ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথা
Published : Tuesday, 27 April, 2021 at 12:00 AM
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথাশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
তৃতীয় পর্ব
আলী আকবর খান সম্পর্কে আরো কিছুকথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। তিনি নজরুল ইসলামের প্রতিভার স্বরূপ প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাঁর পুস্তক ব্যবসায় শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনায় ‘লিচুচোর’ কবিতাটি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন। এই একটিমাত্র কবিতা-রচনায় আলী আকবর খান মুগ্ধ হলেন এবং কবিকে নিজের অধিকারে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি তখনই উপলব্ধি করেছিলেন, কালে নজরুল ইসলাম বিরাট একটা কিছু থাকে। এধারায় দেখি, আলী আকবর খান যখন নার্গিসের সঙ্গে নজরুল ইসলামের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন, তখন বোনকে (নার্গিসের মা) এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে,
‘তোমার মেয়েকে পাত্র (নজরুল ইসলাম) পছন্দ করেছে। বর্তমানে যে কোন উপায়ে এই কাজীকে আটকিয়ে রাখিতেই হইবে। এই কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবী বিখ্যাত এক দার্শনিক কবি হইবে। তাহার নমুনা আমরা পাইয়াছি। ... ভবিষ্যতের জন্য একটা পথ আবিষ্কার হইতে পারে তাহাতে সারা জীবন সুখে থাকিতে পারিবে।’
[মুন্সী আবদুল জব্বার-এর ভাষ্য]
নজরুল ইসলামকে নিয়ে আলী আকবর খানের এসকল বক্তব্য তখনকার সময়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনে হলেও পরবর্তীতে খানসাহেবের মূল্যায়ন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে। সুতরাং আলী আকবর খানকে নিয়ে আমাদের অর্থাৎ কুমিল্লাবাসীর মূল্যায়ন সংগতকারণেই ভিন্নতর ও ইতিবাচক।
    নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় শতবর্ষ আগে আগমনের প্রেক্ষাপট ছিল আকস্মিক। তারপরও নানাভাবে এই আগমনকে আজ বিমোহিতচিত্তে স্মরণ করতে গিয়ে আপ্লুত হতে হয়। সে সময় নজরুল ইসলামের জীবনে কুমিল্লায় মাতৃস্থানীয় পাঁচজন নারীর সান্নিধ্য ছিল ঐতিহাসিক ও উল্লেখযোগ্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা জানি- কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী, বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের মা বিরজাসুন্দরীদেবীকে নজরুল ইসলাম প্রথম দর্শনেই ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। এই সম্বোধন কোনো পোষাকী আবেগ ছিল না। সত্যিকারের মাতৃস্থানীয় আসনে চিরকালীন বা শাশ্বত মর্যাদায় আজীবন জাগ্রত ছিল। এই ইতিহাসের পরিক্রমা দীর্ঘ ও অনুপম। দৌলতপুরে যখন নজরুল ইসলামের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে ঠিক হয়, তখন নজরুল বিরজাসুন্দরীদেবীকে চিঠি লিখলেন-
    ‘মা. তুমি না এলে আমার পক্ষে ত কেউ থাকছে না।
    তোমাকে আসতেই হবে।’
আবার আলী আকবর খান যখন কোলকাতায় গিয়ে নজরুল ইসলামকে ফিরিয়ে নিতে টাকার লোভ দেখালেন এবং ব্যর্থ হয়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন। তখনও নজরুল বিরজাসুন্দরীকে চিঠিতে লিখলেন-
    ‘মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল।’
নজরুল ইসলাম যখন জেলখানায় আমরণ অনশন শুরু করলেন, তখন গর্ভধারিণী মা জাহেদা খাতুন চুরুলিয়া থেকে অনশন ভাঙানোর জন্য জেল গেটে গিয়েছিলেন, নজরুল মার সঙ্গে দেখা করেননি। অন্যদিকে এই অনশনের কথা যখন কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরীদেবী শুনলেন, সেদিন থেকে তিনিও অনশন করে একজন সঙ্গী নিয়ে জেল গেটে উপস্থিত হলেন। নজরুল তাঁকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। অনশন ভাঙার জন্য মাতৃ-আদেশ পালন করতে হলো এবং মা বিরজাসুন্দরীদেবীর হাতে লেবুর শরবত পান করে অনশন ভাঙতে বাধ্য হলেন। সুতরাং এ ‘মা’ নজরুলের কেমনতর ‘মা’। নজরুল লিখেছেন-
    ‘সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।’
রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃতি দিয়ে কবি লিখলেন-
    ‘তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,
    তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
    তোমার ওই শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা।
এছাড়া বিরজাসুন্দরীদেবীও ‘তোর ব্যথাতুর-মা’র আকুতিতে লিখলেন-
    ‘ওরে লক্ষ্মীছাড়া ছেলে-
    আমার এ বেদন ভরা বুকের মাঝে
    জাগিয়ে দিলি নূতন ব্যথা
    ‘মা’ ‘মা’ বলে কাছে এসে
        আবার কবে কইবি কথা।’...
এই ধারায় বসন্তকুমার সেনগুপ্তের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, আশালতা সেনগুপ্তের (দুলী)র মাতা গিরিবালাদেবী, যিনি পরবর্তীতে নজরুল ইসলামের শাশুড়ি, তাঁকে নজরুল মাসিমা বলেই সারাজীবন সম্বোধন করেছেন, এই গিরিবালার একান্ত ইচ্ছেতেই নিজের একমাত্র কন্যা দুলীকে নজরুল ইসলামের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। নজরুলকে গিরিবালাদেবী ¯েœহ করতেন পুত্রকল্প হিসেবেই। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, যদিও আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে সেনগুপ্ত গোটা পরিবার নজরুল-নার্গিসের বিয়েতে গিয়েছিলেন, নজরুলের প্রতি গোটা পরিবারের একটা দায়বদ্ধতাও লক্ষ্য করা গেছে।
    নজরুল-প্রমীলার বিয়ের পর পক্ষীমাতার মতো গিরিবালাদেবী তাঁদেরকে আগলিয়ে রেখেছিলেন। নজরুলের সংসারে সব আছে, আবার কিছুই নেই-এই পুঁজি নিয়ে ১৯২৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত গিরিবালা একটি পরিবারকে পরিচালনা করেছিলেন। তাতে নানা প্রকার প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। হিন্দু বিধবা রমণী, তাঁর ঠাকুর পূজা-সেবা, অভাবের সংসার পরিচালনা করা, নজরুল-প্রমীলা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁদের সেবা-যতœ করা, নাবালক নাতি-দুজনকে দেখভাল করা এবং মানুষের সন্দেহপ্রবণ উক্তির যন্ত্রণা সহ্য করা সবই যাপন করতে হয়েছিল গিরিবালাদেবীকে। কাজেই নজরুল ইসলামের কুমিল্লায় শতবর্ষ আগে আগমনের ঘটনাপ্রবাহ আলোচনা করতে হলে গিরিবালাদেবীর দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্ত ও মাতৃকল্প সংসার-কর্ত্রী হিসেবে তাঁর অবদানকেও স্মরণ করতে হবে। মৈত্রেয়ীদেবী লিখেছেন-
    ‘এই মহিয়সী নারী ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় স্থান লাভের যোগ্য।’
কুমিল্লায় নজরুল ইসলাম আরেক মাতৃসমা নারীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন, তিনি হেমপ্রভা মজুমদার। কংগ্রেসনেতা বসন্তকুমার মজুমদারের সহধর্মিণী। তিনিও রাজনৈতিক নেত্রী। সে ইতিহাস বড়ই উজ্জ্বলতর ও গৌরবের। নজরুল ইসলাম এই দম্পতির সাহচর্য পেয়েছিলেন এবং রাজনীতির প্রাথমিক দীক্ষা লাভে ধন্য হয়েছিলেন। হেমপ্রভা মজুমদারকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখলেন-
    ‘কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
        আসিলে আলোক-জননী।
    প্রভায় তোমার উদিল প্রভাত
        হেম-প্রভ হল ধরণী।।’
নজরুল ইসলামের কুমিল্লার জীবনে আরও দু’জন মাতৃসমা নারীর সান্নিধ্য লাভ ঘটেছিল। তাঁরা দু’জনই আলী আকবর খানের দু’ ভগ্নী। আলী আকবর খানের তিন ভগ্নী- আসমতুননেসা, এখতারুননেসা ও কমরুননেসা। এখতারুননেসা নি:সন্তান ও বিধবা ছিলেন। বড় বোন আসমতুননেসার মেয়ের নাম সৈয়দা খাতুন (নার্গিস আসার খানম)। এখতারুননেসা খাঁ বাড়িতে ভাইদের সংসারে কর্ত্রী হয়েই থেকেছেন। তিনি নজরুলকে পুত্রাধিক ¯েœহ করতেন। আলী আকবর খানের বড়ভাই নেজামত আলী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন-
‘কবির সবচেয়ে আনন্দের ছিল পুকুরের শান্ত পানিতে সাবান দিয়ে ¯œান করা। সাবান মাখতে শুরু করলে অনেকক্ষণ ধরে তা চলতো। আর নেমেই সাঁতার কাটা ছাড়াও এপাড় ডুব দিয়ে ওপাড়ে ভেসে ওঠা। ... এভাবে দীর্ঘক্ষণ কাটাতেন তিনি পুকুরে প্রায় প্রতিদিন। ওদিকে বাড়িতে ভাত নিয়ে বসে থাকতেন কবির অপেক্ষায় খান সাহেবের বড় বোন। বিরক্ত হলেও তাগাদা দিতেন না। ভাত আগলে বসে থাকতেন মায়ের মত।’
অন্যদিকে নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের যখন বিয়ের কথাবার্তা চলেছে এবং ভাইদের উপর নির্ভরশীল বড়বোন আসমতুননেসা কন্যা নার্গিসকে নিয়ে দৌলতপুরে খাঁ বাড়িতে চলে আসেন। ভাবী মেয়ে- জামাই-র প্রতি ¯েœহ-মমতা স্বাভাবিকভাবেই একটু অন্যরকম ভাবে যাপন করতেন তিনি। শতবর্ষ পর এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
    এই আলোচনা এখানে ইতি টানছি একটি আবেদন জানিয়ে। কুমিল্লা শহর ও দৌলতপুরে নজরুলের সঙ্গে দু’টি পুকুরের সম্পর্ক নিবিড়। কুমিল্লা শহরের পুকুরটি এখন নেই। এই পুকুরটি ছিল ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসার পশ্চিম পার্শ্বে। ফরিদা বিদ্যায়তনের দক্ষিণে রাস্তার দক্ষিণে। এই পুকুরে নজরুল অনেকদিন ¯œান করেছিলেন। তা আজ ভরাট করে বাড়ি ঘর তৈরি হয়ে গেছে, পুকুরের কোনো চিহ্ন নেই, কুমিল্লা শহর একসময় পুকুরের শহর হিসেবেই খ্যাত ছিল। তাই এই স্মৃতিটুকু নতুন করে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ইচ্ছে করলে জেলাপ্রশাসন, সিটি করর্পোরেশন এখানে একটি দৃশ্যমান নান্দনিক স্মারক স্থাপন করতে পারেন। এতটুকু দাবি করতে পারি। দৌলতপুরে খাঁ বাড়ির শানবাঁধানো ঘাটলাসহ পুকুরটি এখনও আছে, তা সংরক্ষণ খুবই সহজ। এছাড়া ঘাটলা সংলগ্ন যে বিরাট আমগাছটি ছিল, তা এখন নেই। নতুন একটি আমগাছ রোপণ করে পরিচিতিসহ ফেস্টুন স্থায়ীভাবে স্থাপন করা যায়। এ বিষয়গুলো নজরুলের কুমিল্লায় শতবর্ষ আগে আগমনের প্রেক্ষাপটে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
[চতুর্থ পর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]