমারি হওয়ার পর, জুন মাসের
শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী স্বীকার করেছেন, 'মানুষ গোনার
কাজে অবহেলা হয়েছে।' বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস পরিচালিত এ জরিপে
সাড়ে তিন লাখের বেশি গণনাকারী অংশ নিয়েছেন বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে
জানানো হয়। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে এবারের জরিপ নিখুঁত হওয়ার
প্রত্যাশা থাকলেও এসব প্রশ্ন উঠছে কেন? তাহলে কি গণনাকারী ও সুপারভাইজারদের
যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হয়নি? ১০ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হওয়া জনশুমারি ও
গৃহগণনায় যে দায়িত্বশীলতা ও সতর্কতা প্রদর্শন জরুরি ছিল; দুঃখজনক হলেও
সত্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আমরা জানি, দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য
জনগণের তথ্য জরুরি। দেশের প্রতিটি খানার সদস্যদের গণনা করে মোট জনসংখ্যা
নিরূপণ করা দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন। শুমারির তথ্যে
এটা স্পষ্ট, দেশে জনসংখ্যা বাড়ার হার কমছে। জনঘনত্বের দেশ হিসেবে জনসংখ্যা
বাড়ার নিয়ন্ত্রিত এ হার ইতিবাচক হিসেবেই আমরা দেখছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ
প্রায় সর্বক্ষেত্রে তার সুফল পাওয়া যাবে। যদিও জনসংখ্যার হার কমে আসার
কারণে জনমিতির সুবিধা সেভাবে পাওয়া যাবে না। জনসংখ্যা বাড়ার হার কমার যে
চিত্র এসেছে, তা স্বাভাবিক হলে সাধুবাদযোগ্য।
বুধবার যখন জনশুমারির
প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেশে সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার বিষয়টি প্রকাশ হয়, তাতে
অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে সঠিক চিত্র পুরোপুরি উঠে না আসার যে অভিযোগ
করছেন, তা একেবারে অবাস্তব নয়। যদিও এটি প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্য এবং
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস) দিয়ে জনশুমারি-পরবর্তী
যাচাই জরিপে জনসংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মনে আছে, বিগত
প্রতিটি জরিপেই যাচাইয়ের পর ৪ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বেড়েছিল। আমরা চাই,
বিআইডিএস দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একটি
যথার্থ পরিসংখ্যান হাজির করুক।
এবার ডিজিটাল জনশুমারি হওয়ার ফলে অল্প
সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক পরিসংখ্যান পাওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। জনশুমারিতে
জনসংখ্যার পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ যেসব তথ্য এসেছে তা জরুরি ছিল।
বিশেষ করে, আমরা দেখছি, দেশে সাক্ষরতার হার এখনও ৭৫ শতাংশ হয়নি। সাক্ষরতায়
নারীরা পিছিয়ে থাকলেও জনসংখ্যায় এগিয়ে। ধর্মের হিসেবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী
জনসংখ্যা কমার বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
'জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২'-এর
প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী যেভাবে বলেছেন, 'পৃথিবীর
কোনো পরিসংখ্যানই নির্ভুল নয়'- তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে পরিসংখ্যান
শতভাগ নির্ভুল না হলেও জনশুমারির মতো গুরুত্বপূর্ণ জরিপে শতভাগ আন্তরিকতা
নিঃসন্দেহে জরুরি। এবারের জরিপে যেসব প্রশ্ন উঠছে সেগুলো এড়াতে পারলে এ
জনশুমারি বিতর্কমুক্ত হতো। দেশব্যাপী জনশুমারির কাজ যেমন সময়সাপেক্ষ, তার
চেয়েও বেশি অর্থসাপেক্ষ। এটাও সত্য, এখানে অধিকাংশ কর্মী অস্থায়ী এবং বাইরে
থেকে নেওয়া হয়। বিবিএস যেহেতু নিয়মিত জরিপ কাজ পরিচালনা করে, সেহেতু
সংস্থাটির কাজে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বিষয় নয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের জরিপ
প্রশ্নমুক্ত করার স্বার্থে আমরা মনে করি, জনশুমারিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি করা প্রয়োজন।