ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বন সংরক্ষণ ও গাছ লাগানো পরিবেশ রক্ষায় অতীব প্রয়োজনীয়   
Published : Saturday, 16 October, 2021 at 12:00 AM
বন সংরক্ষণ ও গাছ লাগানো পরিবেশ রক্ষায় অতীব প্রয়োজনীয়   অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ||
গাছ লতাগুল্ম বনেবাদাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। বনবাদাড় উজাড় হওয়ায় গাছের বংশবৃদ্ধি কমেছে। বন্যপ্রাণী বনে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। গাছের ফুল ও ফল পাখীকে আকৃষ্ঠ করে বনে আশ্রয় দিচ্ছে। গাছের বিভিন্ন উপাদান ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বনের বিভিন্ন বৃক্ষের সবুজ পাতার ছাউনি ও ডালপালাই হচ্ছে বন্য প্রাণীকুলের ঠিকানা। গবেষকদের কথা বনবাদাড়ের ধংসযজ্ঞের কারণে প্রাণীকুল খাদ্যসংকটে মানুষের বসবাসস্থলে আসতে বাধ্য হচ্ছে। তাতে মানুষ ও প্রাণীকুল উভয়েরই সমস্যা বাড়ছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের জন্য কক্সবাজার-টেকনাফ বন্যভূমির ৭০০ একর জায়গা বরাদ্ধ দিয়ে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনরোধে একটি বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ঐ এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন, বিপন্ন এশিয় বন্যহাতিসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর নিরাপদ বসবাসস্থল এ ঝিলংজা বনভূমি। বনবিভাগ বহুদিন যাবত এ বনের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। ১৯৩৫ সনে তৎকালীন বৃটিশ সরকার ঝিলংজাকে “রক্ষিত বন” ঘোষণা করে। বন আইনানুযায়ী পাহাড় ও ছড়া সমৃদ্ধ এ বনভূমি ইজারা দেয়ার অধিকার শুধু বনবিভাগের । কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ জমি বরাদ্দ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। বন বিভাগ ঝিলংজার এ ভূমি বন্দোবস্তের উপযুক্ত নয় বলে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় বরাদ্দপত্রে দেশের সেরা জীববৈচিত্রসমৃদ্ধ বনভূমিকে অকৃষি খাসজমি হিসেবে দেখিয়েছে। সম্প্রতি হাইকোর্ট ঝিলংজার ৭০০ একর বরাদ্দের কার্যক্রম তিনমাসের জন্য স্থগিত করেছেন। তবে পরিবেশবাদীরা আশা করে শুধু ঝিলংজা নয় দেশের চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের চিরসবুজ বনাঞ্চল যেগুলো বরাদ্দ বা ভূমিদস্যুদের কবলে চলে গেছে সবগুলো উদ্ধার করে বনাঞ্চলে রূপান্তর করার ঘোষণা দিয়ে রূপান্তরের দায়িত্ব বনবিভাগকে অর্পণসহ দেশ সবুজায়নে মাননীয় হাইকোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিক।
আনাস ইবনে মালেক (রা:) বর্নীত এক হাদিসে আছে “গাছ লাগাও, চাষাবাদ কর। এটাও তোমার জন্য সাদাকা বা দান হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ তোমার উৎপন্ন ফসল তো মানুষ বা কোন প্রাণীই খাবে।” বোখারী শরীফের আকেটি হাদিসে লেখা রয়েছে “যদি তুমি নিশ্চিত হও যে, আগামীকাল কেয়ামত হবে তারপরও আজকে যদি তোমার কাছে গাছের একটি বীজ থাকে, তা বপন করো আর চারা থাকলে তা রোপন করো।” অনুরূপ মুসলিম শরীফে উল্লেখিত আছে “ফলদ বনজ ভেষজ- যে কোন গাছ লাগানো সাদাকা। এ গাছ থেকে যত পশু, প্রাণী বা মানুষ উপকৃত হবে, তা সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গাছ রোপনকারীর নামে লেখা হতে থাকবে।”
ছায়াঘেরা, ঘুঘুডাকা সবুজ শ্যামল আমাদের দেশটা আর আগের মত নেই। আমাদের দেশটাকে সবুজ শ্যামল বলা হত যে সকল কারণে তার অন্যতম উপাদানটি হল চারিপার্শ্বে ঘন ঘন গাছ-বৃক্ষরাজি আর সবুজের সমারোহ। বর্তমানে বাংলার সেই সবুজ শ্যামলিমা খুব কমই চোখে পড়ে। সবুজ বৃক্ষরাজি ও ফসলি জমি অকাতরে ধংশের কারণে পাখপাখালিও পূর্বের ন্যায় দৃশ্যত নয়। গাছপালা কেটে ফেলার কারণে পাখীদের আশ্রয়স্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। হরদম গাছপালা কাটা হলে পাখীকুলের বংশবৃদ্ধিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে পরিবেশবাদীরা সবসময় মনে করে। জনসংখ্যার অধিক চাপে ও ব্যাপক নগরায়নে ফসলি জমি উজাড় করে তৈরি হচ্ছে ঘরবাড়ি ও বহুতল ভবন। হরহামেশা কাটা হচ্ছে গাছপালা বন বৃক্ষরাজি। কেউ মানছে না নিয়মনীতি। পরিবেশ তাই-আজ হুমকির মুখে। চতুর্দিকে ব্যাপক হারে গাছপালা ও ফসলী জমি বিলীন হতে থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। খাদ্যভাব প্রকট আকার ধারন করবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগানোর কোন বিকল্প নাই।
আগেকার দিনে চারদিকে যে পরিমাণে গাছপালা দেখা যেত তার তিন ভাগের ১ ভাগও এখন পরিলক্ষিত হয় না। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। এমনিতেই বিজ্ঞানীরা দেশ পানিতে ডুবে যাওয়ার সতর্কবাণী দিয়ে যাচ্ছেন।
আগের দিনে গ্রামাঞ্চলে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, সফেদা, শরীফা, আতা, লেবু, সুপারি, ডালিম, নারিকেল, কলা, আনারস হরেক প্রজাতির ফলের উৎপাদন হত। এখন যে পরিমাণে উৎপাদন হয় তা দিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণ হয় না। কারণ এসব গাছ এখন আর আগের মত দেখা যায় না। বিশেষ করে শরীফা, আতা, সফেদা ও ডালিম এখনকার প্রজন্ম চিনেও না, খায়ও না। ফলবান বৃক্ষ নিধন করে বসতি নির্মান হচ্ছে। শহরে যদিও ছাদে বাগান করার অভ্যাস কিছুটা গড়ে উঠেছে কিন্তু বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝের আঙ্গিনা রক্ষা করে সবুজায়নের কথা আইনে লেখা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বেপরোয়াভাবে গাছ কাটলে তেমন কোন প্রতিবাদও হয় না। ফলে  নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মিছিলে নেমে পড়েছে অনেক অসাধুচক্র।
আজকের দিনের শিশু কিশোরদের কাছে আগের দিনে ফল ফলাদির কথা বললে তারা বিশ্বাসই করতে চায় না। সেইদিন আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য দরকার অধিক হারে বৃক্ষ রোপন। গাছে গাছে ফুলে ফলে ভরে উঠুক আমাদের বাড়ির আঙ্গিনা। স্কুল, প্রতিষ্ঠান, বাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তার পাশে গাছ লাগানোর কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। বৃক্ষ নিধনের কর্মসূচি এভাবে চলমান থাকলে মানবজীবন হুমকির মুখে পড়বে। পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে। দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। পৃথিবী ধংসের মুখোমুখি হবে। তাই গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে  আনতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। “গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান”-এই হোক আমাদের সকলের শ্লোগান। ফসলি বা আবাদী জমি রক্ষা করতে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের মত ছোট দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ফসলি জমি ধংস করে সবাই বাড়ি ঘর নির্মাণ করবে এটাই স্বাভাবিক। ফসলি জমি ও গাছপালা নষ্ট করে ইমারত নির্মাণের ফলে একসময় দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। তাছাড়া এভাবে গাছপালা কমতে থাকলে মানুষ অক্সিজেনের অভাবে ভুগবে। বিশুদ্ধ বায়ুর অভাবে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগের জন্ম নেবে। তাই জনসংখ্যার মত আমাদের প্রধান জাতীয় সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফলে অবাধে গাছকাটা বন্ধ হবে, দেশ আবার সত্যিকার অর্থে সবুজ শ্যামল হয়ে ভরে উঠবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল