ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বিদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যরকম কষ্ট...
Published : Wednesday, 9 June, 2021 at 12:00 AM
বিদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যরকম কষ্ট...রেজাউর করিম শামিম ||

আফসা। পুরো নাম আফসা খাকী। ফর্সা,দুধে-আলতা বলতে যা বোঝায়-ঠিক তেমনি গায়ের রং। হালকা-পাতলা গড়নের মেয়েটি। চোখেমুখে স্বজনদের না দেখার তৃষ্ণা কাতর শুকনো অভিব্যক্তি। তবু মুখে হাসি নিয়ে কথা বলে মৃদুস্বরে। করোনকালের পরিবার পরিজন থেকে অনেক দূরদেশে। একা। দীর্ঘ সময় দেখা নেই কারো সঙ্গে। এমবিবিএস-এর শেষ বছরের ছাত্রী।  গেলো বছরই পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিলো। ডাক্তার হয়েই দেশে ফেরার একরাশ স্বপ্ন বুনেছিলো। পরীক্ষা আর হলো কই।
আফসার বাড়ি ভারতের কাস্মীরে। এমনি ভাবে দিল্লীর সোনীয়া, কাস্মীরের শেখ মেহেরসহ আরো অনেক বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী আটকা পড়ে আছে। হোস্টেলে তাদের অনেকটা আটকে পড়া জীবন। খাওয়া-দাওয়াসহ দৈনন্দিন নানা খরচ গুনতে হচ্ছে। কপাল ভালো হোস্টেল বা টিউশনি ফি দিতে হচ্ছেনা। তারপরও আবদ্ধ জীবনের একঘেয়েমী আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। অনেকটাই হতাশা যেন ঘিরে ধরেছে তাদের।
কুমিল্লার ইস্টার্ণ মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীর, এমনি দুর্দশাময় যাপিতজীবনের বাস্তবতা হয়তো অজানাই থেকে যেতো। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেলো কিছু কষ্টের কথা। সবটুকুই কি আর বলা যায় মুখফুটে? শত হলেও বিদেশি বলে কথা। তারপরে আবার অনেকেই কাস্মীরের নাগরিক।
কুমিল্লা মহানগর থেকে একটু দূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়াই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি গড়ে উঠেছে। এই পথে কতবার যে আসা-যাওয়া। এর সাইনবোর্ডও চোখে পড়েছে অনেক। কিন্তু কোনদিন দেখা হয়নি ভেতরে গিয়ে। করোনাকালে শিক্ষাঙ্গন সবচাইতে ক্ষতির সম্মুক্ষিন। কতটা ক্ষতি? তার পরিমাপ হয়তো কোনদিনই হবেনা। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাজীবনে মূল্যবান সময় হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। নানা ধরনের সামাজিক-মানসিক বৈকল্যে শিকার অনেকেই। শিক্ষক-অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান -সকলেই আর্থীক-নৈতিক-সামাজিক এমনি কোন না কোন ভাবে ক্ষতির সম্মুক্ষিণ। অনেক শিক্ষককেই আর্থীক অনটনে পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন-তেমনি সচিত্রও খবর হচ্ছে পত্রিকায়।
প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতিও কিন্তু অসামান্য। সেদিন মেডিকেল কলেজটি দেখলাম কি অপরূপ সুন্দর,প্রযুক্তিগত এবং স্থাপত্যগত উৎকর্ষতার সমন্বয়ে নির্মীত হয়েছে এর অবকাঠামো। সেই সাথে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে তোলা হয়েছে পারিপার্শিক নান্দনিক সবুজায়ন। সুইমংপুলের আদলে করা হয়েছে বেশ বড়সর পুকুর। ছোট ছোট কটেজের আদলে রয়েছে বসবার অপরূপ ব্যবস্থা।
মেডিকেল কলেজটি পুরোপুরিই আবাসিক। সাত শতাধিক ছাত্রছাত্রীর স্থানসঙ্কুলানের ব্যবস্থা সম্বলিত বিশাল দু‘টি হোস্টেল রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পৃথক হোস্টেলগুলোর নামকরণ করা হয়েছে কুমিল্লার ঐতিহ্যের ধারক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের নামে। ছেলেদের হোস্টেলের নাম রাখা হয়েছে,ইস্টব্যঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা কুমিল্লার কৃতিসন্তান বঙ্গসার্দুল মেজর গণির নামে। আর মেয়েদেরটি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে শহীদ কুমিল্লার শান্তি-সুনীতির নামে।
পৃথক পৃথক জিম থেকে শুরু করে কমন রুম,বিভিন্ন খেলধুলার যে বিশাল সব আয়োজন, সে সবের সরঞ্জামাদি-সবকিছু অনড় অবস্থায় পড়ে রয়েছে। পড়ে থাকায় ধূলোর স্তর ভারি হচ্ছে। একই অবস্থা এ্যনাটমিরসহ বিভিন্ন ল্যবরেটরির দামীসব যন্ত্রপাতি, লাশ থেকে শুরু করে অন্যান্য জরুরি সব উপকরণ। মাঝেমধ্যে শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্টরা এগুলো নাড়াচাড়া করেন। ছাপছুত্র করেন। কিন্তু করোনার কারণে শিক্ষাদান বন্ধ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা  শিক্ষার্থীরা  ক্যাম্পাস খালি করে যার যার অবস্থানে চলে গেছে। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই এক পাশে মনোরম ভাবে সাজানো ‘বিজয় মঞ্চ’ নামে স্থায়ী মঞ্চ, আর নানা গাছে সাজানো সবুজায়নকৃত বাগানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি-সবই যেন নীরব। অপেক্ষমান। আবার কখন আসবে শিক্ষার্থীরা।
তবে সচল রয়েছে তাদের ২৪ ঘন্টা বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত সেবা প্রদানকারী হাসপাতালটি। ছয়শত শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটিতে এখন করোনা চিকিৎসার জন্যে পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্বল্প ব্যয় এবং সাশ্রয়ীমূলে সহজলভ্য হওয়ায় বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চর থেকে রোগী এখানে আসেন। শহরে না গিয়ে তারা এখানেই সমমানের চিকিৎসা পাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানালেন।
দেশে অনেকগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ইতিমধ্যেই গড়ে গড়ে উঠেছে। তবে এত বিশাল এলাকাজুড়ে এতসব অত্যধুনিক সুবিধা সম্বলিত আর মনোরম নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ মেডিকেল কলেজ আর একটি আছে বলে মনে হয়না। প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্টার ডাঃ মাইনুল ইসলাম,এনাটমি বিভাগের শিক্ষক ডাঃ ফাতেমা রহমান,সহকারি পরিচালক ডাঃ দেবশীষ,সহকারি নির্বাহী কর্মকর্তা আছরাবুল আজিজ,গণসংযোগ কর্মকর্তা গাজী রেজাউল কবির মেজবাহ, এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাগ্রহণ শেষে উচ্চতির শিক্ষা গ্রহণরত প্রথম বিদেশি (নেপলী) ছাত্র ডাঃ কৃষ্ণা আইরি সঙ্গে থেকে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখান এবং বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যন ড. শাহ্ মোহাম্মদ সেলিমের সাথে কথা হয় টেরিফোনে। প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে, বিশেষ করে বিদেশি শিক্ষার্থী প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেন। তিনি জানান,কুমিল্লার পরিচিতমুখ আরো তিনজন ডাক্তার মিলে শ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি তিলে তিলে গড়ে তোলা হয়ছে। অন্য ডাক্তারগণ হলেন,প্রফেসার ডাঃ মোসলেহউদ্দিন, প্রফেসার ডাঃ কলিমউল্লাহ ও ডাঃ কুদ্দুস আকন্দ। তিনি জানান, তিনি যখন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, তখই তিনি সরকারের অনুমোদন নিয়ে, ভারতের বিভিন্ন স্থানে যান। সেখানে বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে সেমিনার করেন। এত মেডিকেলে পড়তে ইচ্ছুক সেখানকার শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আর তারই ফলশ্রুতিতে আজ ভারতের বিভিন্ন স্থানের ছেলেমেয়েরা মেডিকেলে পড়তে বাংলাদেশে আসে। এখান থেকে পাশ করার পর তারা তাদের দেশে ফিরে গেলে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। আর এ প‌যর্ন্ত সেখানকার পরীক্ষায় তারা ভালো ফলাফল করে আসছে। এর ফলেই আমাদের এখানকার লেখাপড়ার মান ও আনুসঙ্গিক সুবিধাদির উপর তাদের আস্থা বেড়েছে। তিনি জানান এ পর্যন্ত তাদের প্রতিষ্ঠানে নেপালের ১৫ জনসহ ভারতের ২৭০জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে গতবছর চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা বিপাকে পড়েছে। করোনার কারণে পরীক্ষা না হওয়ায় তাদের এই বিব্রতকর অবস্থয় পড়তে হয়েছে।
এসব বিদেশি ছাত্রছাত্রীগণ এতদিন তাদের দেশের পোষাক-আসাক থেকে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে মাতিয়ে রাখতো ক্যম্পাস। তাদের সঙ্গি হতো এদেশের শিক্ষার্থীরা। অথচ দেশের ছাত্রছাত্রীরা ক্যম্পাস ছেড়ে বাড়িতে পরিবারের কাছে চলে গেছে অনেক আগেই। আটকে পড়ে আছে শুধু আফসার মতো বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা। লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া,শহরে ঘোরাঘুরি,মার্কেটিং কিংবা নিরাপত্তার কোন সমস্যা নেই,কষ্টও নেই। আছে অন্যরকম এক কষ্ট। আর তা হলো কবে হবে পরীক্ষা, কবে যাবে দেশে ফিরে আপনজনের কাছে।