শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
আমরা ভাইবোন আটজন। বাড়িতে তিন বোন ও চারভাই এবং মা বাবা। দু'বোনের বয়স যথাক্রমে কুড়ি ও ষোল, ভাই আঠার। তাদের বাড়িতে থাকা বা রাখা খুবই বিপদজনক হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যেহেতু বাবা দেশত্যাগী হতে পারছেন না, তখন জুলাইর প্রথম সপ্তাহে তাদের ত্রিপুরায় পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিলেন। বর্ষাকাল, চার নৌকায় রওয়ানা হবে। এদিকে আমাদের গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দি থানার ২২ নং মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রাম। এ গ্রামটি কুমিল্লা -ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণে তিন মাইল ভিতরে। সে সময় রাস্তাটি চব্বিশ ঘন্টা কারফিউর আওতায়। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনি গাড়ি নিয়ে টহল দেয়। রাস্তার ব্রীজগুলো পাহারা দেয় রাজাকার। এ রাজাকারদের টাকা দিয়ে বশ করে এই চারটি নৌকা পার হওয়ার ব্যবস্থা হয়। রাস্তার দু'পার্শ্বে জলাজমি ও পাট ক্ষেত। কোনোভাবে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে যেতে পারলে পাট ক্ষেতের আড়ালে যাওয়া যাবে। রাজাকারদের সঙ্গে কথা হলো খুব ভোরে ব্রীজ পার হতে হবে। নির্ধারিত দিনে প্রথম ও দ্বিতীয় নৌকা পার হয়ে যায়। দ্বিতীয় নৌকায় আমার দু'বোন ও এক ভাই ছিল। তৃতীয় নৌকা পার হওয়ার সময় টহলধারী সেনাবাহিনির জীপ চলে আসে এবং নৌকাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তৃতীয় নৌকায় চারজন পুরুষ ছিল, তারা লাফিয়ে জলে পড়ে, কিন্তু দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। চতুর্থ নৌকা আর ব্রীজ পার হওয়ার সাহস পায় না। আমার ভাইবোনদের নৌকার যাত্রীরা মুরাদনগর কোনো এক জায়গায় পৌঁছে, তারপর ৭০/৮০ মাইল হেঁটে সীমান্ত পার হয়ে প্রথমে সোনামূড়া এবং পরে কিশোরগঞ্জ (কাঁকড়াবন) মামা বাড়িতে পৌঁছে। এদিকে আমি বিকেলবেলা আগরতলায় দুর্গা চৌমুহনীতে যতীন্দ্র ডাক্তারের হোমিওপ্যাথ দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছি। এমন সময় আমাদের স্বল্প পরিচয়ের এক লোক এসে জানায় যে চার নৌকা পার হতে গিয়ে এক নৌকা আটকিয়ে ফেলে, নৌকায় আমার ভাইবোন ছিল। মিলিটারিরা আমার ভাইকে গুলি করে মেরে ফেলে, দু'বোনকে নিয়ে যায়। এই সংবাদ শুনে আমি আকাশবিদারী উচ্চ কণ্ঠে কাঁদতে থাকি। মনে নেই, কেউ একজন আমাকে ধরে হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণনগর বড়মাসীর বাসায় নিয়ে আসে। এখবর তাঁরাও পেয়েছেন এবং সবাই কান্নাকাটি করছেন। পাড়ার লোক জড় হয়েছে। আমি এ কঠিন সময়ে বজ্রাহতের মতো মাটিতে বোধহীন, বাকহীন, অনড় অবস্থায় বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমার মেসোতাত ভাই, যিনি আমার সহপাঠী এবং টেলিগ্রাফ অফিসে চাকুরি করেন, তিনি হস্তদন্ত হয়ে বাসায় এসে এ অবস্থা দেখে জানতে চান কী হয়েছে। মাসীমা কেঁদে কেঁদে সর্বনাশা সংবাদটি যখন বলছিলেন, দিলীপদা (মেসোতাত ভাই) বললেন, 'মিথ্যা কথা। মামা কাঁকড়াবন থেকে টেলিগ্রাফ অফিসে এসে আমাকে জানায় কল্পনা-মলিনা-বিকাশ (আমার ভাইবোন) কিছুক্ষণ আগে কিশোরগঞ্জ মামার বাড়ি এসে পৌঁছেছে। শান্তিকে যেন পাঠিয়ে দিই। কান্না থেমে গেলো কিন্তু কষ্ট যন্ত্রণা শেষ হলো না। আমি যেন কিছুই শুনতে পেলাম না। আমাকে ধাক্কা দিয়ে সচেতন করা হলো। কিশোরগঞ্জ যাওয়ার জন্য বলা হলো। আমার স্ত্রী বললেন- তিনিও যাবেন। সন্ধ্যা হয় হয়। সেজন্য মাসীমা তাকে যেতে দিলেন না। দিলীপদা আমাকে বটতলী নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিলেন। হাতে ২০/২৫ টাকা। রাত নয়টার দিকে কিশোরগঞ্জ পৌঁছি। ভাইবোনরা আমাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। দীর্ঘপথ হেঁটে আসায় পা ফুলে গেছে, বড় মামী (আমার মামা একজন মামী দু'জন) তাদের পায়ে গরম তৈল মালিশের ব্যবস্থা করেছেন। ভাইবোনের মিলনপর্ব কীরূপ ছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। অনুভবে স্বর্গীয় বলেই উদযাপন করলাম। কিন্তু সেদিন থেকে আমার স্মৃতিশক্তির উপর ভীষণ চাপ পড়েছিল। যা পরবর্তী জীবনে রেশ রয়ে গেছে। আমার আবেগ-অনুভূতি ও চৈতন্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এখনও এ ভাব থেকে রেহাই পাচ্ছি না। আমার এই তিন ভাইবোন মামা বাড়িতেই থেকে গেলো, কাঁকড়াবনে শরণার্থী শিবিরে নাম লিখিয়ে সদাশয় ভারত সরকারের অনুদান বা সাহায্যটুকু গ্রহণ করেছে। আমি দু'দিন পর আগরতলা ফিরে আসি এবং টিউশনি ও রেডক্রসের চাকুরি করি। এই কষ্টের মধ্যেও একটি ঘটনা ঘটে। ভাইবোনদের মামাবাড়িতে রেখে আগরতলায় রওয়ানা দিয়েছি। নানা চিন্তায় মনটা অস্থির ও দিশেহারা। কি করব, কী করা উচিত, ভবিষ্যৎ কী- এসব ও ভাবনা মাথায় নিয়ে মামাবাড়ি থেকে বের হলাম। কাঁকড়াবন ছোট্ট একটি নদীর পাড়ে, ব্রিজ নেই। নৌকা দিয়ে পারাবার করতে হয়। পশ্চিম পাড়ে সোনামুড়া থেকে গাড়ি-জীপ এসে থামে, পূর্বপাড় থেকে গাড়ি-জীপ দিয়ে উদয়পুর-বিশ্রামগঞ্জ দিয়ে আগরতলায় যেতে হয়। নদীর পশ্চিম পাড়ে পুলিশের একটি ছোট ফাঁড়ি একজন দারোগা ও একজন কনেস্টবল দায়িত্বে থাকে। আমিসহ অনেক যাত্রী একটি চা-স্টলের মাচায় বা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে আমার গ্রামের প্রাণনাথ দাস, তার বাবা ১৯৬৪ সালে কাঁকড়াবন চলে এসেছেন, প্রাণনাথ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে লজিং থেকে পড়ত, সেও সীমান্ত পেরিয়ে নিজের বাড়িতে চলে এসেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। আমাকে দেখে বসার জন্য পুলিশ ফাঁড়ির ঘরে নিয়ে গেলো। সেখানে কাউকে দেখা গেলো না। দারোগার বসার জন্য একটি চেয়ার সামনে টেবিলের উপর একটি মোটা রেজিস্ট্রার খাতা ও মোটা গোলাকার কাঠের রোলার। প্রাণনাথ আমাকে ঐ চেয়ারে বসিয়ে দিল। আমি দিব্যি বসে গেলাম ও গালে হাত দিয়ে চিন্তায় নিমগ্ন হলাম। এমন সময় কনেস্টবল কোথায় থেকে এসে ঘরে ঠুকেই আমাকে দেখে তার গাদা বন্দুকটি কাঁধ থেকে নামিয়ে পা মাটিতে ঠেকিয়ে স্যালুট দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমি নিস্পৃহভাবে তার দিকে তাকালাম। সে হয়ত ভেবেছে আমি বোধহয় পুলিশের কোনো বড়কর্তা। তাই চেয়ারে বসে আছি। আমিও বিব্রত, সেও বিব্রত এবং একঠায় দাঁড়িয়ে সামরিক কায়দায়। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি এবং বলি- দারোগা কোথায়? সে পা ঠুকে স্যালুট দিয়ে জানায়- তিনি উদয়পুর গেছেন। আর কী বলা যায় -ভাবছি। এমন সময় একটি জীপগাড়ি এলো, প্রাণনাথ এসে আমাকে ডেকে নিল। কনেস্টবলটি শরীরটা ঢিলে দিয়ে আমার যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইল। পরে তার সঙ্গে ২/১ বার দেখা হয়েছে। আমার দিকে চেয়ে থেকেছে, আমিও। কোনো কথা হয়নি। মাঝে মাঝে জয়বাংলা অফিসে যাই, যুদ্ধের হাল অবস্থা জেনে আসি কতটুকু কী হচ্ছে তা কেবল ধারণাকৃত ও সান্ত্বনাসূচক, তারই উপর বিশ্বাস রাখতে চেষ্টা করেছি। সন্ধ্যার পর বাসায় রেডিও ভরসা- জয়বাংলা, আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদি কেন্দ্রগুলি আগ্রহে ও মনন-বিশ্বাসে বিচরণ করতে থাকি। কিন্তু কী হবে, আদৌ কিছু হবে কী না। হলে কবে পর্যন্ত, ভিয়েতনাম তো ত্রিশবছর যুদ্ধ করেছে। আমরা বাংলাদেশীরা কতদিন যুদ্ধ করতে হবে, ভারত কেন যুদ্ধে নামছে না, একমাত্র ভারতই তো বাঙালি জাতির রক্ষাকর্তা-ত্রাণকর্তা-প্রাণকর্তা । কিন্তু ---
সে সময় মহামারির মতো চোখের রোগ শুরু হয়। রোগটি ভাইরাস জাতীয় । চোখ ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং কেতুর জাতীয় আঠালো রস চোখ বন্ধ করে ফেলে। প্রচুর যন্ত্রণা, চোখ থেকে জল পড়তে থাকে। ঘুম থেকে ওঠে প্রথমই গরম জল দিয়ে চোখ পরিষ্কার করা, না হলে চোখ খোলা যেত না, দেখা যেত না। যার হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ বা তারও অধিক সময় আক্রান্ত অবস্থায় থাকতে হতো। আগরতলায় এ চোখের রোগের নামকরণ হয় 'জয়বাংলা চক্ষুরোগ।' এছাড়া একসময় শরণার্থী শিবিরে ব্যাপক রক্তঅমাশয় দেখা দেয়। তাও মহামারির মতো। এতে প্রচন্ড দুর্বল করে শরীরকে। কিন্তু সে সময় কেউ মারা গেছে এমন খবর পাওয়া যায়নি।
প্রতিটি শরণার্থী শিবির টিলার উপরে, প্রাকৃতিকভাবেই টিলার নীচে ক্ষীণধারায় জলের প্রবাহ বারো মাস, রান্না করার কাঠ বা বাঁশের অভাব নেই। প্রকৃতির ডাক প্রাকৃতিক পরিবেশেই সমাধান করতে হতো। হাফানিয়া, বক্সনগর, আমতলী, কাঁকড়াবন প্রভৃতি এলাকায় বিশাল বিশাল শিবির। সরকার অস্থায়ীভাবে বাঁশ ছন দিয়ে ঘর তুলে দিয়েছে। লোকসংখ্যা অনুযায়ী বা এক পরিবার ধরে ঘর বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে, শরণার্থীদের জন্য সরকারি অনুদান বন্টনের জন্য পৃথক পৃথক অফিস বসানো হয়েছে। অনিয়ম হয়েছে কীনা জানি না। তবে কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হতো। তা ধরে নেয়া যায়। এত বিশাল অপ্রস্তুত কর্মযজ্ঞ সামাল দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। মন্তব্য করব- ‘যতটুকু হয়েছে ভালো হয়েছে, আরো ভালো হয়ত হতে পারত। মন্দের ভালো নয়, ভালোর ভালো।’
(ক্রমশঃ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫