
শফিকুল ইসলাম ।।
আত্মহত্যা
সমাজে এক মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে কাজ করছে। প্রতিদিন বা সপ্তাহে কেউ না
কেউ আত্মহত্যা করছে। ইদানীং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা অনেকে
আত্মহত্যা করে থাকে। আত্মহননে দেশ-জাতি হারিয়েছে অনেক মেধাবী ও তরুণ
শিক্ষার্থীকে। আর অভিভাবক হারিয়েছেন তার প্রিয় মেধাবী সন্তানকে। এ ক্ষতি
কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না।
করোনাকালে ১৯ মাসে আত্মহত্যা করছে ১৮০ জন।
এর পেছনে কারণ রয়েছে পারিবারিক সমস্যা, প্রেমের সম্পর্কজনিত দুশ্চিন্তা,
বিষণ্নতা, ক্যাম্পাস বন্ধ থাকা, অবসাদ, আর্থিক সংকট, কিছু পাওয়ার জেদ, না
পাওয়ার হতাশা, পড়াশোনার চাপ, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, মানসিক নির্যাতন,
চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণ ইত্যাদি। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা শুনতে হয়। এ জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
কিন্তু অনেক সময় প্রকৃত উদ্দেশ্য বের করা হয় আবার কখনো হয় না।
কয়েক মাস
আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী
সুপ্রিয়া দাস আত্মহত্যা করেন। গণমাধ্যমে জানতে পারি, কলেজে পড়াশোনা করা
অবস্থায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তপুর সঙ্গে
ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওই শিক্ষার্থীর। কিছুদিন আগে তপু আত্মহত্যা
করেছিলেন। তপুর আত্মহত্যার জন্য সুপ্রিয়াকে সামাজিকভাবে দোষারোপসহ নানা
কটূক্তি করা হয়। সামাজিক ও মানসিক চাপেই সুপ্রিয়া আত্মহননের পথ বেছে
নিয়েছেন বলে মনে করেন তার নিকটতম বন্ধুরা। ঈদের দিন রাতে সন্ধ্যায়
ফরিদপুরের নিজ বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন। এ রকম ঘটনা প্রায় সব
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে। তা দিন দিন বেড়েই চলছে। আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী
নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করে এক
শিক্ষার্থী। এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। সে তাদের ব্যাচের প্রথম সারির ছাত্রী
ছিল। এ ছাড়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের এক ছাত্রী অনুষদ বিল্ডিংয়ের
ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে
আত্মহত্যা করেছে ২৩ বা এর বেশি ছাত্রছাত্রী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
গত ১০ বছরে ১১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। তাদের মধ্যে ছয়জন মেয়ে ও পাঁচজন
ছেলে। দেশের এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ কী, তা নিয়ে রয়েছে
নানা ব্যাখ্যা ও মতামত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো
প্রতিকারব্যবস্থা নিয়েছে কিনা জানি না। তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক
জরিপের ফল অনুসারে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৪ জুন পর্যন্ত দেশে
১৫১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৭৩ স্কুলশিক্ষার্থী, ৪২ জন
বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজশিক্ষার্থী ও ২৯
জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন। তবে এ সংখ্যা ২০১৮ সালে ১১ ও ২০১৭ সালে ১৯
ছিল। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪
ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন।
নানা কারণে চাপে থাকা শিক্ষার্থীদের
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দপ্তর রয়েছে।
‘ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ দপ্তর’ নামের এই দপ্তরে একজন শিক্ষক কাউন্সিলর
বা পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে থাকেন। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী
নেই বললে চলে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুসারে প্রতিটি বিভাগে
একজন করে মনোবিজ্ঞানী থাকা উচিত। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য
একজন ছাত্র উপদেষ্টা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও
শিক্ষার্থীরা। আবার যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন- এর পেছনের কারণ কী, তা
উদ্ঘাটন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ তেমন চোখে পড়েনি।
পরামর্শ দপ্তরও এ বিষয়ে কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আবার পরামর্শ দপ্তর সম্পর্কে অনেক শিক্ষার্থীর ধারণা নেই যে, এ দপ্তর
তাদের জন্য কী করতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও উদ্যোগের অভাব রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
পরামর্শ দপ্তরে স্থায়ী পরামর্শকের পদ আরও বৃদ্ধি করা উচিত বলে মনে করেন
আমাদের অনেক সহকর্মী। প্রতিটি বিভাগে একজন সহকারী ছাত্র উপদেষ্টা দরকার এবং
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া
একান্ত জরুরি। তা হলে এই আত্মহত্যা কিছুটা হলেও কমানো যাবে। আত্মহত্যা
বন্ধে অভিভাবকদের দায়িত্ব রয়েছে- ছেলেমেয়ে রাগ করলে তাকে নজরে রাখতে হবে
এবং যত দ্রুত সময়ে তাকে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আবার অনেক
শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের কাছে যেতে লজ্জা পান।
তবে শিক্ষার্থীদের উচিত হবে যে কোনো সমস্যা হলে শিক্ষকের শরণাপন্ন হওয়া।
কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাদের অভিভাবক। অবশ্য অনেক শিক্ষার্থী
পরীক্ষাভীতি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা, মানসিক চাপ,
বিষণ্নতা- এসব সমস্যা নিয়ে মাঝে মধ্যে শিক্ষকদের কাছে আসেন। শিক্ষকদেরও
দায়িত্ব রয়েছে, তারা যেন পাঠদান কক্ষে এবং অন্যান্য সময়ে শিক্ষার্থীদের
জীবনের মূল্য ও জীবন নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক দিকনির্দেশনা দেন- যা তাদের হতাশা
কমাতে সহযোগিতা করে। আত্মহনন প্রতিরোধে প্রধান কাজ হলো ব্যক্তিগত ও
গোষ্ঠীভিত্তিক মানসিক পরামর্শ, শিক্ষার্থীদের যে কোনো সংকটে সহযোগিতা এবং
সমস্যা নিয়ে পরামর্শ, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রচার, ক্যাম্পাসের
নিরাপত্তা পর্যালোচনা, স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা এবং অনুষদ বা বিভাগভিত্তিক
সচেতনতা সৃষ্টি করা। বিশেষ আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের সহায়তার বিষয়ে
জোর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার তীব্রতা ভয়ানক।
তবে কোনো আত্মহত্যা সমাজ বা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, বরং খুবই দুঃখজনক।
প্রতিকারব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরামর্শ ও সেবা
দেওয়ার গুরুত্ব অনেক এবং আত্মহত্যা বন্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিস্ট
নিয়োগ জরুরি। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ট্যান্ডার্ড নীতিমালা ও দক্ষ
মনোরগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে দ্রুত মানসিক সেবা চালু করা একান্ত প্রয়োজন।
১৯৯০ সালের শুরুতে প্রথম গ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক ও ব্যক্তিগত- উভয়
বিভেদ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শের
প্রয়োজনীয়তার জন্য সচেতনতার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম ছাত্র কাউন্সেলিং
সেন্টার ১৯৯০ সালে এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আনাস্তাসিয়া
কালান্টজি-আজিজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়
কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে। দিন দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা
সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। তাই ছাত্র পরামর্শ দপ্তরের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক
পরামর্শের জন্য আলাদা অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বা কর্মী দিয়ে সব শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হোক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও সাইকোলজিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে
আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটা কমিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। পর্যাপ্ত কাউন্সেলিংয়ের
সুযোগ না থাকায় শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার মতো ভয়ানক পন্থা অবলম্বন করে থাকে
বলে অনেকে মনে করেন।
মানসিক সমস্যা ও বিষণ্নতায় ভুগতে থাকা
শিক্ষার্থীদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে
করছেন অনেক শিক্ষাবিদ। কারণ বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মনোবিদ ও মনোচিকিৎসক নেই।
দেশে প্রায় ৩০০ মনোচিকিৎসক ও ৪০০-৫০০ জনের মতো মনোবিদ রয়েছেন। সরকার বা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই কোভিড-১৯ সময়ে পাঠদানের ক্ষতিপূরণ ও
মানসিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, এ বিষয়ে
দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আর যারা পড়াশোনা শেষ করে বেকারত্বে ভুগছেন,
তাদের জন্য চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করা। একই সঙ্গে তাদের প্রণোদনা দিতে হবে-
যাতে তারা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হন। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঝুঁকিতে পড়বে
এবং দেশ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি মনে করি- এই সমস্যার সমাধানে বিশ্লেষক,
শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে একটি সম্মিলিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে
হবে; যার আলোকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মহনন বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ
করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), ত্রিশাল, ময়মনসিংহ