
চলমান করোনা দুর্যোগের প্রভাবে
প্রায় সব খাতই বিপর্যস্ত। তবে শিক্ষা খাতে এই অভিঘাতের নানামুখী বিরূপ
প্রভাব যে সংকট তৈরি করেছে, তা উদ্বেগজনক। আমরা দেখছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
খোলার একের পর এক তারিখ ঘোষণার পরও অবস্থার আলোকে তা এখনও না খোলায় এক
অনিশ্চিত জীবনে নিপতিত হয়েছে শিক্ষা-সংশ্নিষ্ট সবাই। এর মধ্যে বেসরকারি
শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে
শিক্ষক-কর্মচারীদের দুরবস্থা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। শুক্রবার সমকালে
প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের দেড় বছরের মাথায় এসে
চরম অর্থ সংকটে পড়েছে হাজারো বেসরকারি শিাপ্রতিষ্ঠান। অনেক প্রতিষ্ঠানে
শিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। সমকালের ওই প্রতিবেদনেই উঠে
এসেছে নামিদামি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে স্থায়ী
তহবিল ভেঙে। আবার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের অনেকেরই বেতন কমিয়ে দেওয়া
হয়েছে। আমরা জানি, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় মূলত
শিার্থীদের দেওয়া টিউশন ফির অর্থে। কিন্তু শ্রেণিকে পাঠদান না হওয়ায়
অভিভাবকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নিয়মিত টিউশন ফি না দেওয়ায় বেসরকারি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে অভিভাবকদের তরফেও
করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট নানামুখী সংকটের কথা উঠে এসেছে। আমরা এও জানি,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারকেও সংসার
পরিচালনায় দৈনন্দিন ব্যয়ে অনেক কাটছাঁট করে চলতে হচ্ছে। কারণ, তাদের আয় কমে
গেলেও করোনা দুর্যোগে অনেক খাতে ব্যয় আরও বেড়েছে। বেসরকারি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাও এর বাইরে নন। কোনো কোনো
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টিউশন ফির চাপ দেওয়ার বিষয়টি অনেক অভিভাবকই অনৈতিক
বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়া অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে তাদের
অসন্তুষ্টিও প্রকাশ পেয়েছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, করোনাকালে বেসরকারি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা বেশি সংকটে পড়েছেন।
অভিভাবকদের এও দাবি, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত টিউশন ফি অন্তত ৫০
ভাগ মওকুফ করা। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বক্তব্য, দু'পকেই ছাড় দেওয়ার
কথা আগেই বলা হয়েছে। আমরা ইতোপূর্বে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই লিখেছিলাম, যেসব
অভিভাবকের আয়-রোজগারে টান পড়েছে, তাদের ব্যাপারে ভাবা প্রয়োজন। ফলে উভয়পরে
ব্যাপারেই সরকারকে ভাবতে হবে। আমরা জানি, করোনা সংকটের কারণে এ আশঙ্কাও
দেখা দিয়েছে, অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়বে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিার্থী
ঝরে পড়ার হার কমে গিয়েছিল। আমরা মনে করি, করোনার কারণে যাতে কেউ ঝরে না পড়ে
এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ পদপে নেওয়া দরকার। এর পরও যারা ঝরে পড়বে, তাদের
কীভাবে বিদ্যালয়মুখী করা যায়, সেই কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করা প্রয়োজন। দেশে
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে যেসব বেসরকারি এমপিওভুক্ত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের বড় অংশ আসে
সরকারি কোষাগার থেকে। আবার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক
শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি সুবিধাও পান না। এর বাইরে বেসরকারি মালিকানায় অনেক
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো পুরোপুরি নির্ভরশীল টিউশন ফির ওপর। আমরা
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের মানবেতর পরিস্থিতি
নিরসনে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি প্রত্যাশা করি। আমরা জানি- বেসরকারি স্কুল,
কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ইতোমধ্যে সরকার বিশেষ
অনুদান দিয়েছে। তবে বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে এককালীন হিসাবে এ অনুদান
নিতান্তই অল্প। তার পরও যদি এই অনুদান প্রতি মাসে তারা পেতেন, তাহলে তাদের
কষ্ট অনেকটাই লাঘব হতো। আমরা মনে করি, সংকটাপন্ন শিক্ষক-কর্মচারীদের
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা যেতে পারে।
আমরা সংবাদমাধ্যমেই
দেখেছি, করোনা দুর্যোগে কোনো কোনো শিক্ষক জীবন-জীবিকার তাগিদে সবজি বিক্রি
ও অন্য কাজে নিজেকে যুক্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতির
প্রোপটে শিক্ষক সমাজের বৃহত্তর অংশটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা
নেওয়া প্রয়োজন। মানুষ গড়ার কারিগরদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে কার্যকর পদপে নিতেই
হবে। তাদের পাশাপাশি নতুন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে বই কেনাসহ শিক্ষা
সরঞ্জাম ক্রয় করতে শিক্ষার্থীদেরও অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন হতে পারে। এই
বিবেচনায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তথা পুরো শিক্ষা খাতে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি
সরকার বিবেচনায় নিতে পারে।