ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আমার শহর ‘কুমিল্লা’
Published : Tuesday, 31 August, 2021 at 12:00 AM
আমার শহর ‘কুমিল্লা’শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ।  । 
পর্ব-০৯আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় এখন অনেক বড় বড় দোকান, বহুতল বিশিষ্ট শপিংমল। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা সামর্থ্যরে মধ্যে চলে আসায়, জীবন মানের উন্নতি ও রুচিবোধের আধুনিকতায় এবং ভোগবিলাসের প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটেছে। তা অস্বাভাবিক বলা যাবে না।
যেমন ধরা যাউক। এখন সকল পর্যায়ের লোক জুতা ব্যবহার করে। গ্রামে-গঞ্জেও তার প্রচলন হয়ে গেছে। প্রতিজনের একাধিক জোড়া জুতা অবশ্যই আছে, আছে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষাকাল বিবেচনায়। জুতা ব্যবহার যেমন একসময় বিলাসিতা ছিল, এখন তো প্রয়োজন। খালি পায়ে হাটার জন্য তদ্রƒপ পথ বা রাস্তা নেই, রাস্তায় থাকে মাটির সঙ্গে পা আহত হওয়ার মত জিনিসপত্র। ষাটের দশকে জুতা ছিঁড়লে মেরামত করা হতো, এখন ফেলে দেওয়া হয়, নতুন জুতা যে কোনো দামের পাওয়া যায়। এখন পাওয়া যায় নান্দনিক ডিজাইনের জুতা নারী-পুরুষদের। কিন্তু এখনকার জুতা ততটা টেকসই নয়। কুমিল্লায় ষাটের দশকে বাটার জুতার দোকানই প্রধান ছিল। এক জোড়া জুতা কিনলে সহসা ছিঁড়ত না। ছিল জুতা তৈরির দোকান। ইউছুফ স্কুলের রাস্তার পাশে ফানু মিঞার এরূপ একটি দোকান ছিল। কলেজে ভর্তি হয়ে ছয়মাসের মাথায় বাটার ১৫টাকা ১৫আনা দিয়ে এক জোড়া জুতা কিনলাম, ২য় বর্ষে পড়তে গিয়ে যখন শহুরে আধুনিক হয়ে উঠেছি, এ জুতা জোড়া বেমানান হয়ে যায়, কিন্তু ছিঁড়েনি, নতুন জুতার জন্য টাকার কথা বলতে পারিনি। একটু ছোট্ট ইতিহাস আছে।
বাড়ি গেছি। আমাদের কাজের লোক নূর মিঞা শ্বশুরবাড়ি যাবে। সে আমাকে জানায়-আমার জুতা জোড়াটি হাতে করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবে। আবার নিয়ে আসবে, পায়ে দিবে না। আমি রাজি হয়ে যাই। নূর মিঞা জুতা নিয়ে বেড়িয়ে ফিরে আসে, একথা জানাজানি হয়ে যায়। তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তখন সুযোগ নিলাম। বাবাকে বললাম-‘যেহেতু নূর মিঞা জুতাটি ব্যবহার করেছে, আমি আর এগুলো পায়ে দিব না। নতুন জুতা কিনব।’ জানি না, আমার অভিপ্রায়টা ধরতে পারলেনা কিনা, টাকা দিলেন। সে সময় টেডি জুতার প্রচলন শুরু হয়ে গেছে। টেডি পেন্টও।
বর্তমানে জুতা ব্যবহারের প্রাবল্যে জুতার দোকানও যেমন বেড়ে গেছে, মুচি সম্প্রদায়ও তাদের জাত-ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।
এছাড়া সেনিটারি পায়খানা হয়ে যাওয়ায় মেথরগোষ্ঠিও আর তাদের জাত ব্যবসায় বা কাজে নেই। ষাটের দশকে রাত ১০টার পর তো রাস্তায় চলাফেরা করা যেতো না। তখন রাস্তা মেথরদের দখলে।
আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় একসময় নামকরা দর্জির দোকান ছিল। ড্রেসমাস্টার, ড্রেসহাউজ, কান্দিরপাড়ের আজিজ টেইলার, মোগলটুলির রহমান টেইলার ইত্যাদি। এখন তো তৈরি পোষাকের রকমারি বাহার। দর্জির দোকানে যাতায়াত অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়া উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা গেঞ্জিজাতীয় পোষাকই পরে বেশি। ঈদ ও পূজায় বাহারি পোষাকের সমাহার অবশ্যই দৃষ্টি কেড়ে নেয়।
লোকসংখ্যা বেড়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে রোগ-পীড়াও বেড়ে চলেছে, তার সাথে ঔষধের দোকান বা মার্কেটও তো বেড়ে গেছে, চিকিৎসা-সেবার নামে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কলেজও তো অঢেল। আগে ডাক্তারের সংখ্যা কম ছিল, রোগ-পীড়াও কম ছিল, ডাক্তারদের চেম্বার থাকলেও তাঁদেরকে ডাকলে রোগীবাড়ি চলে আসতেন। এখন কোনো ডাক্তারই আর রোগী বাড়ি যান না বা যেতে চান না। এমন কি কম্পাউডারের জন্যও তার কাছে যেতে হয়। এটা অবশ্যই যুগের হাওয়া। গোশালায় যেমন গরু থাকে। তদ্রƒপ রোগী থাকবে হাসপাতালে, বাড়িতে নয়। ডাক্তারের কাছে গেলেই তিনি প্রথমেই বলেন-হাসপাতাল বা কিনিকে ভর্তি করে দেন, তারপর চিকিৎসা। আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম তো হতে পারে না।
ষাটের দশকে এসেও শহর কুমিল্লায় যে সকল হাই স্কুলগুলোকে সচল ও নামী-দামী দেখেছিলাম, তার বিপরীত চিত্রটি এখন স্পষ্ট। ব্রিটিশ আমলে, এমন কি পাকিস্তান আমলেও মহেশবাবুর ঈশ্বর পাঠশালা, আনন্দচন্দ্র রায়ের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলের রমরমা অবস্থা দেখেছি। আজ দু’টি স্কুল অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামে লিপ্ত। অথচ বঙ্গবিদ্যালয়, পরে এখনকার কুমিল্লা হাই স্কুল, নতুন মডার্ণ স্কুল, পুলিশ লাইন হাই স্কুল, রেলওয়ে হাই স্কুল, কোথায় এগিয়ে গেছে। শহর কুমিল্লায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে বেশি। পুরানো ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, শৈলরাণী বালিকা পৌর বিদ্যালয়, আওয়ার লেডী অব ফাতেমা বালিকা বিদ্যালয়ের পাশাপাশি ফরিদা বিদ্যায়তন, চর্থায় লুৎফুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়, জেলাখানার নিকট মালেকা মমতাজ বালিকা বিদ্যালয়, কুমিল্লা হাই স্কুল ও মডার্ণ স্কুলের প্রভাতী বালিকা শাখা ইত্যাদি প্রমাণ করে মেয়েরা লেখাপড়ায় আগ্রহী হয়ে গেছে। শহরে দুটি-মহিলা কলেজ থাকার পরও প্রতিটি ছেলেদের কলেজে অনেক ছাত্রী পড়াশোনা করছে। ছেলেদের জন্য একক কোনো কলেজ নেই শহরে।
আমি বেসরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ছিলাম, পরে সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে ষোলবছর চাকরি করেছি, বেসরকারি মহিলা কলেজে পাঁচবছর ও সরকারি হওয়ার পর চার বছর চাকরি করেছি। এ দু’কলেজ বেসরকারি থাকার সময়ে যে সুনাম অর্জন করেছিল, সরকারি হওয়ার পর (ভিক্টোরিয়া কলেজ ১৯৬৮ ও মহিলা কলেজ ১৯৭৮ সালে) সে সুনাম কি ধারাবাহিকভাবে চলমান? এ কথাগুলো বলছি এই জন্য যে, বেসরকারি আমলে শিক্ষকবৃন্দের সনদের জোর আহামরি ছিল না, আবার পড়াশোনায় কোনো কমতিও ছিল না। তাঁদের যোগ্যতা পরিমাপ করার ক্ষমতা কেউ রাখত না। এখন এ বিষয়টি নিয়ে কথা উঠে বা উঠেছে। এখনকার ছাত্র/ছাত্রীরা চমকপ্রদ ফলাফল অর্জন করে, আগে কেন তদ্রƒপ হয়নি তা গবেষণার বিষয়। তবে এতটুকু জানি- আগে পড়াশোনায় ফাঁকি ছিল না। প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি মান ছিল, এখন যেমন সুউচ্চ মান আছে, একই লেবেশে (পর্যায়) নি¤œাবস্থাও পরিদৃষ্ট হয়। এটাও হয়ত যুগের হাওয়া।
বয়স তো হয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াকালীন প্রায় শিক্ষকই পরলোক গমন করেছেন। আমার জানা মতে দু’জন শিক্ষক এখনও আমার মাথার উপর বেঁচে আছেন-শ্রদ্ধাভাজন প্রফেসর আলী আলী চৌধুরী ও প্রফেসর জাহানারা মুন্সী। আর কেউ বেঁচে আছেন কীনা সন্ধান জানি না। এ দু’জন অভিভাবক বেঁচে আছেন বলেই নিজেকে কম বয়সী মনে করছি।
বয়স কি প্রহেলিকা? না হয় অনেক বন্ধু-চেনাজানা আপনজন তো বেঁচে নেই। এদিক দিয়ে শহরে আমি স্বজনহারা একজন নি:সঙ্গ পথিক। এ শহর কুমিল্লায় সুপারিবাগানেই আমার বিয়ে অনুষ্ঠান হয়, যাকে নিয়ে ঘর বেঁধে ছিলাম, সেও তো এগার বছর আগে না ফেরার দেশে চলে গেছে। বিগত ৬১ বছর আমার শহর ‘কুমিল্লা’ আমাকে দিয়েছে অনেক, এই শহরে থেকেই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছি, শিক্ষকতার চাকরি সূত্রে আমার অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছি, শহরের মাটি ও মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি, গুণিজনের সান্নিধ্যে ঋদ্ধ হয়েছি, সর্বসাধারণের ভালোবাসাও পেয়েছি অঢেল। এ অর্থে ঋণের ভার কম নয়।
    সুপারিবাগানে বিখ্যাত গুহপরিবারে থাকার সুযোগ লাভ করায় তাঁদের সান্নিধ্যে আলোকিত হয়েছি। আমি গ্রামের ছেলে, দরিদ্রপরিবারের সন্তান, গর্বের মধ্যে আমাকে বিকশিত করেছে আমার শিক্ষক পিতা। বাড়িটিও ‘মাস্টারবাড়ি’ বলেই পরিচিত।
    এই গুহপরিবারের বদৌলতে শহর কুমিল্লার ঘনিষ্ঠ হওয়ার অনাবিল সুযোগ পেয়েছি। এমন কি কেউ কেউ মনে করতেন, আমি গুহপরিবারের সন্তান, গুহপরিবার আমাকে সেভাবেই অন্যের কাছে পরিচিতি তুলে ধরতেন। সেজন্য আমার বিয়ের দায়িত্বসহ ভালোমন্দের অনেক বিষয় তাঁদের অধিকারে নিয়ে নেন। আমি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ২৫ মার্চ স্ত্রীসহ এ বাসায়ই অবস্থান করেছিলাম এবং এ বাসা থেকেই ত্রিপুরা চলে যাই। এ বাসার আমার অগ্রজপ্রতিম অশোককুমার গুহকে (বেনু গুহ) ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনীর লোক যখন ধরে নিয়ে যায়, ২২ এপ্রিল বৌদি দু’সন্তানসহ ত্রিপুরায় আমার কাছে চলে যান। তার আগে তাঁদের বড়ছেলেটি আমার স্ত্রীর সঙ্গে ১৩ এপ্রিল, আমি তার আগে ৯ এপ্রিল চলে গিয়েছিলাম। এখন এগুলো স্মৃতি হলেও আমার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য সম্বল, অবলম্বনও বটে। আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় না থাকলে আমাকে কেউ চিনত কি, জানত কি?
ক্রমশ

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫