
অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
বাবলুদা, হেলাল ও ফরিদউদ্দিন ছিদ্দিকী তিনজন জীবনের শেষাংশে বসতেন অমর পালের বাদুরতলাস্থ টাইপ স্কুলে। বয়সের অনেক পার্থক্য থাকলেও এবং প্রত্যেকের অন্য পরিচয় থাকলেও এক জায়গায় তাদের চেনার বিষয় ছিল তাঁরা তিনজনই সমাজসেবক। কুমিল্লা শহরের যে কোন লোকের প্রয়োজনেই তাঁরা সাড়া দিতেন সমভাবে সেটা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে। পরিচিতজন টাইপ স্কুলের সামনে দিয়ে যেতে তিনজনেরই কুশলাদি জিজ্ঞেসে অভ্যস্থ ছিলেন। করুনা মহামারীর খুব খারাপ সময়ে চলে গেলেন বাবলুদা এবং ব্রেন টিউমারে পূর্ব আক্রান্ত ফরিদউদ্দিন ছিদ্দিকী গেলেন তার কিছুদিন পর এবং তারও কিছুদিন পর চলে গেলেন কবি ও সংগঠক ফখরুল হুদা হেলাল। কবি হেলাল ও ফরিদউদ্দিন সিদ্দীকি দুজনেই সম্পর্কে আমার মামা হতেন। বাবলুদাও সবারই ছিলেন গুরু। হেলাল মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনজন শেষ বয়সে একসঙ্গে হলেন কেন? জবাবে হেলাল মামা বলেছিলেন কোন কাজ করতে এখন আরেকজনের সাহায্য লাগে এবং সেটা স্বার্থপর লোক দিয়ে না করিয়ে স্বার্থহীন লোক দিয়ে করাই উত্তম বিধায় তিন স্বার্থহীন লোক একত্রিত হয়েছি। তারপর আরেকটি বিষয় হচ্ছে মাঝে মধ্যে কবিতার আসর বসাতে টাইপ স্কুলের মত সুন্দর স্থান খোঝে পাওয়া মুশকিল। টাইপ স্কুলের পরিবার কবিতা পছন্দ করেন এবং নানাহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁরা অভ্যস্থ। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে আমার ও অন্যান্যের চিকিৎসা কর্মকাণ্ডে সিডি প্যাথ যেতে হয় ঐ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটি আমরা তিনজনেরই পছন্দের তাই টাইপ স্কুলকেই আমাদের অবস্থানের ঠিকানা হিসাবে নিয়েছি।

হেলাল মামা বৃহত্তর কুমিল্লার কৃতিসন্তন। ফখরুল হুদা হেলাল কবি, সংগঠক ও নাট্যকর্মী। চাঁদপুর জেলার মতলবের একলাসপুর গ্রামে ১৯৫৩ সনের ১লা সেপ্টেম্বর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই, দুবোনের সাজানো ছিল তাদের সংসার। অগ্রজ মাঈনুল হুদা হেলাল ছিলেন একসময়ের বিখ্যাত ছাত্রনেতা এবং কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক এবং অনুজ বদরুল হুদা জেনু কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুপরিচিত ক্রীড়া সংগঠক ও দূনীর্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার। সাংস্কৃতিমনা একজন খোলা মনের মানুষ ও তাঁর স্নেহময়তা কবিকে সকল মানুষ স্মরণ করবে চিরকাল। পরিচিত ছিলেন না এমন মানুষ কুমিল্লা শহরে পাওয়া কঠিন। খাদী পাজ্ঞাবী বা ফতুয়া গায়ে ভরাট গলায় আপন মনে ডাকতেন সবাইকে। যাকে যা বলতেন সামনেই বলতেন পিছনে বলতেন না এবং শহরের সবাইকে সমান চোখে দেখতেন। কাব্যর্চ্চার পাশাপাশি নাট্যর্চ্চাও একসময় চালিয়েছেন। “ক্রিধারা” শিল্প গোষ্ঠীর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, “রেনেসাঁ” নাট্যগোষ্ঠী ও “প্রগতি” নাট্যসংঘের উপদেষ্টাও ছিলেন কবি ফখরুল হুদা হেলাল। “অলক্ত” সাতিহ্য ম্যাগাজিনের তিনি ছিলেন একজন সংগঠক। “কুমিল্লা সাতিহ্য পরিষদ” “উজান” “উষসী” আমরা জ্যেৎস্নার প্রতিবেশী” সংগঠন সমূহের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। “অগ্নিঝড়ে পাখী”, “কথাবাজ”, “জাগরনী”, “বিনোদ”, “হিন্দোল” ও “বিনয় সাহিত্য সংসদের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিন নদী পরিষদের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। তাছাড়া “খেলাঘর”, “শাপলা শালুকের আসর”, সত্যসেনা, “মানবকল্যাণ সংস্থা” “স্পুটনিক”, “কচি কাঁচার মেলা” প্রভৃতি সংগঠনে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। “সে আমি তুমি” ছিল হেলাল মামার প্রতিষ্ঠিত একটি সাহিত্য সংগঠন। ১৯৭৭ সালে “প্রতিধ্বনি” নাট্য সংগঠনের নাটকে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৬ সনে আয়োজন করেছিলেন “কথকতা সাহিত্য পুরস্কার ও কবি সভা”। কুমিল্লার নাট্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের গুণীজন সংবর্ধনায় সম্মাননা স্মারক ও পদক গ্রহণ করেন। অনেক সাহিত্য পুরস্কার ও সাংগঠনিক পুরস্কার ভূষিত হয়েছেন আমাদেরই এই কবি। তাঁর কবি প্রতিভার জন্য বাংলা একাডেমি তাঁকে আজীবন সদস্য পদে অধিষ্ঠিত করেছেন।
কবি হেলালের কবিতার ভাষা ছিল অলংকারহীন, সহজ ও সর্বজন বোধগম্য। ছোট ছোট শব্দে তিনি গড়ে তুলতেন কাব্য। সর্বজনের অভিজ্ঞতা, মনোভাব ও রুচি তাঁর সঙ্গে মিলত। সততা ও নির্লিপ্ততায় তাঁর জীবন ছিল ভরপুর। নির্মমতা, সন্ত্রাস ও অন্যের ব্যাজ্ঞনা কখনোই তাঁর জীবনকে আশক্ত করতে পারে নাই। আগ্রহ আর উৎসাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষন। তাঁর সুললীত কন্ঠের আহ্বান সকলেরই আকর্ষন লাভে সমর্থ ছিল। বিচিত্র জীবিকা গ্রহন করার মধ্যে ও বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠের মধ্যে তিনি যেই অভিজ্ঞতা উপার্জন করেছেন তা দিয়ে তিনি অন্যকে উৎসাহিত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কৈশোর, গ্রাম্যজীবন ও রুচি নির্ভর মধ্যবিত্ততা দিয়ে যে গুনাবলী অর্জন করেছেন তা দিয়েই তিনি নির্ভয়ে আনন্দপ্রবল হয়ে শেষ জীবনটি অতিবাহিত করেছেন। কবিতায় প্রকাশ করেছেন আবেগ, কৌতহল ও অভিজ্ঞতা। অনেকেই তাঁর উত্তরসূরী হওয়ার চিন্তা করেছেন কিন্তু হতে পারাটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। চলার পথে তিনি যাদের সঙ্গী ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সৈয়দ আহমেদ তারেক, ফখরুল ইসলাম রচি, ডা: তৃপ্তিশ ঘোষ, শওকত আহসান ফারুক, ফরিদ মাজহার, আনোয়ারুল হক, হাসান ফিরোজ, আব্দুল ওয়াহাব, জহিরুল হক দুলাল।
শত সমাজকর্মের মাঝেও কবি তাঁর হৃদয়ের সততা ও সরলতা দিয়ে যোগাঢ় করেছিলেন একজন জীবন সাথী। কিন্তু সেখানেও একটি অপূর্ণতা ছিল- কোন সন্তান সন্ততি রেখে যেতে পারেন নাই এই দাম্পত্য জীবন। অভিমান করে অনেক আগেই চলে গেলেন তাঁর জীবন সঙ্গিনী। কবি আধুনিক ও সরল ব্যক্তিত্বে আটক ছিলেন বলেই আরেকটি জীবনসঙ্গীর খোজে নেন নাই। একা একাই কাটিয়েছেন স্ত্রী হারানো পরবর্তী দিনগুলি। হঠাৎ ২২শে এপ্রিল’২২ শুক্রবার সকাল সাতটায় কুমিল্লা সিডিপ্যাথ হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ধরাধাম ত্যাগ করে চলে যান নগরকবি ফখরুল হুদা হেলাল। তাঁর ছোট ভাই বদরুল হুদা জেনু অনেক কষ্ট করে পবিত্র রমজানের ঐদিনে জানাযার আয়োজন করেছেন টমসমব্রীজ কবরস্থানে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তাঁর মৃত্যুতে কুমিল্লা সাহিত্য অঙ্গনে ও সারা শহরে শোকের ছায়া নেমে আসে। কবি জীবিতকালে ৮টি কবিতার বই ও একটি কাব্যসমগ্র রচনা করে রেখে গেছেন। তাঁর নামাজে জানাজায় বিভিন্ন পেশার নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদসহ অসংখ্যা নগরবাসী অংশ গ্রহণ করেন এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। আল্লাহ তাঁকে বেহেশতের শ্রেষ্ঠতম স্থান নছীব করুন এটাই সকলের মানসকামনা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল