ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
রবিবাসরীয়.....
Published : Sunday, 7 August, 2022 at 12:00 AM
রবিবাসরীয়.....








মূর্খতার পুরুষবাদী মিথ-২


রবিবাসরীয়.....কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ||
লোকটি একা ধূলিময় প্রান্তরে বসে ভাবছিলো।
দুঃখে এখানকার মানুষ এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত। কেন  সে তার কন্যাকে হত্যা করলো; অনুসূচনায় তাঁর অন্তর  পোড়ে যাচ্ছিল। তার শরীরের রং বদলে যাচ্ছিল। কোন অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে তার সমস্যার সমাধান হবে। বিপদে পতিত হলে তারা এভাবে অপেক্ষায় থাকে। কে আসবে  সে জানে না। নিশ্চয়  কেউ একজন আসবে। কারণ  সে বিশ^াসী।
সেই তিনি, যিনি বলে ছিলেন ‘তোমরা কেউ কাউকে মূর্খ মনো করো না’, তিনিই এলেন। জৌতির্ময়, আলো ঝলমল সদা সৌম্যকান্তি দেহে বাতাসে ভর করে এলেন। তিনি মহা প্রজ্ঞাবান, কন্যা সন্তান হত্যাকারীকে যুগপৎ  সময়ে পেয়ে গেলেন।
তিনি হন্তারক পিতার সম্মুখে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে হত্যাকারী তুমি কেমন আছো?’
লোকটি সামান্য বিচলিত হলো। তারপর কিছুক্ষণ মুখে কোন কথা এলা না তার , সময় হলে পরে বললো, ‘আমি  বেঁচে আছি,তাই বলতে হবে ভালো আছি, আপনার করুনায়। কিন্তু অনুশোচনায় পোড়ে যাচ্ছি। দুই রকম জীবন ধারনকারী আমি ভালো থাকি কী করে! আমি আমার মেয়েকে মূর্খ ভেবে হত্যা করে মহা অন্যায় করেছি। আমাকে এর থেকে মুক্তির পথ  দেখান। আপনি নিশ্চয় শুধু ক্ষমার ভিতর দিয়ে আমাকে যন্ত্রনায় নিক্ষেপ করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘এখন তুমি কী করতে পারো?’
‘আমি কী করতে পারি জানি না। আপনার সাহায্য চাই।’
‘তুমি একজন মূর্খ মানুষ নিয়ে এসো। তারপর তোমার সঙ্গে কথা হবে।’ এ বলে প্রজ্ঞাবান চলে গেলেন।
কন্যা হন্তারক তার পরিচিত লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছো মূর্খ, যে আমার যন্ত্রনার ভাগ নিবে। কে আছো সেই সাহসী মূর্খ যে সবার সামনে দঁড়িয়ে বলতে পারবে আমি মূর্খ। অন্তত আমার সঙ্গে যাবে মহান দয়াবানের সম্মুখে মূর্খতার পরিচয় দিতে।
লোকজন তার আহবান শুনে আর অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। লোকটা বলে কী! এখানে একজন মূর্খ মানুষও নিজকে মূর্খ মনে করে না। কোন অর্থের বিনিময়ে কেউ রাজি হবে না মূর্খ হতে। লোকটার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়া দরকার। এমন ডাক আমরা শুনতে চাই না।
এই আলোচনা আরো ঘন গভীর এবং জটিল হয়ে কথা ওঠে এবং লোকজন বলে, ‘তুমি কোন অধিকারে মূর্খ লোক খুঁজতেছো। তুমি কী আমাদের এতো দিনের অর্জনকে মিথ্যা প্রমান করতে চাও। তুমি চিৎকার করে মূর্খ খুঁজবে না।’
সে তখন সিদ্বান্ত গ্রহণ করে আর কোনদিন মূর্খ খুঁজবে না। সে মনে করে সমাজে কোন মূর্খ নেই। একটা পরিপাটি অমূর্খ পরিবেশকে সে কলুষিত করতে পারে না, এ অধিকার তার নেই। সে আবার বিস্তৃত ধূলির প্রান্তরে বসে চিন্তামগ্ন হয়। কোন মূর্খ বন্ধুও যদি ভাগ্যে না থাকে তাহলে অনিঃশেষ ধূলিময় প্রান্তরই উত্তম। এখানে ভাবনাকে সীমাহীন দূরত্বে ছুঁড়ে দেয়া যায়।
এমন মাঠে একদিন ধূলিঝড়ে সে বেঁচেছিল। যে তাকে বাঁচিয়েছে সেই ছেলেটিকে, সেই প্রেমিক যুবককে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়। ছেলেটি তো এ পথে আসা যাওয়া করে।
কন্যা হন্তারক অপেক্ষা করতে থাকে।
একদিন প্রেমিক যুবক এ পথে তাকে দেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলে কন্যা হন্তারক চিৎকার করে তাকে থামতে বলে, ‘আরে যুবক দাঁড়াও দাঁড়াও বলছি। তুমিও কি জেনে গেছো আমি মূর্খ মানুষ খুঁজছি। কি বিপদ! কথা সবসময় বাতাসের আগে চলে। আমি বলছি না তুমি মূর্খ কিন্তু আমার সঙ্গে একটু কথা বলে যাও। তুমি দয়া করে থামো।’
তারপর যুবক নিজের গতি মন্থর করে দাঁড়ায় এবং তাকে বলে ‘আপনি কেমন আছেন?’
সে বলে, ‘কন্যা হত্যার পর কেউ ভালো থাকতে পারে?’
তার বোধের স্তরে আত্মজা হত্যার বেদনা দেখে যুবক বিবশিত হয় তবু ধারালো প্রশ্ন করতে বিলম্ব করে না।
‘কন্যা না হলে, অন্য কাউকে হত্যা করলে ভালো থাকা যায় তাহলে?’
‘এমন অভিজ্ঞতা আমার এখনো হয়নি। তুমি আমাকে ঘৃণা করো তা বুঝতে পারলাম।’
‘ঠিক আছে এখন বলুন কেন থামতে হলো আমাকে। আগে নিজের কথা বলি, আমি কৃষি কাজ করি। এবার বলুন, আমাদের বর্ধিত লোকজন কতোভাবে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে, আপনি কী ভাবে করেন?’
‘আমি কথা বিক্রি করি। আমি এক প্রেমিক প্রেমিকার হত্যার গল্প বলি। মানুষ কেন জানি  হত্যার গল্প শুনতে চায়। আমি তাঁদের মুখে মৃত্যু অঙ্কিত বিভৎস ছবি দেখি। আমি এক হন্তারক পিতার কথা বলি। যে পিতা তার কন্যাকে হত্যা করার পর প্রেমিককে কাছে পেয়ে জীবন বিনিময়ে জীবন গ্রহণ করেছে। তুমি ভাবছো, যে নিজের কন্যার হত্যার গল্প বলে দানাপানি যোগাড় করে তার আবার শোক কিসের। বিশ^াস করো যতবার এই গল্প বলি ততবার আমি শোকগ্রস্ত হই। অনুশোচনা আমাকে লতার মতো প্যাছিয়ে ধরে, লাফিয়ে ওঠে। আমি আরো বেশি বাচাল হয়ে ওঠি। হত্যাকারী বাচাল হলেও মুক্তি নেই।’
যুবক বলে, ‘আমি কী করতে পারি। বলে রাখি আমি কিন্তু এখন মূর্খ না।’
‘তুমি কী আবার কারো প্রেমে নিমিজ্জিত?’
‘না। সম্ভব না।’
‘তাহলে তো তুমি মূর্খই রয়ে  গেছো। চলো আমার সঙ্গে চলো। তিনি, সেই মহান দয়াবান বলেছেন একজন মূর্খ নিয়ে গেলে আমাকে অনুসূচনা থেকে মুক্ত করে দিবেন। তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসতে শুধু এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে চলো।’
‘ইতোমধ্যে আপনি লোভী হয়ে গেছেন।’
‘জিঘাংসা এবং লোভ পাশাপাশি থাকে। মেয়ে জন্ম দিয়ে মেয়েকে যে মুক্তি দিতে হয় এ কথা ভুলে ছিলাম বলে হত্যা করেছিলাম।’
‘আমার এতো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। আমি যে এখনো আপনার গলা চেপে ধরিনি এটাই আপনার ভাগ্য।’
‘তাই তো, তাই তো, আরো বলছি, মন দিয়ে শুনো। আমিও  তো চেয়েছিলাম, অপেক্ষায় ছিলাম সেদিন তুমি আমাকে হত্যা করবে। তুমি মূর্খ বলে হত্যা করোনি।’
‘না আপনার ধারনা ঠিক না। আমি আপনাকে হত্যা করলে যদি উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ফিরে আসতো তাহলে আপনাকে মুহূর্র্তে হত্যা করতাম।’
‘ঠিক বলেছো। আমিও তখন নিহত হতে তোমাকে প্ররোচিত করতাম। অন্তত তুমি ক্রোধের বশে আমাকে হত্যা করলে অন্যায় হতো না।’
‘ন্যায় অন্যায় জানি না। আমি আপনাকে ক্ষমাও করিনি হত্যাও করিনি। আমি যদি মূর্খ হই তবে মূর্খ।’
‘বাহ! এই তো ভালো ছেলের মতো স্বীকার করলে তুমি মূর্খ। আহ! ‘মূর্খ’। শুনতে কতো ভালো লাগছে! চারদিক  থেকে কতো নতুন প্রাণ জেগে ওঠছে। আচ্ছা বলো  তো- সকলে বলছে, আমাদের এখানে কেউ মূর্খ না। কোন মূর্খ নেই। ছি! কী নোংরা গন্ধযক্ত কথা। বমি আসে আমার। আমরা কী বুঝি না জ্ঞান কী। ছি! শুধু একে অন্যকে ঠকানো। তুমি বলো তুমি যে নিজকে মূর্খ ভাবছো তোমার ভালো লাগছে না। ইস! আমার মেয়েটা যদি বেঁচে থাকতো। কী চমৎকার মূর্খ জুটি হতে তোমরা দুজনে। চলো চলো আমার আর তর সইছে না। আমাকে রক্ষা করো।’
এক সঙ্গে বসবাসকারী সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত লোকজনের কাছে সংবাদ পৌঁছে, তারা দুইজন ধূলিময় মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলছে। সম্পর্কে বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী দুজন লোক এতোক্ষণ কথা বলতে পারে না। লোকজন এক এক করে তাদের দিকে আসতে থাকে। একসময় অনেক লোক তাদের ঘিরে ধরে। প্রশ্ন করে।
‘তোমারা দুজনে  কোন্ বিষয়ে কথা বলছো? আমরা জানি আমাদের মধ্যে আর কেউ মূর্খ নেই। সুতরাং কথা লুকাছাপারও কিছু নেই।’
তখন যুবক বলে, ‘আমি কিছুক্ষণ আগে স্বীকার করেছি এখনো আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে এখনো মূর্খ আছি।’
যুবকের কথা শুনে সকলে ছিছি করে বলে, ‘তুমি কৃষি কাজ জানো, আগে শীকার জানতে, তুমি কেন মূর্খ হবে!’
যুবক বলে ‘এখনো কাউকে নতুন করে ভালোবাসিনি, তাই আমি মূর্খ ছাড়া আর কী! আর ভালো বাসলেও মূর্খতা থেকে মুক্তির বিষয়টি ভিন্ন, আমি মনে করি মূর্খতা সরল জীবনের পূর্ব শর্ত।’
তার কথা শুনে সকলে একই রকম শব্দ করলে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো শুনা যায় ।
কে এক জন বলে, ‘তুমি কত জনকে হারালে পড়ে মূর্খতা থেকে মুক্ত হবে? এই কন্যা হত্যাকারী তোমাকে নিশ্চয় কথার প্যাঁচে ফেলে কথা আদায় করেছে। তুমি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলে আমাদের কিছু করার নেই। তুমি ইচ্ছে করলে মহান ক্ষমাবানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারো। নিশ্চয় তুমি পুরস্কার পাবে। তুমি যাতে  পথ না হারাও , লোকটার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হও , তুমি ক্ষদ্র অস্ত্রখানা সঙ্গে রাখতে পারো।’
এ কথা বলে বক্তা একটা ধারালো চাকু প্রেমিক যুবকের ডান হাতে গুঁজে দেয়, তারপর  তারা প্রত্যেকে প্রস্থান করে।
তিন দিন তিন রাত ধূলিময় মাঠের পশ্চিম অংশে অপেক্ষার পর তিনি- মহা দয়াবান- মহা প্রজ্ঞাবান সত্যি দেখা দেন। তিনি অযুত নিযুত শীতল জোস্নার পরত সরিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ান।
মধ্যযামের হিমেল হাওয়ায় তাদের (দুজনের) চিন্তামধ্যস্ত জটিলতার ধৌত কর্ম সম্পন্ন হয়  ভেজা জোছনায়।
তখন তিনি যুবককে বলেন ‘তুমি কি সত্যি এখনো মূর্খ আছো?’
যুবক কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘না- আমি মূর্খ নই।’
‘তাহলে কেন এসেছো? তুমি জানো নিশ্চয় আমি একজন মূর্খকে আসতে বলেছি।’
‘হ্যাঁ আমি জেনে শুনে এসেছি। আমি এই লোকটিকে কন্যা হারানো যাতনা থেকে মুক্তির বিনম্র অনুরোধ নিয়ে এসেছি। আপনি এই কন্যা হারানো পিতাকে মুক্ত করে দিন।’
যুবকের এমন বিনীত প্রার্থনা শুনে কন্যা হারানো লোকটি একটি চিৎকার দিয়ে ভূ-তলশায়ী হয়।
জোস্নামাখা ধূলুবালিতে গড়াগড়ি  শেষ হলে তার প্রাণ বায়ূ তাকে  ত্যাগ করে।
তিনি মহান দয়াবান তখন বলেন, ‘তার মুক্তি এভাবেই লেখা ছিল।’
যুবক মনে মনে বলে, ‘ আমি তাকে রক্ষা করতে পারলাম না প্রভূ। আমাকে ক্ষমা করো।’
শোনা যায়
সেই থেকে মূর্খ অমূর্খ কেউ কাউকে রক্ষ করতে পারে না।
সেই থেকে মূর্খতা থেকে বুদ্ধি, বুদ্ধি থেকে চালাকি উৎপন্ন হতে শুরু করে।
সেই থেকে জ্ঞানের শিল্পরূপ অজ্ঞান (সরলতা) দেখে মানুষ বার বার বিস্মিত হয়।