
অধ্যাপক ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ ||
[১৭ মে ’বিশ^ হাইপারটেনশন দিবস’। এবছরের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ’আপনার রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণ করুন, বেশীদিন বাঁচুন’।]
উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের এক নম্বর কারণ এবং হৃদরোগেরও অন্যতম প্রধান ঝুঁকির কারণ। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে প্রতিদিন রক্তচাপ কমানোর বড়ি গ্রহণের মাধ্যমে সকল প্রাপ্তবয়স্করা উপকৃত হতে পারেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় গবেষণামূলক পর্যালোচনা শেষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, রক্তচাপ হ্রাস করা হৃদরোগ প্রতিরোধমূলক, এমনকি যখন কারো রক্তচাপ স্বাভাবিক পরিসীমার মধ্যে থাকে তখনও।
একটি দৃষ্টান্তমূলক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, প্রতিদিন অন্তত একটি প্রেসারের বড়ি গুরুতর কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি প্রায় ১০ শতাংশ কমায়। মজার ব্যাপার হলো কোনও ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপের পরিমান কত সেই বিবেচনা ব্যাতিরেকেই প্রেসারের ওষুধ খাওয়া শুরু করে একই ফলাফল পাওয়া গেছে।
দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণালব্ধ তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে সম্ভাব্য কয়েক মিলিয়ন মানুষ যাদের হয়তো বর্তমানে রক্তচাপ কমানোর জন্য ওষুধের প্রয়োজন নেই তারাও এসিই ইনহিবিটর, এমলোডিপিন এবং বিভিন্ন ধরণের বিটা-ব্লকার জাতীয় নির্ধারিত অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ থেকে উপকৃত হতে পারেন।
বৃটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে বলে মনে করা হয়, যার মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের এই রোগ অনির্ণীত অবস্থায় আছে। হাইপারটেনশন চিকিৎসার গাইডলাইনগুলি বলছে যে, উচ্চ রক্তচাপ সম্পন্ন ব্যক্তি যাদের প্রেসার- ১৪০/৯০ মিমি অব মারকারি’র উপরে - সাধারণত তাদেরই অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধের জন্য বিবেচনা করা উচিত।
তবে, ৪৮ টি র্যান্ডমাইজ্ড কিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে ৩৪৪৭১৬ লোকের মধ্যে করা একটি নতুন সমীায় দেখা গেছে যে, রক্তচাপের মাত্রা নয় বরং কোনও ব্যক্তির েেত্র তার রক্তচাপের আপেকি বৃদ্ধি বা হ্রাসের পরিমাণই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি নির্ধারণ করে।
নতুন এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ১৫৭,৭২৮ জন যাদের পূর্বে অন্তত একবার কার্ডিওভাসকুলার রোগ হয়েছিল এবং ১৮৬,৯৮৮ জনের পূর্বে কোনও কার্ডিওভাসকুলার রোগ ছিল না। প্রতিটি গ্রুপকে আবার তাদের সিস্টোলিক প্রেসারের স্তরের উপর ভিত্তি করে সাতটি সাব গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল।
চার বছরের ফলোআপের পরে দেখা গেল, ৪২,৩২৪ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে কমপে একটি বড় ধরণের কার্ডিওভাসকুলার ইভেন্ট বা হৃদরোগের ঘটনা ঘটেছিল। তবে তাদের সিস্টোলিক প্রেসার প্রতি ৫ মিমি অব মারকারি হ্রাসের ফলে স্ট্রোক ও হার্ট ফেইলিওর হওয়ার ঝুঁকি ১৩ শতাংশ, ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ আট শতাংশ এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যু পাঁচ শতাংশ কমেছে। আর চিকিৎসার এই উপকারী প্রভাবগুলি ওই সকল ব্যক্তিদের ইতোপূর্বে কার্ডিওভাসকুলার রোগ ছিল কিনা তার ভিত্তিতে কিন্তু বিবেচিত হয়নি।এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে, ওই সকল ব্যাক্তিদের প্রেসারের ওষুধ গ্রহনের ভিত্তি হিসেবে রক্তচাপের মাত্রার চেয়ে হৃদরোগের ঝুঁকির বিষয়কে প্রধান্য দেয়া হয়েছে।
তবে এটি হৃদরোগের খুব কম ঝুঁকিযুক্ত লোকদের জন্য প্রযোজ্য নয় মন্তব্য করে গবেষকরা চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত সকল প্রাপ্তবয়স্কদের প্রেসারের বড়ি খাওয়া শুরু না করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তাঁরা আরও বলেছেন যে, ওষুধ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চিকিৎসকদের আপাত স্বাভবিক রক্তচাপকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং রোগীর কোলেস্টেরলের মাত্রা, বয়স এবং ডায়াবেটিসের মতো বিষয়গুলি বিবেচনা করে রোগীর হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি মূল্যায়ন করা উচিত। মানুষের হৃদরোগের ঝুঁকির উপর ভিত্তি করে তাদের রক্তচাপকে চিকিৎসার যোগ্য বা ল্য হিসাবে বিবেচনা করা জরুরী।
হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক শুধু পশ্চিমা বিশ্বেই নয় বরং বর্তমানে সারা বিশে^ মৃত্যুর এক নম্বর কারণ, এবং এটি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য যে রক্তচাপ কমানোর ওষুধগুলি এমন লোকদের সুরা দেয় যাঁদের পূর্বে একবার কার্ডিওভাস্কুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে এবং তাদের দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচায়। তবে, স্বাভাবিক বা কেবলমাত্র সামান্য উচ্চরক্তচাপ যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ওষুধের ব্যবহার নিয়ে এখনও বিতর্ক হয়েছে।
তবে এটি ঠিক যে, আপনার আগে থেকে হৃদরোগ থাকুক আর নাই থাকুক আপনার রক্তচাপ কমানোর সুবিধা অবশ্যই রয়েছে। তবে এই গবেষণাটিতে দেখা যায় যে রক্তচাপ স্বাভাবিক রেঞ্জের মধ্যে থাকা ব্যাক্তিরও রক্তচাপ হ্রাসের কারণে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।
আমাদের অবশ্যই হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশিকা অর্থাৎ গাইডলাইন মেনে চলতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান বন্ধ করা এবং - যেখানে প্রয়োজন - ওষুধ গ্রহণ।
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন কুমিল্লা