ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
এ অবাঞ্ছিত খুনোখুনি বন্ধ হবে না?
Published : Saturday, 4 December, 2021 at 12:00 AM, Update: 04.12.2021 1:11:53 AM
এ অবাঞ্ছিত খুনোখুনি বন্ধ হবে না?আহমদ রফিক ||
একুশ ও একাত্তর নিয়ে যুক্তিসংগত কারণে আমরা বরাবর উচ্চকণ্ঠ। কারণ এরা শুধু আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার সূচনা ও পরিণামই নয়; বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলার যথাক্রমে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যাত্রাপথ তৈরি করেছে।
একাত্তরের স্বাধীন বাংলাসহ একাধিক সুফল সত্ত্বেও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় বেআইনি অস্ত্রের ব্যাপকতা; বিশেষ করে তরুণদের হাতে- রাজধানী থেকে দূর গ্রামে। অস্ত্র জমা দেওয়ার সরকারি ঘোষণা সত্ত্বেও সমস্যার সমাধান হয়নি; সব অস্ত্র জমা পড়েনি। বরং যত দিন গেছে বেআইনি অস্ত্রের চালান ও ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে খুনখারাবি ও সামাজিক নৈরাজ্য, আর গ্রামে ডাকাতি।
এক পর্যায়ে গ্রাম কিছুটা শান্ত হয়ে এলেও রাজধানী ও বড় বড় শহরে, এমনকি কখনও তৃণমূল স্তরে বেআইনি বা আইনি অস্ত্রের বেআইনি ব্যবহার বেড়েছে। খুন তথা মানুষ হত্যা এক সময় পাখি মারার মতো ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। সন্ত্রাসী অস্ত্রধারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এদের সিংহভাগ আদর্শচ্যুত তরুণ (কখনও মুক্তিযোদ্ধা), কেউ বেকার তরুণ- অর্থের প্রয়োজনে মানুষের জীবনের মূল্যে ভাড়া খাটে। কিছু নাম এখনও মনে আছে। এর মধ্যে মেধাবী তরুণও ছিল।
এই যে অবাঞ্ছিত ঐতিহ্য গড়ে ওঠে, এর সর্বনাশা বিস্তার ঘটে মাদক, চোরাচালান, এমনকি ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জমিজমা-অর্থলোভ এ ক্ষেত্রে হত্যা-নেশার বড় লোভ হয়ে ওঠে। অনেক ক'টা বছর শেষ। তবু অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি, বরং ঘটে এর ডালপালা বিস্তার; কিশোর গ্যাংয়ের বিস্ময়কর আবির্ভাব ও খুনখারাবি এর বড় প্রমাণ।
ছাত্র রাজনীতি, বয়স্ক রাজনীতি, এমনকি অরাজনৈতিক অর্থকরী দিক বা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা রক্ত ঝরানোর কারণ হয়ে ওঠে। তখন রাজনৈতিক সহযাত্রী বা একান্তজন হত্যায়ও হাত কাঁপে না। অর্থ স্বার্থের বা ক্ষমতার টান বড় ভয়ংকর। এর প্রমাণ- মধ্যরাতে রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকার বিজন রাজপথে মিলকি হত্যার ঘটনাটির সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে দেখে শিউরে উঠি। ভাবি, মানুষ হত্যা কত সহজ! নারায়ণগঞ্জের কিছু ভয়ংকর ঘটনাও উদাহরণ বটে।

দুই
দীর্ঘ কয়েক বছর পর জীবনসায়াহ্নে গৃহবন্দি অবস্থায় সংবাদপত্রে প্রকাশ অনেক হত্যাকাণ্ডে জননিরাপত্তার অভাব নিয়ে যখন ভাবছি, কষ্ট পাচ্ছি, তখন ইউপি নির্বাচন উপলক্ষে আরেকটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের খবর একাধিক সংবাদপত্রে পড়ে শিউরে উঠে ভাবি, সমাজটার কি পরিবর্তন ঘটবে না? রক্তলেখা মুছে কি সমাজে শান্তি, স্থিরতা প্রতিষ্ঠিত হবে না? কথায় কথায় নরহত্যার ঐতিহ্য ও স্বার্থপরতাই কি বড় হয়ে থাকবে? তাহলে আমার পরবর্তী প্রজন্ম স্বাধীন দেশে শান্তিতে জীবন যাপন করবে কীভাবে?
প্রধান সংবাদ শিরোনাম :'গুলিতে ঝাঁজরা কাউন্সিলর, সহযোগীও নিহত (সমকাল, ২৩.১১.২০১২)। সংক্ষিপ্ত খবর হলো- কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের জনপ্রিয় কাউন্সিলর সোহেল (৫২) এবং তার সহযোগী হরিপদ সাহা (৫০) তাদের অফিসে মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। অর্থাৎ ব্যক্তিক নিরাপত্তা বলে কোনোকিছু রইল না- সমাজ এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য কি নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন সম্ভব? এ অবস্থার দায় যেমন রাজনীতির, তেমনি সমাজের; যে জন্য শুরুতে এ লেখায় এতটা ভূমিকা।
একা কুমিল্লা নয়; রাজধানী ঢাকা, তার আশপাশ অঞ্চলসহ দেশের অধিকাংশ শহর, তৃণমূল এলাকা পর্যন্ত সন্ত্রাসের দাপটে রক্তচিহ্নিত বা পীড়িত। নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যার বিচার এত বছরেও সম্পন্ন হলো না। তদন্ত ও বিচারহীনতার বহু ঘটনা নিয়ে সুবিচার চেয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে বেসরকারি একাধিক সংস্থা। সুলতানা কামাল সেসব সংস্থার প্রধানদের মধ্যে একজন। কিন্তু সমাজ সংস্কারের কাজে কোনো অগ্রগতির প্রকাশ নেই।

তিন
সামাজিক সন্ত্রাস যখন রাজনৈতিক সন্ত্রাসে পরিণত হয়, তখন জননিরাপত্তা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও খুনখারাবি নিত্যকার বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ক্ষমতার বলয়ে নানা কারণে; তেমনি নির্বাচনের মতো জনপ্রিয় বিষয়ও সন্ত্রাসী পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। নিরীহ বা শান্তিবাদী মানুষও তখন ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটান; দিনরাত একাকার করেন। এই তো কিছুদিন আগে ঘটে গেল অকারণে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অবাঞ্ছিত ঘটনাবলি। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সঙ্গে আমরা আরও দেখি, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানে নারী ও শিশু পাচারের মতো বহুবিধ ঘটনা নিয়ে খুনোখুনি।
ক্রমশ এর বিস্তার ঘটেছে, এমনটা আগে বলেছি, ব্যক্তিগত সম্পর্কে, এমনকি পারিবারিক পর্যায়ে। সামান্য অর্থবিত্ত বা নারী সম্পর্ক নিয়ে বন্ধু বন্ধুকে খুন করাচ্ছে ভাড়াটে খুনি বা সন্ত্রাসীর সাহায্যে। কখনও স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে। আদরের কন্যার হাতে মা-বাবার খুনের মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও এ সমাজে ঘটেছে।
দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতা এদিক থেকে প্রায়শ চাঞ্চল্যকর বা আটপৌরে খবরে রক্তচিহ্নিত। একটি সাম্প্রতিক ছোট সংবাদের উদ্ৃব্দতি দিই। সমকালের (২৪.১১.২০২১) একটি শিরোনাম :'তুচ্ছ ঘটনায় ঢাকায় তিন মাসে খুন সাত কিশোর-তরুণ'। সিঙ্গেল কলামের এ খবরটিকে আমি গুরুত্বে নিয়েছি এ কারণে যে, এর বিবরণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া, অসহিষুষ্ণ মনোভাবের কথা। সামান্য ঘটনায় মারধরের এক পর্যায়ে খুন অবিশ্বাস্য ঠেকে যে, বয়স্ক থেকে তরুণ কিংবা কিশোর পর্যন্ত নানা কারণে (অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক, এমনকি সাংস্কৃতিক ঘটনায়ও) অসহিষুষ্ণ এবং এতটাই যে চেনা মানুষের রক্তে হাত রাঙাতে তাদের বাধে না। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, 'মানুষ মানুষের জন্য' না হয়ে স্বার্থপরের মতো গা বাঁচিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কী করবে? আপনা জান সবকিছুর ওপরে।
আমি বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা জানি- নির্যাতিতকে বাঁচাতে গিয়ে সাহসীর নিজ জান দিতে হয়েছে। কিন্তু এখানে বড় একটি ঘাটতি- কোনো কোনো ঘটনায় বহু মানুষের উপস্থিতি সত্ত্বেও দলেবলে তারা দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে এগিয়ে যায়নি। গেলে সফল হতো। তাই প্রশ্ন :একাত্তর কি আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছিল? তখন তো এর ভিন্ন রূপই দেখেছি।
স্বভাবতই নিরাপত্তা রক্ষকদের অংশবিশেষে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা 'ভোরের কাগজ'-এর একটি সংবাদ শিরোনামে : 'খুনোখুনি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পুলিশ'। অর্থাৎ অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে সামাজিক নৈরাজ্য ও সামাজিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা- নিরাপত্তাহীনতা এখন বড় সামাজিক সমস্যা।
বাংলাদেশে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে হবে, তবেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার কাঙ্ক্ষিত ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর দেশও সন্ত্রাসমুক্ত হবে।

আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক