চিরায়ত সাহত্যি
সাহিত্যে নবত্ব ----
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।।
সকল দেশের সাহিত্যেরই প্রধান কাজ হচ্ছে শোনবার লোকের আসনটি বড়ো ক’রে তোলা, যেখান থেকে দাবি আসে। নইলে লেখবার লোকের শক্তি খাটো হয়ে যায়। যে-সব সাহিত্য বনেদি তারা বহু কালের আর বহু মানুষের কানে কথা কয়েছে। তাদের কথা দিন-আনি-দিন-খাই তহবিলের ওজনে নয়।বনেদি সাহিত্যে সেই শোনবার কান তৈরি ক’রে তোলে।যে-সমাজে অনেক পাঠকের সেই শোনবার কান তৈরি হয়েছে সে-সমাজে বড়ো ক’রে লেখবার শক্তি অনেক লেখকের মধ্যে আপনিই দেখা দেয়, কেবলমাত্র খুচরো মালের ব্যবসা সেখানে চলে না। সেখানকার বড় মহাজনদের কারবার আধা নিয়ে নয়, পুরো নিয়ে।তাদওে আধা’র ব্যাপারী বলব না, সুতরাং জাহাজের খবর তাদের মিলে।
বাংলাদেশে প্রথম ইংরেজি শিক্ষার যোগে এমন সাহিত্যের সঙ্গে আমাদেও চেনাশোনা হলোযার স্থান বিপুল দেশের ও নিরবধি কালের। সে সাহিত্যেও বলবার বিষয়টা যতই বিদেশী হোক-না. তার বলবার আদর্শটা সর্বকালিন ও সর্বজনীন। হোমারের মহাকাব্যেও কাহিনীটা গ্রীক, কিন্তু তার মধ্যে কাব্য রচনার যে-আদর্শটা আছে যেহেতু তা সার্বভৌমিক এইজন্যেই সাহিত্যপ্রিয় বাঙালিও সেই গ্রীক কাব্য পড়ে তার রস পায়। আপেল ফল ফল আমাদেরদেশের অনেক লোকের পক্ষেই অপরিচিত, ওটা সর্বাংশে বিদেশী, কিন্তু ওর মধ্যে যে ফলত্ব আছে সেটাকে আমাদেও অত্যন্ত স্বাদেশিকরসনাও মুহূর্তের মধ্যেও সাদরে স্বীকার ক’রে নিতে বাধা পায় না। শরৎ চাটুজ্জের গল্পটা বাঙালির, কিন্তু গল্প বলাটা একান্ত বাঙালির নয়; সেইজন্যে তাঁর গল্প-সাহিত্যের জগন্নাথ-ক্সেত্রে জাত-বিচারের কথা উঠতেই পাওে না।গল্প-বলার সার্বজনিন আদর্শটাই ফলাও ক্ষেত্রে সকল লোককে ডাক দিয়ে আনে। সেই আদর্শটা খাটো হলেই নিমন্ত্রণটা ছোটো হয়; সেটা পারিবারিক ভোজ হতে পাওে, স্বজাতের ভোজ হতে পাওে,কিন্তু সাহিত্যেও যে-তীর্থে সকল দেশের যাত্রী এসে মেলে সে-তীর্থের মহাভোজ হবে না।
কিন্তু মানুষের কানের কাছে সর্বদাই যারাভিড় ক’ওে থাকে,যাদেও ফরমাশ সবচেয়ে চড়া গলায়, তাদেও পাতে যোগান দেবার ভার নিতে গেলেই ঠকতে হবে; তারা গাল পাড়তে থাকলেও তাদেও এড়িয়ে যাবার মতো মনের জোর থাকা চাই। যাদেও চিত্ত অত্যন্ত ক্ষণকালবিহারী, যাদেও উপস্থিতগরজের দাবি অত্যন্ত উগ্র,তাদেরইহট্টগোল সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। সকালবেলার সূর্যালোকের চেয়ে বেশি দৃষ্টিতে পড়ে যে-আলোটা ল্যাম্পপোস্টেও উপরকার কাচফলক থেকে ঠিকওে চোখে এসে বেঁধে। আবদারের প্রাবল্যকেই প্রমাণ্য মনে করার বিপদ আছে।
যে-লেখকের অন্তরেই বিশ^শ্রোতার আসন তিনিই বাইওে ম্রোতার কাছ থেকে নগদ বিদায়ের লোভ সামলাতে পারেন। ভিতরের মহানীরব যদি তাঁকে বরণমালা দেয় তা হলে তাঁর আর ভাবনা থাকে না,তহলে বাইরের নিত্যমুখরকে তিনি দূর থেকে নমস্কার ক’ওে নিরাপদে চলে যেতে পারেন।
ইংরেজি শিক্ষার গোড়াতেই আমরা যে-সাহিত্যেও পরিচয় পেয়েছি তার মধ্যে বিশ^ সাহিত্যের আদর্শ ছিল এ কথা মানতেই হবে। কিন্তু, তাই বলে এ কথা বলতে পারব না যে, এই আদর্শ য়ুরোপে সকল সময়েই সমান উজ্জ্বল থাকে। সেখানেও কখনো কখনো গরজের ফরমাশ যখন অত্যন্ত বড় হয়ে ওঠে তখন সাহিত্যে খর্বতার দিন আসে। তখন ইকনমিকসের অধ্যাপক, বায়োলজির লেকচারার, সোসিয়লজির গোল্ড মেডালিস্ট সাহিত্যেও প্রাঙ্গনে ভিড় ক’রে ধরনা দিয়ে বসেন।
সকল দেশের সাহিত্যেও দিন একটানা চলে না; মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেলে বেলা পড়ে আসতে তাকে।আলো যখন ক্ষীণ হয়ে আসে তখন অদ্ভুতের প্রাদুর্ভাব হয়।অন্ধকারের কালটা হচ্ছে বিকৃতির কাল। তখন অলিতে-গলিতে আমরা কন্ধকাটাকে দেখতে পাই, আর তার কুৎসিত কল্পনাটাকেই একান্ত কওে তুলি।
বস্তুত সাহিত্যেও সায়াহ্নে কল্পনা ক্লান্ত হয়ে আসে ব’লেই তাকেবিকৃতিতে পেয়ে বসে;কেননা,যা কিছু সহজ তাতে তার আর শানায় না। যে অক্লিষ্ট শক্তি থাকলে আনন্দসম্ভোগ স্বভাবতই সম্ভবপর সেই শক্তির ক্ষীণতায় উত্তেজনার প্রয়োজন ঘটে। তখন মাতলামিকেই পৌরুষ ব’লে মনে হয়। প্রকৃতিস্থকেই মাতাল অবজ্ঞা কওে;তার সংযমকে হয় মনে কওে ভান, নয় মনে করে দুর্বলতা।
বড় সাহিত্যেও একটা গুণ হচ্ছে অপূর্বতা,ওরিজিন্যালিটি। সাহিত্য যখন অক্লান্ত শক্তিমান থাকে তখন সে চিরন্তনকেই নূতন কওে প্রকাশ করতে পারে। এই তার কাজ। একেই ব’লে ওরিজিন্যালিটি। যখনি সে আজগবিকে নিয়ে গলা ভেঙে, মুখ লাল কওে, কপালের শিরগুলোকে ফুলিয়ে তুলে ওরিজিন্যাল হতে চেষ্টা কওে, তখনি বোঝা যায় শেষ দশায় এসেছে। জল যাদেও ফুরিয়েছে তাদের পক্ষে পাঁক।তারা বলে সাহিত্যধারায় নৌকো-চলাচলটা অত্যন্ত সেকেলে; আধুনিক উদ্ভাবনা হচ্ছে পাঁকের মাতুনি- এতে মাঝিগিরির দরকার নেই- এাঁ তলিয়ে যাওয়া রিয়ালিটি। ভাষাটাকে বেঁকিয়ে-চুরিয়ে, অর্থের বিপর্যয় ঘটিয়ে, ভাবগুলোকে স্থানে-অস্থানে ডিগবাজি খেলিয়ে, পাঠকের মনকে পদে পদে ঠেলা মেওে, চমক লাগিয়ে দেওয়াই সাহিত্যেও চরম উৎকর্ষ। চরম সন্দেহ নেই। সেই চরমের নমুনা য়ুরোপিয় সাহিত্যের ডাডায়িজম। এর একটিমাত্র কারণ হচ্ছে এই,আলাপের সহজ শক্তি যখন চলে যায়সেই বিকারের দশায় প্রলাপের শক্তিবেড়ে ওঠে। বাইরের দিক থেকে বিচার করতে গেলেপ্রলাপের জোর আলাপের চেয়ে অনেক বেশি, এ কথা মানতেই হয়। কিন্তু, তা নিয়ে শঙ্কা না ক’ওে লোকে যখন গর্ব করতে থাকে তখনি বুঝি সর্বনাশ হলো ব’লে।
য়ুরোপের সাহিত্যে চিত্রকলায় এই-যে বিহ্বলতা ক্ষণে ক্ষণে ও স্থানে স্থানে বীভৎস হয়ে উঠেছে এটা হয়তো একদিন কেটে যাবে, যেমন করে বলিষ্ঠ লোক মারাত্মক ব্যামোকেও কাটিয়ে ওঠে। আমার ভয়, দুর্বলকে যখন ছোঁয়াচ লাগবে তখন তার অন্যান্য নানা দুর্গতির মধ্যে এই আর-একটা উপদ্রবের বোঝা হয়তো দুঃসহ হয়ে উঠবে।
ভাবনার বিশেষ কারণ হচ্ছে এই যে,আমাদেও শাস্ত্র-মানা ধাত। এই রকম মানুষেরা যখন আচার মানে তখন যেমন গুরুর মুখের দিকে চেয়ে মানে, যখন আচার ভাঙে তখন গুরুর মুখের দিকে চেয়েই ভাঙে। রাশিয়া বা আর কোন পশ্চিম দিগন্তেযদি গুরু নবীন বেশে দেখা দেন,লাল টুপি পওে বা যে কোনো উগ্রসাজেইহোক তবে আমাদেও দেশের স্কুল-মাষ্টাররা অভিভ’ত হয়ে পড়েন। শাশুড়ির শাসনে যার চামরা শক্ত হয়েছে সেই বই শাশুড়ি হয়ে উঠে নিজের বধুর’ পরেশাসন জারি কওে যেসন আনন্দ পান, এঁরাও তেমনি স্বদেশের যে-সব নিরীহ মানুষকে নিজেদেও স্কুলবয় ব’লে ভাবতে চিরদিন অভ্যস্ত তাদেও উপর উপরওয়ালা রাশিয়ান হেডমাষ্টারদের কড়া বিধান জারি ক’রে পদোন্নতির গৌরব কামনা করেন। সেই হেডমাস্টারদের গদ্গদ ভাষার অর্থ কী ও তার কারণ কী, সে কথা বিচার করার অভ্যাস নেই, কেননা সেই হলো আধুনিক কালের আপ্ত বাক্য।
ক্ল্যাসিক বা চিরায়ত সাহিত্য('ক্ল্যাসিক' সাহিত্যের স্বর্ণমান, কিন্তু চকচক করলেই সবকিছু সোনা হয় না।)

হাসিব উল ইসলাম ।।
লন্ডনে
১৯৪৩ সালে ভার্জিল সংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংঘের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম
ইউরোপে যারা কেন্দ্রীয় শিক্ষা পদ্ধতি চান তাঁদেরকে একত্রিত করা। এখনো
সংঘটির লক্ষ্য একই রয়েছে। ইংরেজ কবি, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, এবং
সম্পাদক টি এস এলিয়ট (১৯৮৮—১৯৬৫) ভার্জিল সংঘের প্রথম সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৪
সালে ভার্জিল সংঘের সভাপতির বক্তব্যে এলিয়ট ক্ল্যাসিক (বা চিরায়ত সাহিত্য)
কি তা আলোচনা করেন।
'ক্ল্যাসিক '-একটি অবজ্ঞাপূর্ণ শব্দ?
এলিয়টের
প্রশ্নটি ( ক্ল্যাসিক কি) এখনো আমাদের মনে প্রথমে বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে,
তারপর ধোঁকা দেয়; এবং 'ক্ল্যাসিক' (পষধংংরপ) শব্দটির অপব্যবহার, তিনি
রসিকতা করে বলেছিলেন, সর্বত্র। ক্ল্যাসিক কমেডি বলতে খুব সম্ভবত
অ্যারিস্টোফেন্সের নাটকের চেয়ে এখন ক্যারি অন আপ দ্যা খাইবার (১৯৬৮) বা
দি ডিক্টেটর (২০১২) টাইপ সিনেমাকে বোঝায় । খেলাধুলা থেকে শুরু করে, রক
সংগীত, চা নাশতা সবকিছুকেই সম্মানসূচক 'ক্ল্যাসিক ' খেতাব দেওয়া হয়েছে।
(কিন্তু, জাপান টোবাগোর চুরুটের নাম হ্যামলেট, কিংবা কুকুরের নাম হোমার
রাখা অন্য ব্যাপার।)
ক্ল্যাসিক শব্দটির অতি ব্যবহার বা অপব্যবহার যাই
হোক না কেন, সাহিত্যের জন্য এখনো পদটি প্রয়োজন। যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে,
চিরায়ত সাহিত্যের ধারণা এমন কিছুর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যা আমরা সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে বলে ধরে নিই- যদিও চিরায়ত সাহিত্যের সীমানির্দেশ করা
কঠিন।
এলিয়ট ধ্রুপদি/চিরায়ত সাহিত্যকে সমাজের ফসল হিসেবে দ্যাখেন যা
সমাজেই উৎপাদিত হয়। এলিয়ট তাঁর বক্তৃতায় বলেন' শুধুমাত্র তখনই একটি
ক্ল্যাসিকের সৃষ্টি হয় যখন একটি সভ্যতার পূর্ণবিকাশ সাধিত হয়; যখন একটি
ভাষা ও সাহিত্য পূর্ণতা পায়। এবং অবশ্যই ক্ল্যাসিককে একটা পরিপক্ক লেখকের
রচনা হতে হয়।' এলিয়টের এই বিবৃতিটি নিঃসন্দেহে চমৎকার। কিন্তু যে সময়ে তিনি
কথাগুলো বলছিলেন- সেই ১৯৪৪ সালের সভ্যতায় যখন ভার্জিল সংঘ প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল-আর যা-ই হোক সভ্যতার পূর্ণবিকাশ ছিল না। সমবেত ক্ল্যাসিসিস্টরা যাতে
জার্মান বোমারু বিমানের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ছিন্নভিন্ন না হয়ে যায় এ এজন্য
প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেব যে মিলনায়তনে বক্তৃতা চলছিল সেটি কালো
ছাউনি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল!
ফ্রাঙ্ক কারমোদির পুন:সজ্ঞায়ন
ইংরেজ
সাহিত্য সমালোচক স্যার জন ফ্রাঙ্ক কারমোদি (১৯১৯-২০১০) ১৯৭৫ সালে কেন্ট
বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিয়ট লেকচারে (মৃত কবি নিজেই এখন ক্ল্যাসিক) একই সমস্যার
(ক্ল্যাসিক কি) অবতারণা করেন। ব্রিটেনে তখন সামাজিক বিপর্যয়। আগের বছর,
ওপেকের 'অয়েল শকের' সাথে সাথে আমেরিকা ভিয়েতনাম থেক সৈন্য প্রত্যাহার
করেছে। পরিণামে ব্রিটেনে বিশ শতাংশ বা তারও বেশি মুদ্রাস্ফীতির সূত্রপাত।
তখন কোন কালো ছাউনির প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু ১৯৭৩ সালের খনিশ্রমিকদের
ধর্মঘটের ফলে ক্রমাগত ব্ল্যাকআউটসমূহ সাম্প্রতিক বেদনার স্মৃতি। মড়ার ওপর
খাড়ার ঘা হিসেবে আরো বেশি লোড 'পাওয়ার কাট' আসন্ন ছিল। সভ্যতা নিজেই যখন
হুমকির মুখে, বলা যায়, তখনই গভীর অভিনিবেশে ক্ল্যাসিক কি তা নিয়ে
চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। 'ক্ল্যাসিক ' এমন এক ধরন যা আমরা সাংস্কৃতিকভাবে
গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি; যখন কালের গর্ভে সবকিছু হারিয়ে যায়,
ক্ল্যাসিক অবশ্যই সংরক্ষিত হয় — এমনকি, প্রয়োজন হলে সেগুলোর জন্য আমরা
প্রাণও দিই।
‘ক্ল্যাসিক?- পুরোনো পুস্তক যেগুলো মানুষ এখনো পড়ে।'
-ফ্র্যাঙ্ক কারমোদি
'ক্ল্যাসিক'
এর সহজ বিপরীত হলো 'রোমান্টিক'। উদাহরণ হিসেবে,নিউ ক্ল্যাসিকাল এবং
রোমান্টিক যুগের দুজন কবি আলেকজান্ডার পোপ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার কথা
বলা যায়। এলিয়ট এবং কারমোদি উভয়ই ক্ল্যাসিক এবং রোমান্টিক লেখার সংকীর্ণ
কিন্তু কেজো প্রয়োগকে একপাশে রেখেছিলেন।
এলিয়টের কিছু ধারনাকে আরো একটু
বিশদ করে, কারমোদি ক্ল্যাসিকের তিনটি বুনিয়াদি উপাদান আলাদা করেন : ১.
সাম্রাজ্যবাদ; ২. সভ্যতা; এবং ৩. প্রাচীনতা। সাহিত্য দেশ ও কালের সীমা
ছাড়িয়ে যায়। যেমন, শেকসপিয়র জার্মানিতে, আর গ্যেটে ইংল্যান্ডে এবং সারা
দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক 'ক্ল্যাসিক ' হিসেবে গৃহীত হয়। আবার অসংখ্য পুস্তক যে
সময়ে রচিত হয় সেই সময়কে অতিক্রম করতে পারে না, পারে না ভিন ভাষায় ভিন দেশে
আশ্রয় খুঁজে পেতে।
কারমোদি এলিয়টের সাথে একমত যে চিরায়ত সাহিত্য
মানুষের মানস ও নীতির সর্বোচ্চ মানদন্ডের রূপায়ণ — চিরায়ত সাহিত্য যুগপৎ
সুসভ্য ও সুসভ্যকরী। এমনকি লাতিন বা সংস্কৃতের মতোন মৃত ভাষাতেও চিরায়ত
সাহিত্য বেঁচে থাকে।
শেকসপিয়র এখনো আমাদের সাথে কথা বলে যান, যদিও এখন
কেউ এলিজাবেথীয় ইংরেজিতে কথা বলে না, আর অমিত্রাক্ষর ছন্দ এখন আর মঞ্চ
নাটকের প্রমিত মাধ্যম নয়।
ক্ল্যাসিক ও সাম্রাজ্য
এলিয়টের চেয়ে
কারমোদির সমাজ জ্ঞান স্পষ্টতর ছিল। সভ্যতা নয়, ক্ল্যাসিকের ভিত্তির জন্য
প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে একটা সাম্রাজ্য এবং তার সময়কার সাংস্কৃতিক
ক্ষমতার বিস্তার। একটা আঞ্চলিক বাচনের পিছনে যেমন সেনাবাহিনী
থাকলে,—ভাষাবিদেরা ?রসিকতা করেন,— ভাষা হয়, তেমনি সাহিত্যের পিছনে
সাম্রাজ্য থাকলে ধ্রুপদি হয়। প্রয়োজনে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদাহরণ দিয়ে
ব্যাপারটা খুব সহজেই পরীক্ষা করা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বর্তমানে ২৮টি দেশ
রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়টা দেশের ধ্রুপদি সাহিত্য আছে? উত্তর হবে সেই সব
দেশের অতীতে যাদের বিশাল সাম্রাজ্য ছিল। (যেমন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন,
হল্যান্ড, পর্তুগাল, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, এবং বেলজিয়াম।) লুক্সেমবার্গের
কি কোন ধ্রুপদী সাহিত্য আছে? অথবা মলডোভার? তাদের শেকসপিয়র, সার্ভান্তেস,
রেসিনেরা কোথায়?
একটি ক্ল্যাসিক- যেটা সবাই চায় পড়া থাকুক এবং কেউই পড়ে না।
- মার্ক টোয়েন।
কেউ
যদি পেঙ্গুইন মর্ডার্ণ ক্ল্যাসিকসের সংগ্রহ থেকে ইংরেজ লেখক নিক হর্নবির
উপন্যাস নেন, ভার্জিলের সাথে তাঁর কি সম্পর্ক ধরে নেওয়া হবে? ডিকেন্স এবং
তলস্তয়ের পুস্তকের পাঠে হর্নবির উপন্যাস 'হাই ফিডেলিটি ' —যা এলপি ও ভিনেইল
রেকর্ডের সরস বন্দনা — রাখার অর্থ হচ্ছে পুস্তকটি এলপি এবং ভিনেইল
রেকর্ডের চেয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকবে। ?যেমন, ডিকেন্সের 'পিকউইক পেপার্স'
ঘোড়ার গাড়ির সময়কে ছাপিয়ে টিকে আছে অথবা তলস্তয়ের 'ওয়্যার এন্ড পিস '
ভূমিদাস প্রথাকে ছাপিয়ে।
কিন্তু 'দীর্ঘস্থায়িত্ব' এর মানদণ্ড চরম জটিল।
যদি হর্নবির উপন্যাসটি, তলস্তয়ের উপন্যাসের মতোন একশো বছর পরে (কষ্টকর
টিকাটিপ্পনীসহ, যেমন, ৯০ এর দশেেকর রেকর্ড প্লেয়ার্স, পপ চার্টস, এবং রক
মিউজিক) পড়া হয়, তাহলে কি সেটা একই ধরনের সাহিত্যকর্ম থাকবে? এটাকে কি
আলাদা মনে হবে না?
কারমোদির বিবেচনায়, চিরায়ত সাহিত্যের যথার্থ
নমনীয়তা হলো তার মূল ও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। যেকোনো স্থানে, যেকোনো কালে
চিরায়ত সাহিত্য তার জায়গা করে নেয়। চিরায়ত সাহিত্যের বহুময়তা এটাকে
যুগপৎ প্রাচীন এবং আধুনিক হতে সক্ষম করে, কিন্তু এটি কখনোই নৈরাজ্যবাদী
নয়। শেকসপিয়ারের 'কিং লিয়ার' এর মতো রচনা, কারমোদি বলেন,- নানান ধরনের
ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে প্রশ্রয় দিয়ে, — পরিবর্তনেও টিকে থাকে। প্রতিটি
প্রজন্ম আলাদা আলাদা ভাবে 'কিং লিয়ার' পড়বে এবং বুঝবে, কারণ প্রত্যেকটা
প্রজন্ম তার আগের প্রজন্মের চেয়ে ভিন্ন। এই নাটকের কোন চূড়ান্ত ব্যাখা বা
বিশ্লেষণ দাঁড় করানো অসম্ভব। প্রতিটি প্রজন্ম তাদের নিজস্ব সন্তোষজনক
ব্যাখা খুজে নেবে। আর চিরায়ত সাহিত্য তার প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থকে
প্রশয় দেয়।
[ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের লর্ড নর্থক্লিফ ইমেরিটাস প্রফেসর, লেখক, এবং কলামিস্ট জন এন্ড্রু সাদার্ল্যাণ্ডের লেখা অবলম্বনে লিখিত।]
পরিচিতি:
হাসিব উল ইসলাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। পড়ান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনানিবাস
প্রজাপতিখলিলুর রহমান শুভ্র ।।
আঁকড়ে ধরে রাখি নাম শব্দমন্ত্র
হাত রাখি ভালোবাসায়
টের পাই যন্ত্র!
আঁকড়ে ধরে রাখি চোখে রাখা চোখ
কলজেটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে
সময়ের নখ!
আঁকড়ে ধরে রাখি ধ্বনি রিনিঝিনি
ঘুমহীন আলুথালু কাটে
মধু নিশীথিনী!
আঁকড়ে ধরে রাখি ভীমরুল স্মৃতি
গায়ে এসে জুড়ে বসে
মৃত প্রজাপতি!
আঁকড়ে ধরে রাখি অক্ষয় ভুল
গোখরোকে ছোবল শেখায়
বেণী করা চুল!
ঝরাপাতার দিনএম এস ফরিদ ।।
হিমেল হাওয়ার পরশে
খসে পড়ে সবুজ পাতাগুলো
খসে পড়ে হাজারো স্বপ্ন
মাটিতে লুটিয়ে গায়ে মেখে ধুলো।
কুয়াশার আবরণে ঢেকে যায় চারিধার
এই পাতা ঝরা দিনে তুমিও ঝরে গেলে
রিক্ত ডালপালা ছড়িয়ে তোমার অপেক্ষায়
তুমি কি আসবে আর এই বাকি কালে?
শীতের আবরণে যৌবন হারালো তৃণলতা
আর আমি হারালাম তোমাকে।
অথচ বসন্ত এলে প্রকৃতি আবার জেগে উঠবে
শুধু তুমিই আড়ালে থেকে যাবে অনন্তকাল।
ঝরাপাতার ব্যাকুলতা থাকতেই পারে
ঝরে গেছে বলে তার ডাল থেকে ক্ষণকালে;
গরমের হাওয়ায় নতুন কুঁড়ি মেলে।
গতকাল রাতটা আমি কোথায় ছিলাম
মো. আরিফুল হাসান ।।
একটা উলঙ্গ রাত আমাকে তাড়াতে তাড়াতে
নিয়ে গেলো পাহাড়ের পাদদেশে।
দুর্গম পাহাড়ি পথে আমি ছুটছি, ছুটছে রাত।
হরিণেরা স্বপ্নের ভেতর চমকে চমকে উঠলে
দূরে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের দিকে মুখ তুলে
একটি নিঃসঙ্গ হায়েনা তীব্রস্বরে ডেকে উঠে।
পাহাড়ের চূড়ায় তখন ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ ও আমি
উলঙ্গ রাত আর হায়েনার শিকার হতে থাকি।
অধরকুসুম
পাতার আড়াল দিয়ে একফোঁটা রোদ এসে
পড়লো তোমার ঠোঁটে
উপরের ঠোঁটের উপরে তিলটি স্পষ্ট হয়ে উঠলো
আমি ফুল ভেবে দূর থেকে শোভা দেখি
ছায়াময় রাস্তাটা স্থির হয়ে থেমে থাকে মহাকাল।
বাতাস পড়ছে না। প্রকৃতির মতো ওই দুটো ঠোঁট
আটকে রাখছে রোদ, ছায়া, রাস্তা ও আমাকে।