
ডাঃ বদিউল আলম মোল্লা মানিক ||
উপমহাদেশের বাম আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কিংবদন্তি রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম পুরুষ মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্ঠা বাংলাদেশ ন্যাশলাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ১০০তম জন্মবার্ষিকী ছিলো গত ১৪ এপ্রিল। বরেণ্য এই আদর্শিক রাজনীতিবিদের শততম জন্মবার্ষিকীতে জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। মোজাফফর আহমদ (রাজনীতিবিদ) বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ মোজাফফর আহমেদ মোজাফফর আহমদ ছিলেন একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কোপন্থী) সভাপতি ছিলেন।
জন্ম ও শিাজীবনঃ মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূঁইয়া, মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। তার পিতা ছিলেন একজন স্কুল শিক। মোজাফফর আহমদ যথাক্রমে হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক, দেবিদ্বার সরকারি রেয়াজ উদ্দিন পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ইউনেস্কো থেকে একটি ডিপ্লোমা লাভ করেন ।
কর্মজীবন ও রাজনীতিতে যোগদানঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র জনাব মোজাফফর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিকতা শেষে-- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। তার রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত বর্ণিল। রাজনীতি অঙ্গনে তার শুভসূচনা হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান । ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ জেলা কুমিল্লার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিামন্ত্রীকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন রাজনীতির ময়দানের সবাইকে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপের প্রতিনিধি নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন। দীর্ঘ আট বছর সময়ব্যাপী আত্মগোপনে থাকবার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুর জেলায় অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী-এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। মস্কো শিবিরে পূর্ব পাকিস্তানপন্থী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত ছিল। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি । ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলন নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি কারাবরণও করেছেন ।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। উপদেষ্টা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি স্বাধীনতার পে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ল্েয বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন। সে সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাপ-কমিউনিস্ট ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নিজস্ব উনিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে অধ্যাপক আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
স্বাধীন বাংলার রাজনীতিতে পদচারণাঃ স্বাধীনাত্তোর বাংলাদশে পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলে তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং প্রগতিশীল শক্তির পে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আহমদ কারারুদ্ধ হন!
ন্যাপের এই দুই নেতা
ন্যাপের এই দুই নেতা। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সংবাদ সম্পাদক ন্যাপ নেতা আহমেদুল কবির ও লায়লা কবিরের বাসায় যান। সেখান থেকে ন্যাপ নেতা বেজেঞ্জো শেখ মুজিবকে টেলিফোন করে জানান, “ওয়ালি খানও সঙ্গে এসেছেন।” এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু উচ্ছসিত হয়ে বলেন, “তোমরা দুজনই আমার সঙ্গে থাকবে। তোমরা আমার অতিথি।” পরদিন নির্ধারিত সময়ে ওয়ালি খান ও বেজেঞ্জো শেখ মুজিবের বাসায় গিয়ে পৌঁছালে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। আলোচনার শুরুতেই বেজেঞ্জো বলেন, “আশা করি, তুমি খোলাখুলি তোমার পরিকল্পনার কথা জানাবে। পাকিস্তানে যারা তোমার রাজনৈতিক অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে, আমরা তাদেরই প্রতিনিধি। তুমি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং তোমার হাতেই মতা ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু তুমি যদি একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দাও, তাহলে ভাবতে পারো আমাদের কী সমস্যায় পড়তে হবে?”
এ কথা শুনে শেখ মুজিব অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাঁর চোখে পানি আসে এবং দুই সম্মানিত অতিথিকে জিজ্ঞেস করেন, “কে কাকে পাকিস্তান না ভাঙার কথা বলছে? তোমরা তো কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলে। তোমরা আমাকে বলো, কে খাঁটি মুসলিম লীগার এবং কারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ত্যাগ স্বীকার করেছে?” ওয়ালি খান তাঁর স্বভাবসুলভ কৌতুক মেশানো ভঙ্গিতে মুজিবকে বললেন, “আমরা তখন তোমাকে বলেছিলাম, ভারত ভেঙ্গো না। তুমি বলেছিলে, পাকিস্তান কায়েম না করে বিশ্রাম নেব না। তোমরা পাকিস্তান কায়েম করেছ। এখন আমরা করজোড়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, পাকিস্তান ভেঙ্গো না। কিন্তু তুমি বলছ, পাকিস্তান ভেঙে ফেলবে। তোমরা মুসলিম লীগাররা বিশেষ ধরনের প্রাণী!” বেজেঞ্জো লিখেছেন, “শেষমেশ আমরা আসল বিষয়ে এলাম।” শেখ সাহেবকে বললাম, “পরিস্থিতি খুবই জটিল। যদি তিনি অনড় থাকেন, তাহলে দেশ ভেঙ্গে যাবে। আমরা বললাম, তাঁর অবশ্যই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করা উচিত এবং তাঁর কাছে মতা হস্তান্তরের একটি পথ বের করতে হবে। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর এটি তাঁর এবং তাঁর দলের অধিকার!” ইয়াহিয়ার আশপাশে থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে গাউস বক্স বেজেঞ্জো বললেন, “কীভাবে সংকট মোকাবিলা করতে হয়, তারা তা জানেন না।” শেখ সাহেবের উত্তর ছিল, “আমি তোমাদের বলছি, তারা (ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীরা) আমার কাছে মতা হস্তান্তর করবেন না ; এমনকি তাতে যদি পাকিস্তান ভেঙ্গেও যায়। পাঞ্জাব (সেখানকার শাসকচক্র) আমাকে মতায় আসার সুযোগ দেবে না!” বেজেঞ্জো আরও লিখেছেন, “আমরা দেখছি, শেখ মুজিব ভয়ানক মনোবেদনায় ভুগছেন। ভারাক্রান্ত স্বরে তিনি বললেন, “আমি চেষ্টা করব, কিন্তু এক শর্তে, আলোচনা চলাকালে তোমরা দুজনই ঢাকায় থাকবে। আরেকটি বিষয়, তোমরা যখন আমার ঘর থেকে বের হবে, আমিও তোমাদের সঙ্গে আসব । কিন্তু প্রকাশ্যে বৈঠকের কথা বলব না!” বঙ্গবন্ধু যখন ঘরের বাইরে এলেন, তখন স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরলেন। তাঁর হাজার হাজার সমর্থক আকাশ বিদীর্ণ করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে লাগলেন । শেখ সাহেব অপেমাণ সাংবাদিকদের বললেন, “তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছেন। সাংবাদিকেরা জানতে চাইলেন, “কোথায় বৈঠক হবে? শেখ মুজিব বললেন, তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি যেখানে চাইবেন, সেখানেই বৈঠক হবে। এরপর। ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো লিখেছেন, “আমরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!” ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। তিনি ওয়ালি খান ও বেজেঞ্জোকে গভর্নর হাউসে ডাকলেন। আমরা তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, “শেখ মুজিব বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা ভাবছেন না। তাঁর দাবি হচ্ছে, তিনি জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের জয়ী হয়েছেন, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুযায়ী তাঁর কাছেই মতা হস্তান্তর করা উচিত।” আমরা ইয়াহিয়াকে বললাম, “আমাদের ধারণা, শেখ মুজিবের অবস্থান অত্যন্ত ন্যায়সংগত। তাঁর সঙ্গে কথা বলে দেখুন, আপনিও সন্তুষ্ট হবেন!” শেখ মুজিবের মতো ইয়াহিয়া খানও আমাদের বললেন, “আলোচনার সময় তোমরা ঢাকায় থেকো।” বেজেঞ্জোর বিবরণীতে আমরা পাই, “১৬ মার্চ ১৯৭১ সাল ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক শুরু হলো। শেখ মুজিব প্রতিদিনই বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে আমাদের অবহিত করতেন। প্রথম কয়েক দিনের বৈঠকে অগ্রগতি হচ্ছিল ।” এরপর ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের ঢাকায় আসতে বললেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন মিয়া মমতাজ দৌলতানা, সরদার শওকত হায়াত, মাওলানা নুরানী, মুফতি মাহমুদ ও কাইউম খান। এ ছাড়া পিপিপির (পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ন্যাশলাল এসেম্বলীর নির্বাচনে ৮৫টা আসন পেয়েছিল) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও তাঁর দলের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। ইয়াহিয়া খান অর্থসচিব এম এম আহমদসহ কয়েকজনকে তলব করলেন। শেখ মুজিব যখন জানতে পারলেন, ভুট্টো ও এম এম আহমদ আলোচনায় অন্তর্ঘাত করছেন, তখন তিনি এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন। ভুট্টো ঢাকায় এসে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে অভিন্ন অবস্থান নেওয়ার কথা বললে ন্যাপনেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও খান আব্দুল ওয়ালি খান তার বিরোধিতা করেন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সব নেতা তাঁর সঙ্গে আছেন। এতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তাঁর দর-কষাকষিতে সুবিধা হবে। তিনি ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিব ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগেও প্ররোচিত করেছেন-- মন্তব্য এই ন্যাপ নেতা বেজেঞ্জোর। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, “আলোচনার শুরুতে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডিনেন্স বা এলএফওর শর্ত পূরণ হলে মতা হস্তান্তরে রাজি আছেন। সেই প্রোপটে শেখ মুজিব প্রস্তাব দেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যরা আলাদা বসে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করবেন। পরে দুই পরিষদের সদস্যরা এক হয়ে সংবিধান প্রস্তুত করবেন। ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জো পাঁচ প্রদেশের জন্য পাঁচটি সাংবিধানিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন । ইয়াহিয়া খান কিছুটা নমনীয় ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বেজেঞ্জো আবারও শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বললেন। শেখ মুজিব তাঁর সন্দেহের কথা বললেন, “জেনারেল অস্থিরমতি- কখন কী করবেন বলা কঠিন!” এরপর বঙ্গবন্ধু সরাসরি জানিয়ে দিলেন, “আমি আর এক বা দুই পরিষদের অধিবেশন ডাকতে বলব না। দ্রুত মতা হস্তান্তর ও সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাব। এ দুটিই মূল দাবি।” দুই ন্যাপ নেতা আবার আবার গেলেন ইয়াহিয়া খানের কাছে। শেখ মুজিবের মনোভাবের কথা ইয়াহিয়া খানকে জানিয়ে বললেন, “কারিগরি বিষয়ে জেদ ধরে পাকিস্তানকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না।” ইয়াহিয়ার জবাব ছিল, “যদি তোমাদের বন্ধু শেখ মুজিব কথা না শোনেন, তাহলে আমার সেনাবাহিনী জানে, কী করে কথা শোনাতে হয়!” ন্যাপ নেতা বেজেঞ্জো লিখেছেন, “তাঁর মনে কী আছে বুঝতে অসুবিধা হলো না!” আমি জিজ্ঞেস করি, “মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি কি শক্তি দিয়ে এই জটিল সমস্যা সমাধানের কথা ভাবছেন? সামরিক শক্তি প্রয়োগে কি এর সমাধান হবে?” ২৪ মার্চ দুই ন্যাপ নেতা বেজেঞ্জো ও ওয়ালি খান শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলে তিনি বিপদের চূড়ান্ত বার্তাটিই জানিয়ে দেন, “আমি মনে করি, তোমাদের দুজনের ঢাকা ত্যাগ করাই ভালো। সেনাবাহিনী আগামী দুই দিনের মধ্যে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমাদের উপস্থিতি কোনো সুফল দেবে না!" এরপর বিমূঢ় ও নির্বাক দুই পকিস্তানি নেতা শেখ মুজিবের বাড়ি ত্যাগ করলেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী ক্রেমলিনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সভাপতি লিউনিদ ব্রেজনেভ, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ভিক্টোরোভিচ নিকোলাই পদগোর্ণী এবং প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি নিকোলেভিচ কোসেগিন'দের কাছে সাহায্যের জন্যে যদি বার বার ছুটে না যেতেন তাহলে এত অল্প সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো না। তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের জন্যে বুদাপেস্টে ৭০ জাতি গ্রুপের জোটনিরপে সম্মেলন অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সাহায্য-সহায়তা পেয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য-সহায়তা জন্য পূর্ব-ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ব্যাপক সফর করেন। মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য সময়ে তিনি মুক্তিবাহিনী গঠন করেন ও তাদের জন্য অস্ত্র-সস্ত্র সংগ্রহ এবং তাদের প্রশিণের জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ঐ উল্লেখযোগ্য সময়ে তিনি ন্যাপের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করেন। সশস্ত্র লড়াইকে এগিয়ে নিতে তিনি তখন, “ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের” সমন্বয়ে ১৯ হাজারেরও অধিক বিশেষ গেরিলা বাহিনীর মুুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিণ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা গঠনের েেত্র তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানকে সাহায্যের জন্য তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে যুদ্ধ জাহাজ “সপ্তম নৌবহর” পাঠিয়েছিল। তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সাহায্যের জন্যে একটি ব্লাস্টিক পেনাস্ত্রবাহী যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিনসহ রণতরী পাঠিয়েছিল ভারত মহাসাগরে। এ েেত্রও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের আলোচনা এ সমযোতার কারণে তা সম্ভব হয়েছিল । তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো সপ্তম নৌবহর যৌক্তিক কারণে ভারত মহাসাগর থেকে চলে যেতে বাধ্য হয় । মার্কিনীদের সাহায্য-সহায়তা না পেয়ে দুর্বল পাকিস্তানী সামরিকজান্তার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট জেনারেল আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী তখন পরাজিত হয়ে সাড়ে ৯৭ হাজার সৈনিকসহ ঢাকার রেসকোর্স মায়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের দলিলে সার করেন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫ টায়। পাকিস্তানি সামরিকজান্তার আতœসমর্পণের মধ্যদিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদ্ধয় ঘটে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পাকিস্তানের যে সব নাগরিক সহানুভূতিশীল ছিলেন ওয়ালী-মোজাফফর ন্যাপের সমর্থক ও কর্মী । পরবর্তিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিবাহিনী গঠন ; ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন সমন্বয়ে ১৯ হাজার সদস্যের অধিক বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন, মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর জন্য প্রশিণের ব্যবস্থা করা এবং তাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহ, স্বাধীনতার পে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কুটনৈতিক সমর্থন লাভের জন্য বুদাপেস্টে শান্তি সম্মেলন ও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করেছিলাম। স্বাধীনতায় পে সর্বাতœক অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম হোতা আখ্যা দিয়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে ধরিয়ে দেবার আহবান এবং ন্যাপকে বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। ভারত যখন প্রায় কোটিখানেক শরণার্থীর সার্বিক তত্ত্ববধানের চাপের সম্মুখীন তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশেরে স্বাধীনতার জন্য সমর্থন ও সহায়তা আদায় ছিল অপরিহার্য, বিশেষ করে দুই পরাশক্তির একটি সোভিয়েত ইউনিয়নের। আর এই বাস্তবতা থেকেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাাত করেছিলাম। আন্তর্জাতিক সহায়তা লাভের জন্য কুটনৈতিক চেষ্টা চালানোর ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধী রাজী হয়েছিলেন। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সোভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে তাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য আমাকে খুঁজছিলেন। কান্ডারীবিহীন জাতির কাছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে অবস্থিত বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিণ শিবিরে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্ত যশোরে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ মুুজিব নগর প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “নবলব্ধ স্বাধীনতা রা করতে হলে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলকেই ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের একক সরকার গঠন করা ঠিক হবে না । এখন দেশ প্রেমিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং জাতীয় স্বাধীনতাকে সকল হামলা ও চক্রান্ত থেকে রা করার স্বার্থে জাতীয় সরকার গঠনে সম্মিলিত হওয়া দরকার। না হলে এই স্বাধীনতার উপড় কোন বিপদ এলে তা এককভাবে কোন দল প্রতিহত করতে পারবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে সম্মুখ যুদ্ধে একটি দেশের হানাদার বাহিনী শুধু পরাজিত হয়েছে। কিন্তু দেশের ভিতরে ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তি রাজাকার, আলবদররা ঘাপটি মেরে বসে থেকে তারা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । দেশের ভিতরে বাইরে প্রতিবিপ্লবীদের চক্রান্তে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী বহিঃশত্রুর মদদ দান বন্ধ হয়নি । তারা নতুন করে চক্রান্ত আটছে । জাতীয় ঐক্যছাড়া এই চক্রান্ত মোকাবেলা যাবে না ।" আওয়ামী লীগ একা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ করেনি । ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি এবং আওয়ামী লীগ একসাথে মিলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ষুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল । তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল এদেশের ছাত্র- যুবক-কৃষক-শ্রমিকসহ এদেশের আপামর জনসাধারণ। একথা সত্য ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগ একসাথে মিলেই স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মেনে নিয়েই । ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি এবং আওয়ামী লীগ মিলে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা ছিল তখনকার সময়ের দাবি । ১৯৭২ সালের মতাসীনরা কিন্তু ন্যাপ প্রধান আধ্যাপক মোজাফফর আহমদের এই সতর্কবাণীকে গুরুত্ব দেননি । যার পরিনতিতে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরে মাথায় সেই আওয়ামী লীগকে মতা হারাতে হয়েছিল । আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ ২১ বছর রাষ্ট্রীয় মতার বাইরে থাকতে হয়েছে । আমি জানি না আওয়ামী লীগ ইতিহাস থেকে কতটুকু শিা গ্রহন করেছে ।
দেশ স্বাধীন হবার পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ একটা কথা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগ যখন এককভাবে মতায় গেছে তখন দেশে একটি সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব প্রয়োজন......নইলে বিরোধী দলের শূন্যাবস্থা পূরণ করবে স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত অশুভ অপশক্তি। এর পর ন্যাপের সহযোগী দল কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) হঠাৎ নীতি বদলায় । সরকারের সঙ্গে অসহযোগীতা নয়, সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। সরকার যাতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের খপ্পরে পড়ে না যায়, সে জন্যে সহযোগীতা দিয়ে তাকে ধরে রাখতে হবে। ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কি তার সহযোগী কমিউনাস্ট পার্টির এই নীতি সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছিলেন? আমি তা জানি না। এ নিয়ে তার সঙ্গে তখন কোন আলোচনার সুুযোগ হয়নি। আমার মনে হয়েছে, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাপ তখন ছিলো দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। সিপিবি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্ব রাজনীতির স্বার্থে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের যতই গলগ্রহ হোক, ন্যাপ তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক দল গড়ে তুলবে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে দলটির হার হওয়া সত্ত্বেও বিরোধী দলের শূণ্য স্থানটি ন্যাপই পূরণ করতে পারবে। ন্যাপ তা না করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণঐক্য জোটে মিলিত হওয়ায় বিরোধী সেই শূণ্য স্থানটি দখল করে নিয়েছে পরর্বতিকালে "ইনফেন্টাইল অ্যাডভেঞ্চারিষ্ট" জাসদ এবং ১৯৭১ সালের পরাজীত রাজনৈতিক অপশক্তি। আমার ধারণা, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশে ন্যাপকে একটি গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন......কিন্তু কমরেড মনিসিংহ-সহ কমিউনিস্ট নেতাদের চাপে তিনি তা পারেনি। এ আমার ধারণা সঠিক কি-না তা জানার সুুযোগ কখনও হয়নি। স্বাধীনাত্তোর বাংলাদেশে সহযোগী কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের ইচ্ছাতেই কি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তার দল ন্যাপ নিয়ে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল গঠনের ইচ্ছা ত্যাগ করে সর্বকাজে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দানের নীতি গ্রহণ করেছিলেন? সে কাজটা তখন করেছিল সিপিবি। যার ফলে দেশে বিরোধী শক্তি হিসেবে সাম্প্রদায়ীক অপশক্তির অভ্যূত্থান। সিপিবি ও ন্যাপ যখন সরকারকে সর্বোতোভাবে সমর্থন ও সহযোগীতা দিয়েছে, তখন সরকারকে প্রভাবিত করার জন্যেও মন্ত্রীসভায় তারা যোগদান করেনি কেন ? আমি যতদূর জানি, বঙ্গবন্ধু চাচ্ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তার মন্ত্রীসভায় যোগ দিক। তিনি মন্ত্রীত্বের অফার প্রত্যাাণ করেন। মতার লোভ তাকে কখনও আকৃষ্ট করেনি। কিন্তু প্রয়োজনের সময় তিনি কেন কঠোর হননি, এটাই আমার প্রশ্ন। তার সঙ্গে দেখা হলে এই প্রশ্নগুলোর জবাব তার কাছে জানতে চাইব-- এই ইচ্ছা আমার ছিল । বিদেশে থাকায় সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সম্পর্কে আমার ধারণা, তিনি আমাদের ইতিহাসের ক্রান্তিকালের নায়ক ; একজন মহানায়ক। তাকে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া যাবে না। পঞ্চাশের দশকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্ম এবং সেই দলে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বের শূণ্যতা পূরণে মোজাফফর আহমদের অসাধারণ দতা, স্বাধীনতা যুুদ্ধে মস্কোর সমর্থন আদায়ে তার কূটনৈতিক সাফল্য, সমাজতান্ত্রিক ল্েয তার অবিচল নিষ্ঠা ইত্যাদি সম্পর্কে আরও বিশদ আলোচনা দরকার । সময় ও সুুযোগ হলে সে আলোচনা করার ইচ্ছে রাখি । আজ শুধু বোধিবৃরে মতো প্রবীণ মহানায়ককে আমার অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়েই লেখাটি শেষ করছি!!
আমার কাছে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের পরিচয় শুধু ন্যাপ নেতা হিসেবে নয় তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিকও । ১৯৫১-৫২ সালে আমি যখন ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখন তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক । তিনি তখন যুবক এবং কাশে অর্থনীতির মতো দুরুহ বিষয় এমন অন্তরঙ্গভাবে পড়াতেন যে, কেমন করে একঘন্টা সময় কেটে যেতো তা আমরা ছাত্ররা অনেক সময় বুঝতে পারতাম না । ১৯৫৪ সালে তিনি শিকতা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিলেন, পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন । মাওলানা ভাসানী যখন অবিভক্ত ন্যাপের সভাপতি, তখন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন দলের সহ-সভাপতি । মস্কো-পিকিংএর ঝগড়ায় ন্যাপ যখন দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং মাওলানা ভাসানী পিকিংপন্থীদের দলে চলে যান তখন মোজাফফর আহমদ ভাঙ্গা ন্যাপের হাল ধরেন এবং দলের সভাপতি হন । তখনও ন্যাপ এক বিশাল পার্টি । বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার আন্দোলনে ন্যাপ সমর্থন দিয়েছে । আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষে-- ----------------২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সাল আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের যে 'গোলটেবিল বৈঠক' ডাকেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে সেই বৈঠকেও তিনি [অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ] আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি দাওয়া স্বীকৃত না হওয়ায় বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং মুজিব ও মোজাফফর আহমদ ঢাকায় ফিরে আসেন । একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ছিল অনন্য ভূমিকা । এই মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজনমতের বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তৎকালীন পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি উদ্যোগ নিয়ে মস্কো এবং অন্যান্য সমাজতন্ত্রী দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন এবং সেই সমর্থন আদায় করেছেন । মুজিবনগর সরকার সিপিবি এবং ন্যাপকে অন্তর্ভূত না করা সত্ত্বেয় এই সরকারকে তারা সর্বপ্রকার সমর্থন দিয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সর্বাতœক সাহায্য-সহায়তা যুগিয়েছেন । স্বাধীন বাংলাদেশেও শাসক আওয়ামী লীগের অনেক টালবাহানা গড়িমসি সত্ত্বেয় সুখী ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের ল্েয তারা মুজিব সরকারের শেষ দিনটি পর্যন্ত সমর্থন যুগিয়েছেন! বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়ানকভাবে পাল্টে গেছে । বামশক্তি বহুধাবিভক্ত এবং দুর্বল । স্বাভাবিকভাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিরও [ন্যাপ] আগের বিশালতা ও শক্তি নেই । অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও বর্ষীয়ান নেতা এবং দেশের তরুণ রাজনৈতিক নেতাদের তার চিন্তা-ভাবনা ও জেনারেশন গ্যাপ বেড়েছে । কিন্তু বিস্ময়ের কথা এই যে, অগ্রসরমান রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় তিনি হালের বাম বলে কথিত অনেক দলের তরুণ নেতাদের চেয়েও অনেক বেশি তরুণ রয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতির আন্তর্জাতিক ও উপমহাদেশীয় প্রোপটটি অনেক তরুণ নেতাদের চেয়ে ভালোভাবে অনুধাবন করেন । তিনি জনকন্ঠে প্রকাশিত আমার লেখার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন বলেই বলছি না । বরং তার অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময়ের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত থাকার দাবিতেই একথা বলছি ফিরে দেখা ১৯৭২ দেশে বর্তমানে জরুরি সমস্যাবলী মোকাবেলায় সকল পর্যায়ে ত্রিদলীয় জাতীয় কমিটিঃ ২৯ মে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের চলমান প্রধান জরুরি সমস্যাবলী মোকাবেলায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মনিসিংহের সাথে এক বৈঠক করেন! দেশে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের জরুরি সমস্যা বিরাজ করছে, তা মোকাবেলার জন্য আওয়ামী লীগ, ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি মোজাফফর গ্রুপ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-- ঐক্যবদ্ধ হয়ে তিন পার্টির একটি জাতীয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয় । ১৯৭২ সালের ২৯ মে [সোমবার] রাতে এ তথ্য জানা যায় । সংবাদ সংস্থা 'এনা' পরিবেশিত খবরে বলা হয়, তিন পার্টির জাতীয় কমিটি ঘঠনের সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা না হলেও ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায় ; শিগগিরই সর্ব পর্যায়ে কমিটি গঠিত হতে পারে । প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ২৯ মে বৈকালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মনিসিংহ ও জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুস সালাম এবং ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের প্রায় ৯০ মিনিট বৈঠক হয় । বাংলাদেশ বর্তমানে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার সমাধানের জন্য নিজেদের মধ্যে সার্বিক সহযোগীতার সম্ভবনা সম্পর্কে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আলোচনা করেন । সম্মেলন ক থেকে বেড়িয়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ অপেমান সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা সর্বস্তরে সরকারের সঙ্গে সহযোগীতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।" তিনি বলেন, "মন্ত্রীসভা ছাড়া সর্বস্তরে আমরা সরকারকে সমর্থন দেবো ।" প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সরকারে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালে-- ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি তাতে যোগদান করবে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, "এ বিষয়ে বৈঠকে কোন আলোচনা হয়নি ।" ১৯৭২ সালের ৩০ মে জাতীয় পত্রিকা দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পরে টেলিফোনে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জানান, "দুর্নীতিবাজ, চোরাচলানি, মজুতদারি, কায়েমী স্বার্থবাদীদের অপরাপর গণবিরোধী তৎপরতায় সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় তিনটি রাজনৈতিক দল মন্ত্রীসভা পর্যায়ে সরকারকে সহযোগীতা করবে । রাজনীতি জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, দণি ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের নানান দেশে সফর করেন । তার সহধর্মিণী আমিনা আহমদ বর্তমানে ন্যাপের সভাপতিম-লীর সদস্য এবং সভানেত্রী হিসেবে আছেন । ১০ম জাতীয় সংসদে সংরতি আসনের মহিলা সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি । গ্রন্থ প্রকাশনাঃ সমাজতন্ত্র কি এবং কেন, প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা, মাওবাদী সমাজতন্ত্র ও কিছু কথা, পুরস্কার ও সম্মাননাঃ স্বাধীনতা পদক, ২০১৫ [গ্রহণে অস্বীকৃতি], বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দিলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন । ব্যক্তি জীবনঃ তার প্রয়াসে মদনপুরে তার প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের একমাত্র শিায়তন ‘সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ দিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় এবং বিভক্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) একাংশের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর নিজেকে 'কুঁড়েঘরের মোজাফফর' বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম এ ব্যক্তিত্ব নিজেকেন সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবেসেছেন আজীবন। অধ্যাপক আহমদ ব্যক্তিজীবনে কথা-বার্তা বলতেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে ; কখনো থাকে প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালির ছোঁয়া । তিনি কাছের মানুষদের কাছে একসময় বলতেন, "আমার নাম মোজাফফর আহমদে নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি-- মানুষের খবর রাখি”।