
ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদ ||
১৯৬৫
খ্রিষ্টাব্দ সালের প্রথম দিকে আমি কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে
বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই।আমি স্কুলে নতুন ছাত্র তাই ধীরে ধীরে নবম শ্রেণির
বিভিন্ন শাখার ছাত্রদের সঙ্গে আমার পরিচয় হতে থাকে। নবম শ্রেণির ছাত্র
হুমায়ুন কবীর মজুমদার আমাদের চেয়ে কিছুটা দীর্ঘদেহের অধিকারী ছিল। ফলে
তাঁকে শিক / ছাত্রগন বিশেষভাবে চিনিতেন।
আমার সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়।
১৯৬৭
সালে আমরা মাধ্যমিক পরীা পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক
শাখায় ভর্তি হই। ঐসময়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখার ছাত্র নেতা
সৈয়দ আহমাদ বাকেরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ও এক পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে
যায়। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমি ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনে যুক্ত হই।আমার পূর্বেই
হুমায়ূন কবীর মজুমদার ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে থাকে।
হুমায়ুন
কবীর ছিল সাহসী ও সক্রিয় ছাত্রনেতা।কলেজ জীবনেই ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য
হিসেবে দীা নিয়েছিলাম জনগণের সার্বিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম লড়াই করবো
এবং সততার সঙ্গে জনগণের সেবা করবো। ১৯৬৯ সালের ছাত্রজনতার গনঅভ্যুত্থানে
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র লীগ যৌথভাবে বিশাল
ভূমিকা পালন করে। হুমায়ুন কবীর গনঅভ্যুত্থানে বিশেষ ভূমিকা রাখিয়াছিল।
হুমায়ুন
কবীর কলেজ জীবনেই প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শের বইপত্র সংগ্রহ করে গভীরভাবে
চর্চা শুরু করে। আমাদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে
আলোচনা করতো।ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা আসলে আমরা দেখা করে তাঁদের পরামর্শ
মোতাবেক কাজ করিতাম। সত্তর দশকে কুমিল্লা জেলা ছিল অখ-। আমরা নিয়মিতভাবে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর মহকুমার কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনকে জোরদার করা
জন্য সফর করিতাম।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির
প্রার্থীদের জয়ের জন্য আমরা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা সক্রিয়ভাবে কাজ
করিয়াছি।অখ- কুমিল্লা জেলার ১ নং জাতীয় সংসদের সরাইল নাছিরনগর এলাকার আসনে
ন্যাপের প্রার্থী ছিলেন দেওয়ার মাহবুব আলী কুতুব মিয়া সাহেব। তাঁর
নির্বাচনী প্রতীক ছিল কুঁড়েঘর।
তাঁকে সমর্থন করার জন্য কুমিল্লা জেলার
ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা কুমিল্লা শরহে ভাষা সংগ্রামী ধীরেন্দ্র নাথ
দত্ত মহোদয়ের বাসায় দেখা করে তাঁর সমর্থন চেয়েছিলেন।কারণ ভাষা সংগ্রামী
ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত মহোদয়ের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানা এলাকায়
ছিল। তবে তিনি আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে
আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থন করেন এবং কাজও করেছেন।এই গুরুত্বপূর্ণ
তথ্যটি হুমায়ুন কবীর আমাকে একাধিকবার বলিয়াছে। ভাষা সংগ্রামী ধীরেন্দ্র নাথ
দত্ত মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনার সময়ে হুমায়ুন কবীর উপস্থিত ছিল।

১৯৭১ সালের
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে হুমায়ুন কবীর যোগদান করে। মুক্তি যুদ্ধের
পরে হুমায়ুন কবীর ন্যাশনান আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেয় এবং ঐসময়ে পার্টির কাজে
অনেকবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফরে গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর সরাইলের
আশুগঞ্জ এলাকার এক অভিজাত পরিবারে হুমায়ুন কবীরের বিয়ে হয়েছিল।
হুমায়ুন
কবীর জীবনভর প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করে সাধারণ জীবন যাপন
করেছে।গরীব দরদী মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ ছিলো।১৯৭২ সালের সংবিধানের চায়টি
মূলনীতি তথা জাতীয়তাবাদ গনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেতা প্রতিষ্ঠা
করার জন্য সংগ্রাম লড়াই করেছে।এবিষয়ে আপোষহীন ছিল।
বামধারার রাজনীতির
বিপরযের সময়ে হুমায়ুন কবীর কুমিল্লা শহরে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত
হয়ে সক্রিয়ভাবে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত করার ল্েয কাজ করে।
শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে মূল্যবান
বক্তব্য রাখাতো।তাঁর সঙ্গে আমি অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছি এবং
কাজও করিয়াছি।
হুমায়ুন কবীর বেশ কিছু দিন সরাইলে সরকারি স্থাপনা
প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য ও নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার জন্য আমাদের
ভিক্টোরিয়া কলেজ জীবনের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাত্র ইউনিয়নের নেতা
বুলবুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে।তখন তাঁরা কাজের সুবিধার্থে সরাইলে
আমাদের বড় দেওয়ানপাড়ার বাড়িতে অবস্থান করেছিল।আমার ছোট ভাই হেলাল উদ্দিন
ঠাকুর তাঁদের দেখভাল করিয়াছে।
বাম গনতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের আন্দোলনে
বিভক্তির সময়ে হুমায়ুন কবীর কুমিল্লা জেলার ঐক্য ন্যাপের সভাপতি হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেছে। একসময়ে হুমায়ুন কবীর অসুস্থ হয়ে পরে। তাঁর সুচিকিৎসার
ব্যবস্থা করা হয়েছিল।তখন আমি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছি।এই
অবস্থায় আমি নওয়াব ফয়জুননেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন তাঁর বাসায়
নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করিতাম এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করিতাম।
হুমায়ুন কবীর ছিল একজন অসাধারণ পাঠক। তাঁর নিজস্ব পাঠাগারটি ছিল
সমৃদ্ধশালী।বিরতিহীনভাবে বই পড়ার তাঁর অভ্যাস ছিল। হুমায়ুন কবীর জীবনভর
দূর্নীতি অপসংস্কৃতি ও সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত করার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেছে।
তাঁর
মৃত্যুর পর মুক্তি যুদ্ধের চেতনার পরে সর্বদলীয় শোক সভায় সকল নেতারাই
হুমায়ুন কবীর মজুমদারের সংগ্রামী জীবনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাইয়াছেন।
আমিও আমার ছাত্র জীবনের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু কমরেড হুমায়ুন কবীর
মজুমদারকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।