
এ,বি,এম আতিকুর রহমান বাশার ঃ
কুমিল্লার
দেবীদ্বারের আবাসিক ফ্যাট থেকে গৃহবধূ তাছলিমা আক্তারের অর্ধগলিত মরদেহ
উদ্ধারের ৩ ঘন্টার মধ্যেই হত্যাকারীকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। পারিবারিক
বিরোধের জের ধরেই তার স্বামী রবিউল্লাহ তাকে গলায় ওড়না পেচিয়ে শ^াস রোধে
হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ওই ঘটনায় শুক্রবার দিবাগত রাতে নিহত
তাছলিমার ছোট ভাই মুরাদনগর উপজেলার নোয়াঁগাও গ্রামের মিয়াবাড়ির মো. হোসেন
মিয়ার পুত্র মোরগ ব্যবসায়ি মো. সজিবুর রহমান বাদী হয়ে তার ভগ্নীপতি
দেবদ্বীার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের আব্দুস সালামের পুত্র সিএনজি চালক মো.
রবিউল্লাহ(৩৫)কে একমাত্র আসামী করে দেবীদ্বার থানায় ৩০২ ও ৩৩৪ ধারায় একটি
হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-৩৫, তারিখ- ৩০/০৪/২০২১ইং।
শনিবার
সকাল ১১টায় মামলার আসামী মো. রবিউল্লাহকে কুমিল্লা ৪নং বিচারিক আদালতে
হাজির করা হয়। বিকেল ৪টায় আদালতে বিচারক গোলাম মাহবুব খান’র জিজ্ঞাসাবাদে
অভিযুক্ত রবিউল্লাহ একাই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার সত্যতা স্বীকার করে।
বিচারক গোলাম মাহবুব খান রবিউল্লাহর দেয়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নথিভূক্ত
করে তাকে কারাগারে পাঠাবার নির্দেশ দেন।
বাদী মো. সজিবুর রহমান মামলার
বিররনীতে উল্লেখ করেন,- আমার বোন তাছলিমার পূর্বে আরো ২টি বিয়ে হয়েছিল, ওই
দুই সংসারের সাগর(১৯) ও রাফি (৬) নামে ২ পুত্র ও বর্তমান সংসারে ৭ মাস বয়সী
সাকিল নামে এক পুত্র রয়েছে। প্রায় ২২বছর পূর্বে প্রথম বিয়ে হয়েছিল
মুরাদনগর উপজেলার বাখরনগর মৃত: আউয়ার’র পুত্র সিএনজি চালক রবিউল’র সাথে।
তার প্রথম স্বামী রবিউল মদ, গাঁজা খেয়ে তাছলিমার উপর খুব অত্যাচার চালাত,
এক পর্যায়ে সাগর নামে এক পুত্র সন্তান থাকা সত্বেও তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে
যায়। পুত্র সাগর(১৯) বর্তমানে কাতার প্রবাসী। প্রায় ৭/৮ বছর পূর্বে
দ্বিতীয় বিয়ে হয় একই উপজেলার দিলালপুর গ্রামের দুবাই প্রবাসী মনির হোসেন’র
সাথে, এ সংসারে রাফি নামে ৬ বছরের এক পুত্র সন্তান রয়েছে। এ বিয়েটাও
বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। প্রায় ৩ বছর পূর্বে দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর
গ্রামের আঃ সালাম’র পুত্র ্িসএনজি চালক রবিউল্লাহর সাথে পরকিয়ার সংবাদে
মনির হোসেন তাকে তালাক দিয়ে দেয়। তালাকের এক বছর পর রবিউলের সাথে তাছলিমার
বিয়ে হয়। তাদের এ সংসারেও মো. শাকিল নামে ৭ মাসের আরো এক পুত্র সন্তান
রয়েছে।
তার ভগ্নীপতি দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের আঃ সালামের
পুত্র রবিউল্লাহ(৩৫)’র সম্পর্কে মামলার বাদী সজিব আরো বলেন, রবিউল্লাহর
একাধিক বিয়ে করার অভিযোগ রয়েছে। রবিউল্লাহ প্রায় ১৮বছর পূর্বে নিজ গ্রামের
নজরুল ইসলামের কণ্যা লিপি আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের পারভেজ(১৬), রাসেল(১৩)
ও সাগর(১০) নামে ৩ পুত্র সন্তান রয়েছে।
সজিব আরো জানান, কাতার প্রবাসী
ভাগিনা সাগর বাড়ি করার জন্য পাঠানো নগদ টাকা ও স্বর্নালঙ্কার আত্মসাতের
জন্যই রবিউল্লাহ পরিকল্পিতভাবে নাম ঠিকানা ছাড়াই অত্যন্ত গোপনে দেবীদ্বারে
বাসা ভাড়া নিয়ে তার বোনকে হত্যা করে এখানে তালাবন্ধী অবস্থায় লোকিয়ে রেখে
নিখোঁজ নাটক সাজিয়ে আমাদের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকে। এরই মধ্যে গোপনে
মুরাদনগর থানায় গত ২৭ এপ্রিল স্ত্রি টাকা- পয়সা, গহনা নিয়ে নিখোঁজের ঘটনায়
একটি সাধারন ডায়েরী করেছিল। (জিডি নং ৯৬৩, তারিখ- ২৭/০৪/২০২১ইং।)
কুয়েত
প্রবাসী আমার ভাগিনা সোহাগ তার মায়ের মাধ্যমে মুরাদনগর উপজেলার ছবিনগর
গ্রামে কিছু জমি ক্রয় করে ওখানে বাড়ি নির্মানের পরিকল্পনা নেয়। গত ২৪
এপ্রিল দিলালপুর ওই জমিতে বাড়ি নির্মানের জন্য সকাল ৭টা থেকে বেলা একটা
পর্যন্ত মাপঝোপ হয়েছে। ওই সময় বোন ও বোন জামাই আমার সাথেই ছিল, তার পর আর
তার সাথে দেখা ও কথা হয়নি। বাড়ি নির্মানের টাকা আত্মসাৎ করতেই রবিউল্লাহ
আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা
দেবীদ্বার থানার উপ-পরিদর্শক(এস,আই) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, পারিবারিক
কলহের জের ধরেই তাছলিমাকে তার স্বামী গলায় গামছা পেচিয়ে শ^াসরোধ করে হত্যা
করেছে। ব্যক্তি জীবনে নিহত তাছলিমা মো. রবিউল্লাহ(৩৫)’র দ্বিতীয় স্ত্রী এবং
রবিউল্লাহ তাছলিমার তৃতীয় স্বামী। ওরা মাদক ও নারী ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল।
আদালতে আসামী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
পুলিশ ও
স্থানীয়রা আরো জানান, রবিউল্লাহ ও তাছলিমা, মুরাদনগর উপজেলা সদর মধ্যপাড়া
টাওয়ারের সাথে ভাড়া বাসায় থাকত, উপরন্ত গত ১৯ এপ্রিল অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে
দেবীদ্বারে আরো একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিল। যা স্বামী- স্ত্রী ছাড়া উভয়
পরিবারের আর কেউ জানতনা। এসব বাসায় অন্যদের চোখ ফাঁকী দিয়ে মাদক ব্যবসা ও
দেহ ব্যবসা পরিচালনা করত বলেওজানান পুলিশ। রবিউল্লাহ যেমন তার স্ত্রীকে
মারধর করত তেমনি তাছলিমাও তার স্বামী রবিউল্লাহকে মারধর করত। রবিউল্লাহ তার
স্ত্রীর বেপড়–য়া চলাফেরা পছন্দ করত না, এনিয়ে তাছলিমাকে তার স্বামী
অনেকদিন বাঁধাদান ও সতর্ক করেছিল। তাছলিমা রুপে অহংকারী ছিল। তা ছাড়া বিয়ের
কাবিন নামায় ১০লক্ষ টাকা থাকায়, স্বামীকে যখন তখন হুমকী দিত, স্বাধীনভাবে
চলত।
ঘটনার দিনও (২৪ এপ্রিল) তাছলিমা সেঝেগুঁজে বাসা থেকে বের হতে
চাইলে, তার স্বামী- কোথায় যাবে তা জানতে চায়, উত্তরে জানায় আমার যেখানে
খুশী সেখানে যাব। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্বামীর গালে চর মারে। এসময় তার
স্বামী রবিউল্লাহ ক্ষুব্ধ হয়ে গলায় থাকা উড়না দিয়ে পেঁচিয়ে শ^াস রোধ করে
হত্যা করে এবং ওড়নাটি সিলিং ফ্যানে বেঁধে ওই বাসায় তালা লাগিয়ে কোলের
শিশুটিকে নিয়ে পালিয়ে মুরাদনগরের বাসায় চলে যায়। মুরাদনগরের বাসার চাবি না
থাাকায় পাশের বাসার এক নিকট আত্মীয়ের কাছে বাচ্চাটিকে রেখে রবিউল্লাহ চলে
যায়। সন্ধ্যার পরও বাচ্চার মা’ বাবা কেউ না আসায় এবং এদের ফোনেও না পাওয়ায়,
তাছলিমার বাবার বাড়িতে ফোন করে বিষয়টি জানালে ওরা এসে বাচ্চাটি নিয়ে যায়।
রাতে রবিউল্লাহ শ^শুর বাড়িতে যেয়ে বলে তার স্ত্রী তাকে মারধর করে টাকা,
পয়সা গহনা নিয়ে পালিয়েছে।
লাশের পাশ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল সেটের ফোন
নম্বরে ফোন করে জানতে পারে রবিউল্লাহ তার শ^শুর বাড়িতে, পুলিশ ওখান থেকে
রবিউলকে আটক করে নিয়ে আসে।
উল্লেখ্য গত বৃহস্পতিবার (২৯এপ্রিল)
সন্ধ্যায় ওই ফাট থেকে তিব্র দূর্গন্ধ ছড়াতে থাকলে অন্যান্য ফাটের
ভাড়াটিয়ারা বাড়ির মালিকের নিকট অভিযোগ করলে, বাড়ির মালিকের পক্ষ থেকে
বিষয়টি থানা পুলিশকে জানানো হলে, দেবীদ্বার থানার উপ-পরিদর্শক (এস,আই) মো.
ওমর ফারুক’র নেতৃত্বে একদল পুলিশ এসে রাত সাড়ে ১০টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত
অভিযান চালিয়ে পৌরসভার গোমতী আবাসিক এলাকার পূর্ববানিয়াপাড়া গ্রামের সাবেক
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হাজী মো. আব্দুল ওয়াহেদ’র মালিকানাধীন ২৮/১নং
বাড়ি ‘পুষ্পকুঞ্জ’র ৪র্থ তলার পূর্বপাশের ফ্যাট থেকে ওই গৃহবধূর মরদেহ
উদ্ধার করা হয়।
লাশ উদ্ধার হওয়ার সময় নিহতার পরনে সেলোয়ার, কামিজ ও
খয়েরি রং এর বোখড়া ছিল, তাছলিমা তখন উপুড় হয়ে ও মাথাগুঁজা অবস্থায় দেহের
অর্ধেক খাটে ও পা’গুলো মেঝেতে পড়েছিল, পায়ের অংশে প্রচুর রক্তক্ষরণের চিহ্ন
ছিল। আত্মহত্যার চিহ্ন হিসেবে মরদেহের বরাবর উপরে ফ্যানের সাথে বাঁধা একটি
সাদা ওড়নাও ছিল। ওই মহিলার মোবাইল সেটসহ বিভিন্ন আলামত হিসাবে জব্দ করেছে
পুলিশ।
খবর পেয়ে দেবীদ্বার-ব্রাহ্মণপাড়া সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার
(এএসপি) মো. আমিরুল্লাহ, দেবীদ্বার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো.
মেজবাহ উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। রাতেই পিবিআই ও সিআইডির দু’টি টিম
আসে। তারা রাতেই উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোন ট্রেক করে নিহত গৃহবধূর পরিচয় পান
এবং রাতেই ওই মহিলার স্বামী দেবীদ্বার উপজেলার ওয়াহেদপুর গ্রামের
রবিউল্লাহকে তার শ^শুরবাড়ি মুরাদনগর উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রাম থেকে আটক সহ
রাত দেড়টায় নিহতার মরদেহ সহ থানায় নিয়ে আসেন পুলিশ।
বাড়ির মালিকের ছেলে
মো. শাহাদাত হোসেন জানান, বাড়িতে টু-লেট দেখে চলতি মাসের ১৮ তারিখ স্বামী
রবিউল্লাহ (৩৫)-স্ত্রী তাছলিমা(৪০) ও ৬ বছর বয়সী এক পুত্র সন্তান নিয়ে
বাড়ির ৪র্থ তলার এ ফ্যাটটি ৫হাজার ৫শত টাকায় ভাড়া নেন। এরই মধ্যে ভাড়া নেয়া
৩ কক্ষের ফাটের ২টি কক্ষে দু’টি খাট, আলনা ও কিছু তৈজস সামগ্রী নিয়ে আসে
এবং গোছিয়ে বাসাটি পরিপাটি করে রাখে। ভাড়াটিয়া পুরুষটি জানান, সে কুমিল্লায়
জব করেন, তাদের বাড়ি মুরাদনগর উপজেলায়। ভাড়া নেয়ার সময় (ভোটার) এনআইডি
কার্ড ও অগ্রিম টাকা চাওয়ায়, একটি এনআইডি কার্ড দেখিয়ে বলে এটি ফটোকপি করে
২৪ এপ্রিল অগ্রিম টাকা সহ দিয়ে যাওয়ার কথা বলে উধাউ হয়ে যায় এবং মোবাইলের
সংযােগও বন্ধ করে রাখে।