
তানভীর সালেহীন ইমন ||
সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে,
বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষের স্ফুরণ ঘটিয়ে, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা
অর্জনের সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় হয় জাতিরাষ্ট্র
বাংলাদেশের। বাঙালির আজন্ম লালিত স্বাধীনতা ও মুক্তির আশা আকাঙার পূর্ণতা
পায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শীতা, সম্মোহনী নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, অসীম
ত্যাগ, সাহসিকতা, গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা, অবিচল আপোসহীনতা, প্রগাঢ দেশপ্রেম ও
সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের দুর্দান্ত সমন্বয়ে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর
অবদান ছিলো অনিবার্য ও অপরিহার্য। ১৯৪৭ সালে দ্বি -জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে
দেশ বিভক্তির সূচনালগ্ন থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মতা কুগিত হয়
অবাঙালিদের হাতে এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় নব্য উপনিবেশে। অশ্রু আর
রক্তে রচিত হতে থাকে বৈষম্য আর বঞ্চনার নতুন ইতিহাস । অভ্যন্তরীণ
প্রভুত্বকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে তখন থেকেই লড়াই সংগ্রাম করে স্বাধীনতার
স্বপ্ন বুনতে থাকেন তরুণ শেখ মুজিব যিনি কৈশোরেই দীতি হয়েছিলেন শেরে বাংলা
এ. কে. ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওযার্দীর ভাবাদর্শে। তাঁর মন-মননে
অনুরণিত হচ্ছিলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণার সুর। দেশ
বিভক্তির পর থেকেই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক ও
ধর্মনিরপে চেতনার বিকাশে বঙ্গবন্ধু ভুমিকা রাখতে শুরু করেন। বাঙালি
জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় জনগণের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টির সুনিপুণ কারিগর
রুপে আবির্ভূত হন বাঙালির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯
সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের মেনিফেস্টোতে তিনি স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি
অন্তর্ভুক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন “জিন্নাহ
পূর্ব পাকিস্তানে এসে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান বা ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট
জনসভায় ঘোষণা করলেন” উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। “আমরা
প্রায় চার পাঁচশত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকেই হাত তুলে জানিয়ে
দিলো ‘মানি না’।
বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আরও বলেন “ আমি তখন
ঢাকা মেডিকেল কলেজে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে,
আমাদের মাতৃভাষার উপর ও আমার দেশের উপর যে আঘাত হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে
তা মোকাবেলা করতে হবে। কথা হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট
করবো আর ২১ তারিখ আন্দোলন শুরু হবে। “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের
২১ দফার ১৯ নং দফায় স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি থেকে শুরু করে নির্বাচনে
যুক্তফ্রন্টকে বিজয়ী করার অন্যতম কুশীলব ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৫ সালের ২৫
আগস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তনের জোর প্রতিবাদ করে
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন " Sir, you will see that they want to place the word
'East Pakistan' instead of 'East Bengal'. We have demanded so many times
that you should use East Bengal instead of East Pakistan. The word
Bengal has a history, has a tradition of its own." ১৯৫৮ সালের ৭ এপ্রিল
থেকে ৪ জুন বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ দূরপাচ্যের অনেক দেশ সফর করে
তৎকালীণ পারিপার্শ্বিকতায় কৌশলে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। সফরের অভিজ্ঞতা
শেষে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বিশ্বে পাকিস্তানের কোন মর্যাদা নাই কারন
দেশে স্থিতিশীলতা না থাকায় কেহ আমাদের নীতিতে আস্থাশীল নহে।” ১৯৬০ এর শুরু
থেকেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুতি
নিতে থাকেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিা কমিশন ও শাসনতন্ত্র বিরোধী গণ
আন্দোলন শুরু হলে গণতান্ত্রিক অধিকার রায় শেখ মুজিব জোরালো বিবৃতি দেন।
১৯৬২ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনের জন্যে শশাঙ্ক
এস ব্যানার্জীর মাধ্যমে জওহরলাল নেহেরুর কাছে অতি গোপনীয় চিঠি দেন এবং
ব্যক্তিগত সাাতের আগ্রহ প্রকাশ করেন। ভারত তখন দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত সমর্থনের
আশ্বাস দিয়ে রোডম্যাপ বাস্তবায়নে ব্যাপক গণসমর্থন তৈরির কথা বলে।
বঙ্গবন্ধুর
সম্মোহনী রাজনৈতিক নেতৃত্বে একটি ঘুমন্ত জাতি মুক্তির মন্ত্রে জাগ্রত হতে
থাকে। ১৯৬৬ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পূর্বাভাস হিসেবে বঙ্গবন্ধু
বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশের নামকরণ করেন বাংলাদেশ। পথ পরিক্রমায় ৬৯ এর গণ আন্দোলনের উত্তাল
ঢেউ ৭০ এর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তার
ঐক্যৈর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চূড়ান্ত বিকাশমান পর্যায়ে উপনীত করে।
বঙ্গবন্ধুর
একক ও অবিসংবাদিত নেতৃত্বেই বাঙালির জাগরণ হয়। মুক্তির স্বপ্নে বিভোর
বাঙালি স্বাধীনতার সোনালী সূর্য ছিনিয়ে আনার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি
কথা অরে অরে প্রতিপালন করতে থাকে। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর
নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় যে অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিলো তাতে প্রতিটি
দিনেই রচিত হতে থাকে নতুন নতুন ইতিহাস। গণমানুষের মুক্তির নিবেদিত প্রাণ
বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠ যেন হয়ে ওঠে সময়ের কন্ঠস্বর। সাড়ে সাতকোটি বাঙালি কান
পেতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের আহ্বানের। ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চ কৌশলময়
কুটনৈতিক প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক বিচণতায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতা
সংগ্রামের প্রস্তুতির সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়ে দেন। মার্কিন সাময়িকী
নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর এই ভাষণের জন্যে ‘Poet of Politics’ হিসেবে
আখ্যায়িত করে। মূলত সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার
কার্যত (উব ঋধপঃড়) ঘোষণা দেন। ২১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত
জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সাথে সাাৎ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি
দীর্ঘমেয়াদী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দেয়ার শর্তে রক্তপাতবিহীন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানের কাছ থেকে আদায়ের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের
সহযোগিতার আশ্বাস দিলে বঙ্গবন্ধু তা দৃঢ় চিত্তে প্রত্যাখান করেন। ২৩ মার্চ
বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করেন। জনস্রোতের
অগ্নিস্ফূলিংগে কোন কিছুই তখন আর পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণে ছিলোনা। ২৫
মার্চ রাত ১.৩০ টায় গ্রেফতার হবার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ঘোষণা করেন এবং বহির্বিশ্বের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। ২৬ মার্চ বিবিসির
প্রভাতী অধিবেশনে ঘোষণাটি প্রচারিত হয়। ২৭ মার্চ ঞযব ঞরসবং পত্রিকার
শিরোনাম আসে “Heavy fighting as Sheikh Mujibur Declares E. Pakistan
Independent” বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ও প্রদর্শিত পথেই দীর্ঘ নয় মাস
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি চূড়ান্ত
বিজয়।
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি ও
স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোস করেননি। শতবছরের পরাধীনতা আর দাসত্বের শৃঙ্খল
ভেঙে বাংলার মানুষের প্রাণের চাওয়া মুক্তি ও স্বাধীনতা এসেছে সর্বকালের
শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। বাঙালি
পেয়েছে আত্মপরিচয়। বৃটিশ সাংবাদিক সিরিল ডান বলেন, “বাংলাদেশের হাজার
বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়,
সংস্কৃতিতে ও জন্মসূত্রে পুরোদস্তুর বাঙালি। তাঁর শারীরিক গঠন ছিলো
তেজদীপ্ত, কন্ঠ ছিলো বজ্র-নির্ঘোষ। এই বজ্রকন্ঠ দিয়ে তিনি জয় করেছিলেন
বাঙালির হৃদয় পরিণত হয়েছিলেন জাতির আস্হাভাজন নেতায়। ”
দ্ব্যর্থহীনভাবে
বলা যায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাঙালি স্বাধীনতা সুদূর পরাহতই থেকে যেতো।
বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন সারথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির
প্রতিটি সংকটে, সংগ্রামে, স্বপ্ন সম্ভাবনার সম্মুখ যাত্রায় বঙ্গবন্ধুই
আমাদের চিরন্তন প্রেরণার বাতিঘর, বাংলা ও বাঙালির অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব।
তথ্যসূত্র :
শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১৪
শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বানী, নির্দেশ ও সাাৎকার, ঢাকা : বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমী, ২০১৭
শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী, ভারত, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান, ঢাকা : অপরাজিতা সাহিত্য ভবন, ২০১৩
মুনতাসীর মামুন, বঙ্গবন্ধু কিভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন, ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৩
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও শেখ মুজিব, ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮
আবুল বারাকাত, বঙ্গবন্ধু - সমতা-সাম্রাজ্যবাদ, ঢাকা : মুক্তবুদ্ধি, ২০১৫
মোঃ নুর নবী, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়, ঢাকা : তাম্রলিপি, ২০২০
লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি
সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুমিল্লা)
[email protected] ০১৭১৪৪১৪৭৪৪