জীবনের জন্য পরিবেশ
Published : Saturday, 16 October, 2021 at 12:00 AM
ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ ||
একুশ
শতকের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। বিগত সময়ের সব হিসাব-নিকাশ থেকে যে
ফলাফল বেরিয়ে এসেছে, তা এই ধরিত্রীর জন্য মোটেই সুখকর নয়। দিন দিন শঙ্কা
তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে। ৫০০ কোটি বছরের পুরোনো গ্রহে প্রাণের
আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে। এই সুদীর্ঘ কাল-পরিক্রমায় বহু
প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির আবির্ভাব ও বিলুপ্তি ঘটেছে। তবে প্রাণের
অস্তিত্বের ধারা ব্যাহত হয়নি, নিরবচ্ছিন্ন থেকে গেছে। জীবনের জন্য
অপরিহার্য উপাদানগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক লেনদেনের
মাধ্যমেই চলছে এ প্রবাহ। জীবনপ্রবাহের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। চারপাশের
গাছপালা, জীবজন্তু, মাটি-পানি-বাতাস সবকিছু নিয়েই মানুষের পরিবেশ। পরিবেশের
এই প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং নির্ভরশীলতা এতই বেশি যে,
এদের পরিবর্তন মানব জাতির অস্তিত্বকেও প্রভাবিত করে। মানুষ তার খাদ্য,
বস্ত্র, আবাস, চিকিৎসা- এক কথায় অস্তিত্বের প্রয়োজনে সবকিছুর জন্যই
পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। মানুষসহ অন্যান্য জীবন বেঁচে থাকতে পারে
তাপমাত্রা, আবহাওয়ার অন্যান্য পরিমাপের একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে।
তেমনিভাবে তার জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য এবং উদ্ভিদ প্রাণী ও
পরিবেশের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান আবার
নির্ভরশীল একে অপরের ওপর।
জীবন রক্ষার অধিকার চিরন্তন। জীবনের অধিকার
কথাটি সংযোজিত রয়েছে অনেক রাষ্ট্রের সংবিধান কিংবা গঠনতন্ত্রে। দেশভেদে এর
ব্যাখ্যা কিংবা প্রয়োগ বিভিন্নমুখী হলেও মূল কথা একই। যখন কোনো দেশ তার
কোনো নাগরিকের জীবনের অধিকার রক্ষার কথা ঘোষণা করে, তখন প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষভাবে পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্বভারও এর আওতাধীন হয়। অর্থাৎ
সুস্থ-সুন্দর জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সহনশীল পরিবেশ সংরক্ষণও রাষ্ট্রের
দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জীবনের অধিকার সংরক্ষণ মানে জীবনের জন্য ক্ষতিকর
অবস্থা অথবা হুমকি থেকে তাকে পরিত্রাণ দেওয়া। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (১)
অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি
সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন ...।' সুস্থ
জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় এই নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব যখন রাষ্ট্র গ্রহণ
করে, তখন এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে আরও অনেক ক্ষুদ্র দায়িত্ব। পুষ্টির স্তর
উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নির্ভেজাল খাদ্য,
পরিচ্ছন্ন আবাস, নিঃশ্বাসের জন্য নির্মল বায়ুসহ বিভিন্ন উপাদানের
গ্রহণযোগ্য মাত্রার সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে
'জীবনের অধিকার' সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। এই অধিকার সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ
নিশ্চিতকরণের ব্যাপারেই দিকনির্দেশনা দেয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই জীবনের
অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বিভিন্নভাবে বাস্তবায়নের
প্রচেষ্টাও চালাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে সাংবিধানিক এই দায়িত্ব তুলনামূলক বেশিই
পালিত হয় সেটা শুধু ওই অঞ্চলের অধিবাসীর জন্যই। অপর পক্ষে তৃতীয় বিশ্বে এসব
অধিকার থাকলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্যই। এ জন্য দায়ী করা
হয় অশিক্ষা, অজ্ঞতা, জনসংখ্যার আধিক্য; অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক দুর্বলতা
ইত্যাদিকে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন প্রটোকল, কনভেনশন কিংবা
চুক্তির মাধ্যমে দূষণ কমানো এবং প্রতিরোধের চেষ্টা চালালেও সেটি যথেষ্ট বলে
মনে হচ্ছে না। প্রয়োজন দূষণ সৃষ্টিকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য কিংবা দূষণ
বন্ধে সৃষ্টিকারীরকে দায়ভার নিতে বাধ্য করা। বাংলাদেশে এর আলোকে আইন
থাকলেও বাস্তবায়ন একেবারেই কম। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ট্যানারি দূষণ,
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে শিল্প দূষণ, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে বুড়িগঙ্গা
দূষণ। যথাযথ আইন প্রয়োগ না হওয়ায় এ দূষণ বেড়েই চলেছে। একদিকে শিল্পবিপ্লবের
হাওয়া, অন্যদিকে কৃষিবিপ্লবের উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে
প্রতিনিয়ত মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার। সবুজ বিপ্লবের জোয়ারে দেশে
বিভিন্ন কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহূত হতে থাকে।
সাময়িক লাভের আশায় চিন্তা করা হয়নি- এগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য
ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যেমন ম্যালেরিয়া দমনে আমদানিকৃত ও ব্যবহূত ডিডিটি
এখন পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য নিত্যনতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে। একদিকে
রাসায়নিক সারে জলাভূমি দূষিত হয়ে পড়ায় আমরা হারাচ্ছি মৎস্যসম্পদ, অন্যদিকে
'মাছে-ভাতে বাঙালি'র মাছ নামক প্রাণিজ প্রোটিনের উৎসটির সঙ্গে মানবদেহে
প্রবেশ করছে ক্ষতিকর রাসায়নিক। ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে আমদানিকৃত
৭৬৪ টন ডিডিটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে এখনও ব্যবহূত হচ্ছে। গবেষণায় মায়ের দুধে
ডিডিটির উপস্থিতি প্রমাণ করছে- এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রবাহিত হবে এবং
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হবে।
'জীবনের
অধিকার' রক্ষাকে কেন্দ্র করে আছে অনেক আইন। অভাব শুধু প্রয়োগের। রয়েছে
অনেক প্রতিশ্রুতি, কিন্তু অভাব বাস্তবায়নের। টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব,
শক্তিশালী দেশের যুদ্ধোন্মাদনা প্রতি মুহূর্তে আমাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে
দিচ্ছে। জীবন হয়ে পড়ছে একেবারে মূল্যহীন। তাই এখন প্রয়োজন 'জীবনের অধিকার'
আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।
লেখক:অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়