
মনজুরুল আজিম পলাশ ||
আব্বার প্রস্থানের পর আমরা ঢাকা থেকে কুমিল্লা চলে আসি। শহরের ঝাউতলা এলাকা ছিল আমাদের দাদার বাড়ি। ঢাকাতে আমি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। মনে আছে, কুমিল্লা হাই স্কুলে আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। স্কুলটিতে প্রথম এসেই চোখে পড়েছিল একটি দীর্ঘ আড়াইতলা ভবনের বা পাশে একটানা একটি লম্বা সিঁড়ি যা দিয়ে দোতলায় স্কুলের প্রশাসনিক অংশে পৌঁছানো যেত। প্রথমেই শিক্ষকদের একটি বড় রুম। তারপর একে একে প্রধান শিক্ষক, রেকটর, বেতন নেয়া এবং আনুষঙ্গিক কাজের দপ্তর ইত্যাদি। দাপ্তরিক রুমের ঠিক সামনেই একটি পিতলের ঘন্টা ঝুলতো। এই ঘন্টার সকালের ধ্বনি আর বিকেলের ধ্বনির মধ্যে প্রার্থক্য ছিল আকাশ পাতাল। শৈশবে স্কুলের চেয়েও স্কুল ছুটির ঘন্টা ধ্বনি অনেক আনন্দদায়ক ছিল।
এই স্কুলটিতে আমার পাঁচ বছর কেটেছে। এখান থেকেই আমি ১৯৮৩সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল (একাধিক বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগ) করে সেই সময় স্কুল এবং পরিবারের ‘মুখ উজ্জ্বল’ করেছি। আমাদের আমলে ‘মুখ উজ্জ্বল’ কথাটাই ব্যবহৃত হতো।
আমি ঝাউতলা বাসা থেকে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করেছি। স্কুল যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিন দুইবার ধর্মসাগর দেখা হতো আমার। এই ধর্মসাগর আমার উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছে সেই শৈশব থেকেই। স্কুল যাওয়া-আসার পথের এই ধর্মসাগর তার বিশালতা, সৌন্দর্য আর প্রশান্তভাব দিয়ে আমার মনোজগৎ সমৃদ্ধ করেছে। আমার স্কুলের সকল ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে এই ধর্মসাগর। ধর্মসাগরের সাথে সেই থেকে আমার আজন্ম সখ্য।
আমাদের স্কুলে খুব গাছ গাছালি ছিল না। দোতালা-তিনতলায় যখন ক্লাস করেছি তখন স্কুলের পেছনের নারকেল গাছগুলো দেখা যেত। গ্রীষ্মের বিষণ্ন দুপুরে বাতাসে সেই নারকেল গাছের পাতার দুলনি দেখতে ভালো লাগতো। আমি যে কতদিন জানালা ভেদ করে সেই দুলনির সাথে মিতালি পেতেছি। বৃক্ষ-সবুজহীন স্কুলে এই সামান্য গাছগুলোই যেনো অসামান্য হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতো সমস্ত প্রকৃতির। শৈশব থেকেই আমি প্রকৃতি-সবুজ ভালোবাসি। স্কুলের লেইজার (টিফিন) পিরিয়ডে এক টাকা/দুইটাকা দিয়ে সামনের মোবারক বেকারি থেকে খাস্তা বিস্কিট বা একটা বাটার বন খেয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু চলে যেতাম গাছ গাছালি সমৃদ্ধ সার্কিট হাউজের ভেতরে। সার্কিট হাউজের সবুজ-ছায়াময়-নির্জন পরিবেশে দুপুরে সময় কাটাতে দারুণ লাগতো।
আমাদের স্কুলটি ছিল শহর এবং গ্রামের এক সেতু বন্ধনের মতন। আমাদের সহপাঠীদের অনেকেই আসতো গোমতীর ওপার থেকে। আমড়াতলী, শিমপুর, রত্নবতী নামগুলো তখন থেকেই পরিচিত। এরা আসতো নদী-খেয়া পেরিয়ে, গোমতী নদীতে তখন অনেকগুলো খেয়াঘাট। সেই সহপাঠীদের উৎস খুঁজতে গিয়েই আমি গোমতীর দেখা পাই। তখন মনে হতো গোমতী নদী অনেক দূরে। আমার বিস্ময় লাগতো যে তারও আরো দূরের অদৃশ্য গ্রামগুলো থেকে আমাদের সহপাঠিরা স্কুলে আসে। আমাদের স্কুলটি ভৌগোলিক ভাবেও অনেকটা শহর এবং গ্রামের সংযোগ স্থলে অবস্থিত ছিল। স্কুলের পাশের রাস্তা ধরে প্রায় দেড় দুই কিলোমিটার এগুলেই সরাসরি গোমতীর দেখা মিলতো। যারা নদীর ওপার থেকে আসতো তাদের পোশাকে চেহারায় আচরণে ছিল গ্রামীণ সারল্য ও আন্তরিকতার আলাদা ছোঁয়া। এরা ছিল এক একজন কবি জসিম উদ্দিনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার বাহক। তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
আমরা একগুচ্ছ নিবেদিত শিক্ষক পেয়েছিলাম। নামের শেষে স্যার শব্দ যুক্ত করেই আমরা এঁদের ডাকতাম। এঁরা আমাদের শাসন করেছেন, আদর করেছেন। পরবর্তী পরিণত জীবনে এই শিক্ষকদের কারো কারো আচরণ খুবই আপত্তিমূলক-সামন্ত হিসেবে প্রতিভাত হলেও এটিই ছিল আমাদের সমাজ-সময়ের এক শ্বাশত চিত্র। এখন বুঝি, শিক্ষকরা যদি জানতেন তাঁদের সেই রূঢ় আচরণ ছাত্র-শিশুদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের অন্তরায় তাহলে হয়তো তারা তা করতেন না। এখনকার সময়ে ছাত্রদের শারীরিকভাবে আঘাত করে শাস্তি দেবার প্রচলন প্রায় নেই বললেই হয়। আমাদের সন্তানরা ভাবতেই পারবে না যে আমরা সেই জালিবেত আর চড় থাপ্পড় আমলের ছাত্র ছিলাম।
আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম তা নয়। সবসময় ভালো ফল করা বা সামনে বসা বা ক্লাসে ক্যাপ্টেন জাতীয় কিছু ছিলাম না কখনো। কিন্তু কিছু বিষয় খুব ভালো লাগতো। বাংলায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেতাম। জ্যামিতি খুব ভালো পারতাম। ক্লাস সেভেন না এইট মনে নেই, একবার পাটিগণিত-বীজগণিত শূন্য পেয়ে শুধু জ্যামিতিতে ৩৪-এ ৩৪ পেয়ে অংকে পাশ করেছিলাম। আমাদের সময় মাধ্যমিক পরীক্ষায় ধর্ম শিক্ষার বদলে জিটিডি (জিওমেট্রিক্যাল ট্যাকনিক্যাল ড্রয়িং) বলে একটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়, আমাদের স্কুলে সম্ভবত আমিসহ মাত্র তিন/চারজন সেই বিষয়টি নিয়েছিলাম। আমাদের স্কুলে এই বিষয়ের কোন শিক্ষক ছিলোনা বলে আমরা জিলা স্কুলের আলী আকবর স্যারের কাছে এই বিষয়ে প্রাইভেট পড়েছি। এখন বুঝি, শৈশবের জ্যামিতি-জিটিডি প্রীতি আমাকে পরবর্তী জীবনে স্থাপত্যের বিষয়ে এতটা আগ্রহী করেছে। একবার প্রবাস জীবনে লন্ডনে আমার মেয়ের একটি জ্যামিতিক পাঠ্য সমস্যারও আমি সমাধান করেছিলাম। আসলে আমাদের সকল আগ্রহ-বৈশিষ্ঠ শৈশবেই লুকিয়ে থাকে যা সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয় শিক্ষক কিংবা অভিভাবকরা।
আমাদের স্কুলে বিজ্ঞানাগার ছিল। বিজ্ঞানের (গর্বিত) ছাত্র হিসেবে আমরা তা ব্যবহার করেছি। তখন সমাজে বিজ্ঞানের ছাত্রদের বিশেষভাবে আলাদা এবং মেধাবী মনে করা হতো। দশম শ্রেণীতে আমাদের ক্লাসরুমটিও আলাদা ধরণের ছিল, একটি গ্যালারির মত। আমরা বাণিজ্য বা কলা অনুষদের ছাত্রদের কিছুটা তীর্যকভাবেই দেখে বিজ্ঞানাগারে বা ক্লাসরুমে প্রবেশ করতাম। বিজ্ঞানাগারে বিশেষত রসায়নের নানা নিরীক্ষা ভালো লাগতো। লাল লিটমাস নীল বা নীল লিটমাস লাল ঠিকঠাকমত না হলেও বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আমাদের থেকেই যেত। পরবর্তী জীবনে বুঝেছি, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং উপুযুক্ত উপাদান উপকরণ ব্যাতিত এইসব নিরীক্ষা আমাদের কোন কাজেই আসেনি। এও জেনেছি, একটি উন্নত বিশ্বে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের বিজ্ঞানাগারেই সমাজের বিজ্ঞানীদের ভ্রূণ সৃষ্টি হয়। সেই তুলনার কথা এখন থাকুক। ভুলে যাই না যে তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশেই আমাদের জন্ম হয়েছিল।
বরং দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন খুব উপভোগ করেছি টেবিল টেনিস। কমার্স বিভাগের টিন শেডে কোত্থেকে কিভাবে একটি টেবিল টেনিস বোর্ড-সরঞ্জাম এসেছিলো আজও তা জানিনা। স্কুল শেষে আমরা কজন মেতে থাকতাম এই খেলায়। ঘন্টার পর ঘন্টা। আমি, নাসির, জামান আর সাজিদ। আমার বৈশিষ্ট ছিল বিশেষভাবে সার্ভ করা, যাকে বলে স্ক্রু। নাসির (নাসির উদ্দিন মজুমদার), জামানও (এম জামানুর রহমান) খুব ভালো খেলতো। জামান মাধ্যমিক পরীক্ষায় পুরো বিভাগে ‘স্ট্যান্ড’ করেছিল, নাসির আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন আজও।
স্কুল জীবনে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ খুব স্মরণীয়। শীতকাল। আমরা পিকনিক এর আয়োজন করেছিলাম, চাঁদা সম্ভবত ১০০ টাকা, গন্তব্য কক্সবাজার। একটা চমৎকার ড্রাইভার সমিতির বাস দিয়ে ৩ রাতের জন্যে আমরা কক্সবাজার চলে গিয়েছিলাম। সেই কি আয়োজন আর উত্তেজনা আর প্রস্তুতি। জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শন করবো। আমাদের বন্ধু সাজিদের (সাজিদুর রহমান) ১১০ ক্যামেরা নেয়া হলো, কুমিল্লা নিউ মার্কেট থেকে চাঁদা দিয়ে কেনা হলো বিশেষ ১১০ ফিল্ম, কক্সবাজারে হিসাব করে সিঙ্গেল ও গ্রুপ ছবি তোলা হয়েছিল সেই ক্যামেরা দিয়ে। একদিন খুব ভোরে এভাবেই আমরা যাত্রা করলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। দক্ষ এক ড্রাইভারের চালনায় স্বপ্নময় সেই বাস সেদিনই গিয়ে পৌছালো প্রায় পর্যটকহীন কক্সবাজারে। একটি স্কুলে আমাদের থাকার আয়োজন হলো। জীবনে প্রথম সচেতনভাবে রূপচাঁদা মাছ খেলাম। আমরা বন্ধুরা ঘুরে বেড়ালাম নির্জন সৈকত, মায়াময় ঝাউবন, শুভ্র প্যাগোডা আর রূপসী রাখাইন নারীদের পরিচালিত বার্মিজ মার্কেটে। রাতে ঘুরতে ঘুরতে বাতিঘরের উজ্জ্বল আলোকে স্নাত হলাম আমরা। স্কুল জীবনের প্রথম কক্সবাজার ভ্রমণের সেই আনন্দ সেই বহুমাত্রিক সৌন্দর্য সেই স্নিগ্ধতা আর পূর্ণতাবোধের দেখা পাইনি আর পরবর্তী জীবনে। শীতহীন সমুদ্রের সেই নির্মল আদুরে বাতাস এখনো আমার গায়ে লেগে আছে। সেই সময়ে খুব কম বিনিয়োগে আমরা প্রচুর সুখী হতে পারতাম।
এরপর মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় চলে আসলো। ১৯৮৩। তার আগে বিদায়ী সভার আয়োজন হলো। উন্মুক্ত মাঠের সেই আয়োজনে ছাত্রদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখলাম আমি। স্কুল থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেয়া হলো। আমরা সবাই প্রবেশ করলাম পৃথিবীর পাঠশালায়।
কুমিল্লা হাই স্কুল আমার জীবনের এক অনিবার্য অধ্যায়। আমার স্কুল সহপাঠীরা পড়াশুনা শেষে জীবনের তাগিদে তাদের রত্নবতী গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলেও এখনো আমি তাদের খুঁজতে রত্নবতী গ্রামে যাই।