
মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ||
বাংলাদেশ
উন্নয়ন অভিযাত্রার গৌরবময় অধ্যায় পার করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
ধারাবাহিক নেতৃত্বে একদিকে অর্থনৈতিক এবং শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই
উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, অন্যদিকে অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে দ্রুত
উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বৃহৎ উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি
একযোগে পরিচালিত হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুস্থ, অসহায় এবং ছিন্নমূল
মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে নানামুখী কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন
ভাবনার অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ
প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহায়ণের সঙ্গে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন,
শিা, পেশাভিত্তিক প্রশিণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম যুক্ত হয়েছে। একটি গৃহ
কীভাবে সামগ্রিক পারিবারিক কল্যাণ এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হতে
পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত 'আশ্রয়ণ' প্রকল্প।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায়
ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেন। তার দেখানো পথেই
বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৭ সালের ১৯ মে দেশের দণি-পূর্ব কক্সবাজার জেলার
সেন্টমার্টিনের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে তিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা দেখে তাদের
পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। ১৯৯৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সমগ্র দেশে শুরু
করেন আশ্রয়ণ প্রকল্প। সর্বশেষ অগ্রগতিসহ ব্যারাক ও একক গৃহে এ পর্যন্ত চার
লাখ ৪২ হাজার ৬০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আওতাধীন সমতলে বসবাসরত ুদ্র নৃতাত্ত্বিক
জনগোষ্ঠীভুক্ত চার হাজার ৮৩২টি পরিবারের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া
হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত আট হাজার ১০৬টি পরিবারকেও ঘর প্রদান করা হয়েছে।
মুজিববর্ষে
এসে দ্রুততম সময়ে গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে গৃহ প্রদানের মাধ্যমে জাতির
পিতা সূচিত গৃহায়ন কর্মসূচিকে নতুনরূপে উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা। জাতির সামনে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পকে অধিকতর যুগোপযোগী ও টেকসই করার
ল্েয বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নতুন ডিজাইনের গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ
করেন। ব্যারাক নির্মাণ কর্মসূচির পাশাপাশি প্রতিটি দুস্থ পরিবারের জন্য ২
শতাংশ জমি প্রদানসহ দুই ক বিশিষ্ট গৃহ, প্রশস্ত বারান্দা, রান্নাঘর ও টয়লেট
নির্মাণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ ল্েয ২৩ জানুয়ারি ২০২১ সালে তিনি
প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারের মালিকানা স্বত্বসহ গৃহ প্রদান
করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ জুন, ২০২১ সালে ৫৩ হাজারের বেশি পরিবারকে
অনুরূপভাবে গৃহ প্রদান করা হয়। এর সঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক পরিবারকে গৃহ
প্রদানের ঘটনা পৃথিবীতে আর কোনো দেশে সম্ভব হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর
উদ্ভাবিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের সঙ্গে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল গোলসের আওতায় গৃহায়ন
কার্যক্রমের বিশেষ সংযোগ রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সব নারী-পুরুষ বিশেষ করে
দরিদ্র ও অরতি (সংস্থাপন) জনগোষ্ঠীর অনুকূলে অর্থনৈতিক সম্পদ ও মৌলিক
সেবা-সুবিধা, জমি ও অন্যান্য সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের কথা বলা
হয়েছে। একই সঙ্গে ুদ্রঋণসহ আর্থিক সেবা প্রাপ্তির েেত্র সম-অধিকার
প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ
নামে ভূমির মালিকানা রেজিস্ট্রি দানপত্রমূলে সরকার কর্তৃক প্রদান করা
হচ্ছে। এেেত্র ভূমিহীন ও গৃহহীন প্রতিবন্ধী, দুস্থ, বিধবা, বয়স্ক
নারী-পুরুষ ও তাদের পরিবারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি
সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ুদ্র ঋণ প্রদানের কার্যক্রম
অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ুর
নেতিবাচক প্রভাবজনিত কারণে গৃহহারা চার হাজার ৪০৯টি দরিদ্র পরিবারের জন্য
কক্সবাজারে খুরুশকুলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। এখানে
তাদের জন্য ১৩৯টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণকাজ চলমান। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ
জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প। ইতোপূর্বে ২০টি ভবনের কাজ
সম্পন্নপূর্বক ৬৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী
দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও ৫০টি বহুতল ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।
পুনর্বাসিত
পরিবারগুলো ইতোপূর্বে ভাসমান জীবনযাপন করার কারণে নানা রকম সংক্রামক
ব্যাধি যেমন- ম্যালেরিয়া, য্ণা ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতো। এছাড়া
সুবিধাবঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠী প্রজনন সংক্রান্ত, মাতৃত্বজনিত,
নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক অসুস্থতার কারণে দুর্বিষহ জীবন যাপন করত।
গৃহায়ণের ফলে তারা বিরূপ এবং প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রা করতে পারছে।
গৃহে অবস্থানের কারণে শিশুদের টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এছাড়া প্রজনন ও
মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সেবা সহজলভ্য হয়েছে। আশ্রয়ণ এলাকাগুলোর
যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সময়মতো স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করাও
অনেক সহজ হবে। আশা করা যায়, এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুও হ্রাস পাবে।
উপকারভোগী
প্রতিটি ভূমিহীন পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে জমির মালিকানা
রেজিস্ট্রি দলিলমূলে প্রদান করা হয়ে থাকে। একই সঙ্গে যৌথ নামে নামপত্তন,
খতিয়ান ও দাখিলা প্রদান করা হয়ে থাকে। ফলে প্রথাসিদ্ধ আইনি কাঠামোর বাইরে
উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের সন্তানদেরও সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। ভূমিহীন এবং
গৃহহীন যে কোনো বয়সের মানুষই এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। সামাজিক যোগাযোগের
জন্য বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া পুকুর খনন
করা এলাকায় সমবায় পদ্ধতিতে মাছচাষ করা হচ্ছে। সরকারি সহায়তায় বিভিন্ন
পেশাভিত্তিক প্রশিণসহ ব্যবসা বা কৃষিকাজের জন্য ুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা
হয়েছে। এছাড়া কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বান্দাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প, হিজড়া
সল্ফপ্রদায়ের জন্য সিরাজগঞ্জ জেলায় উল্লাপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প, দিনাজপুরের
পার্বতীপুর এলাকায় কয়লাখনি শ্রমিক, বরগুনা তালতলী এলাকায় রাখাইন পরিবারের
জন্য বিশেষ টংঘর ও নীলফামারীর সদর উপজেলায় হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য গৃহ
নির্মাণ করা হয়েছে।
বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি
প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরাসরি অর্থনৈতিক তির মধ্যে পড়ে দৃশ্যমান সম্পদ যেমন-
ঘরবাড়ি, েেতর ফসল, গবাদি পশুসহ অন্যান্য অবকাঠামো। সেটা বিবেচেনা করে
প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রতিটি গৃহ তুলনামূলক উঁচু স্থানে নির্মিত হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন বা অতিবৃষ্টির কারণে যাতে গৃহের তি না হয় বা
জনগণের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ না হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখে স্থান নির্বাচন
করা হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আওতায় মাটি ভরাটের জন্যও বিশেষ বরাদ্দ প্রদান
করা হচ্ছে যাতে আবাসস্থলগুলো দুর্যোগ সহনীয় হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের
চরম দারিদ্র্যের (শতকরা ১০.৫ ভাগ) আওতাভুক্ত জনগণই গৃহায়ন কর্মসূচির প্রধান
উপকারভোগী। ফলে, স্বভাবতই দারিদ্র্য বিমোচনে এ প্রকল্প অনন্যসাধারণ। দেশের
পিছিয়ে পড়া এলাকা এ কার্যক্রমের সুবিধা পাচ্ছে। একই সঙ্গে ুদ্র নৃগোষ্ঠী,
পরিচ্ছন্নতাকর্মী, চা শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী.
পরিবেশগত শরণার্থী, প্রতিবন্ধী, খনি শ্রমিক, কুষ্ঠ রোগী এবং অতি দরিদ্র
নারীরা এ কর্মসূচির প্রধান উপকারভোগী। এসব পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য
উপার্জন ও উৎপাদনশীল সম্পদে তাদের প্রাপ্যতা বাড়াতে এবং ন্যূনতম শিা,
স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টির সংস্থান এ কর্মসূচির মাধ্যমে অর্জিত হওয়া সম্ভব।
এসডিজি ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নের ফলে অসমতা কমানো, বিভিন্ন সেবায়
প্রবেশগম্যতা, বিদ্যুৎ ও নিরাপদ পানি প্রাপ্তি এবং নাগরিক মর্যাদাকেন্দ্রিক
বাধা-বিপত্তির অবসান হবে। একই সঙ্গে জেন্ডার ও ুদ্র নৃগোষ্ঠীকেন্দ্রিক
অসমতাগুলো দূরীভূত হবে। শুধু গৃহায়ণের ফলেই কর্মসংস্থান ও উপার্জনের
সুযোগের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
লেখক: সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়