সড়ক দুর্ঘটনার অনেক ক্ষেত্রেই
দেখা যায়, পরিবহন শ্রমিক, অদক্ষ চালক কিংবা অন্য কেউ চালকের আসনে বসে হচ্ছে
হন্তারক। তাদের বেপরোয়া গাড়ি চালনা, ট্রাফিক আইন মান্য না করাসহ নানা
কারণে সড়কে মৃত্যুর মিছিল ক্রমাগত দীর্ঘ হচ্ছে। ফের একই মর্মন্তুদ ঘটনা
ঘটেছে শনিবার রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান টোল প্লাজার কাছে।
রোববার জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেঘলা ট্রান্সপোর্টের
দ্রুতগামী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক পথচারীকে চাপা দিয়ে এগোতে থাকে।
ওই যাত্রীবাহী বাসটির সামনে চলা বন্ধন পরিবহনের একটি বাসে সজোরে ধাক্কা
লাগে চাপা দিয়ে হত্যা করা ওই বাসের। দুই বাসের পাল্লাপাল্লির কারণে আরও
একজন পথচারী বাসচাপায় প্রাণ হারান। আমাদের স্মরণে আছে, ক'মাস আগে নটর ডেম
কলেজের শিক্ষার্থী কলেজে যাওয়ার পথে রাস্তা অতিক্রমের সময় গুলিস্তানে ঢাকা
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িচাপায় প্রাণ হারান। ওই গাড়িটি চালাচ্ছিল
একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী! এর পরদিনই আমরা এমন অঘটনের পুনরাবৃত্তি দেখেছি
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির সামনে। গত মাসে গুলিস্তানেই শ্রাবণ পরিবহনের একটি
যাত্রীবাহী বাস আটক করেন সেখানে কর্তব্যরত সার্জেন্ট এমদাদ। বাসের
কাগজপত্রে ত্রুটি পাওয়া গেছে জানিয়ে সব যাত্রী নামিয়ে বাসটি নিকটস্থ পুলিশ
ফাঁড়িতে নিয়ে যেতে চালকের আসনে বসেন ওই সার্জেন্ট। গাড়িটি ঘোরাতে গিয়ে তিনি
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। বাসটি চাপা দেয় চার পথচারীকে, যার মধ্যে দু'জন
প্রাণ হারান। সড়কে নৈরাজ্য কী ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, এসব তারই মর্মান্তিক
দৃষ্টান্ত।
আমাদের এও স্মরণে আছে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর
বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে বাসায় ফেরার সময় শহীদ বীরবিক্রম
রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মীম ও আব্দুল করিম
রাজীবের গাড়িচাপায় মৃত্যুর ঘটনা। তখন নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গড়ে ওঠে।
এই বর্বরতারই বা শেষ কোথায়? এসব
দেখভালের দায়দায়িত্ব যাদের, তাদের নিরুত্তর থাকার অবকাশ নেই। আমরা জানি,
দিয়া ও রাজীবের প্রাণহানির পর তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে
সরকার শাস্তি বাড়িয়ে সড়ক আইন জাতীয় সংসদে পাস করে। এর পরও সড়কে মৃত্যুর
মিছিল থামছে না! শনিবার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ও এর আগে এমন প্রাণহানির
ঘটনাগুলো নিছক সড়ক দুর্ঘটনা নয়। এ যে রীতিমতো হত্যাকাণ্ড। সুশাসনের অভাব
কতটা বিদ্যমান- সড়কে বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্য এরই দৃষ্টান্ত।
রোববার
সংবাদমাধ্যমে নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন 'রোড় সেফটি ফাউন্ডেশন' ও
'নিরাপদ সড়ক চাই'-এর প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না
করে পারে না। সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয়
সহস্রাধিক মানুষ। আমরা মনে করি, সরকারের দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনার
কারণে সড়কে হতাহতের সংখ্যা কমছে না। পরিবহন খাতে বিরাজমান নৈরাজ্য,
অনিয়ম-দুর্নীতিসহ জীবনের জন্য হুমকি এমন সবকিছু নিরসনে জরুরি রাজনৈতিক
সদিচ্ছাও।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ঘটনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্রুত
বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও 'প্রভাবশালী' পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে এক
পর্যায়ে সবকিছু থেমে যায়! হন্তারক ও স্বেচ্ছাচারীদের আইনের আওতায় এনে
দৃষ্টান্তযোগ্য দণ্ড নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায়
আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন জরুরি, তেমনি উপযুক্ত অবকাঠামোগত ব্যবস্থা ও
দায়িত্বশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। আমরা
অনতিবিলম্বে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই।