
ওয়ালিউল্যাহ রিপন ||
অজানাকে জানা এবং অদেখাকে দেখার আগ্রহ মানুষের রক্তের সাথে মিশে আছে। নতুন জিনিসের সাথে পরিচিত হওয়ার এ ইচ্ছা সৃষ্টির শুরু থেকেই। তাছাড়া মানুষ গৃহকোণে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করার ফলে মানুষের মধ্যে ক্লান্তিবোধ নেমে আসে। অজানাকে জানার জন্যে, অদেখাকে দেখার জন্যে, আমাদের পরিচিত গণ্ডির বাইরে অপরিচিত জগৎকে দেখার জন্যে অন্তরের আকুল আগ্রহে আনন্দ অনুভব করি প্রতিনিয়ত। দিনের পর দিন একই পরিবেশে জীবন-যাপন করে আমাদের মন বিষিয়ে ওঠে। আমরা তখন একটু বৈচিত্র্যের আস্বাদন পেতে চাই। পুরো বিশ^কে থমকে দেওয়া মহামারিকেও জয় করে বিশ^ এখন সচেতনতাকে বরণ করেছে এগিয়ে যাবার সহায়ক পন্থা হিসেবে। অদম্য ইচ্ছার কাছে যেভাবে হার মানে সকল বাঁধা, তেমনি আমার নিজের মাঝে একাগ্রচিত্তে মনে বাসা বেঁধে থাকা পৃথিবী দেখার স্বপ্নের যেন সামান্যও কমতি হয়নি। যদিও বিশ^জুড়ে এমন ভয়াবহ মহামারি সামান্য বিলম্বের কারণ হলেও ঘুরে বেড়ানোর মত্ত্ব নেশাচ্ছন্ন হৃদয় কি আর মানে কোন বাধা? সেই ভাবনা আর আত্মবিশ^াসের যোগসাজসে দীর্ঘদিন ধরে মনে লালিত স্বপ্ন আর ইচ্ছা যেন কাবু করেছে আমার মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণের চিন্তার উপর। কথায় বলে ‘দশের লাঠি-একের বোঝা’ এমন চিরন্তনী প্রবাদকে সাধুবাদ জানিয়ে আমরা মোট আটজনের সহমত যোগ করেছি আমার ভ্রমণ পরিকল্পনার সাথে। ব্যাখ্যা করে বলা যায়, স্বদেশের মাঝে একটানা দীর্ঘদিন লকডাউন নামের শিকলে বাঁধা জীবনকে না চাইতেও স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিকদের সাথে তাল মিলিয়ে মেনে নিতে হয়েছে। তাতে করে কম-বেশি সবাই যেন দেহ ও মনের দিক থেকে এক প্রকার হয়ে উঠেছে অনেকটাই অলস আর ক্লান্ত। আর আমার এমন ধারণার পক্ষে ঐক্যমত পোষণ করা আমিসহ আমরা মোট আটজন মিলে গঠন করি দেশ ভ্রমণের ট্যুর টিম। এক কথায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশে^ বয়ে চলা প্রলয়ংকারী করোনা ভাইরাস নামীয় মহামারির ঢেউয়ের বিপরীতে আমার এমন ভ্রমণ চিন্তাটা যেন রীতিমতো একটি মিশন। অবশেষে সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের উপর বিশে^র বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার শিথিলতায় আমাদের ট্যুর-টিমের একাগ্র ইচ্ছা এবং চেষ্টায় দীর্ঘ প্রত্যাশিত গগনচুম্বী স্বপ্নকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি বাস্তবতা ও সম্ভাবনার দুয়ারে। এর আগেও আমি ঘুরেছি বিশে^র কয়েকটি দেশে। স্মৃতির মানচিত্রে জমিয়েছি অসংখ্য গল্প, অসংখ্য জায়গার চিত্র। এবারও ঠিক তেমনি নতুন মাত্রায় ভিন্ন এক অভিজ্ঞতাকে যোগ করেছি সেই স্মৃতিতে। তাই প্রিয় পাঠকদের সামনে আজ মেলে ধরতে নিয়ে এসেছি আমার এবারের মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণের সেই মানচিত্র।
সমগ্র পৃথিবী জুড়ে একটানা দীর্ঘ দুই বৎসর যাবত চলছে করোনা ভাইরাস নামক এক প্রলয়ংকারী মহামারির প্রাদুর্ভাব। যার প্রাণঘাতী আঘাতে থমকে গিয়েছে পুরো বিশ^। যার ফলে ভ্রমণবিলাসী মন আমার দীর্ঘ দুইটি বৎসর যাবত একই গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকায় ঘুরে-বেড়ানোর সুযোগ হয়নি কোথাও। প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রের ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও বিপর্যয়ের কাছে বিলম্বের শিকারে পরিণত হয়েছে এই আমার ভ্রমণ ইচ্ছা। এরই মাঝে পরিস্থিতি সাময়িক শিথিলতায় রূপ নিলে ভ্রমণ পরিকল্পনায় কালবিলম্ব করলাম না। আমাদের দেশের মানুষজন যেন দেশভ্রমণ বলতেই ইঙ্গিত করে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরকেই। কিন্তু এবার আমার ভ্রমণ পরিকল্পনায় স্থান দিলাম সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম আর বৈচিত্র্যময় মধ্য এশিয়ার অন্যতম মুসলিম প্রধান দেশ কিরগিজস্তান, তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্থানের মতোই কোন এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী তুর্কী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত রাশিয়া থেকে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোতে। এ যাত্রায় আমার ভ্রমণের মূল গন্তব্য ছিল উজবেকিস্তানের মুসলিম ঐতিহ্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থানগুলোতে। যা আমাদের দেশের ট্যুরিস্টদের কাছে একেবারেই অপরিচিত একটি নাম। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের টুরিস্টগণ এখানে তাদের অবকাশ জীবন যাপন এবং ছুটি উপভোগ করেন অত্যন্ত চমৎকার ভাবে। উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তান এই দুইটি দেশের ভিসা সংগ্রহ করাতেই বাকী দুইটি দেশভ্রমণের অনুমতি মিলে খুব সহজেই। কিন্তু আফগানিস্তানে তালেবান জটিলতা ও মহামারি করোনার ইস্যুকে সামনে রেখে উজবেক সরকার বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের নাগরিকদের জন্য তাদের দেশে প্রবেশাধিকার নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করায় এই সফরের ছন্দপতন সূচিত হলো। যার কারণে উজবেকিস্তান, তাজাকিস্তান ভ্রমণকে অপূর্ণাঙ্গ রেখেই দুইটি দেশের মধ্যে আমার এই ভ্রমণকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে।
কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানাই আমার ভ্রমণপ্রিয় বন্ধু মুরাদনগরের কৃতিসন্তান, বর্তমানে থাইল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা, ডিসকভারী থাইল্যান্ড ট্যুরস্ এন্ড ট্রাভেলস্ এর স্বত্ত্বাধিকারী সাঈদ ইসহাক যার ব্যবস্থাপনা ও আন্তরিক সহযোগিতায় ভিসা প্রসেসিং সহ প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমে দীর্ঘ দুই বৎসর পর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে শুরু করলাম আমাদের এই ভ্রমণ যাত্রা। রীতিমতো আমরা আটজন মিলে মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সকল করণীয় ফরমালিটি সম্পন্ন করে দুই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রার শুভ সূচনা করি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চোখ রেখে প্রকৃতির অবারিত রূপরেখাকে উপলব্ধি করা আমার জীবনের একটি অন্যতম শখ বলা যায়। প্রতিবারের মতো তাই এবারও রূপসী বাংলার সবুজ অরণ্যে বিজড়িত নৈসর্গিক দৃশ্যকে এক ঝলক উপভোগ করলাম বিমানের জানালার পাশে বসা সিট থেকে। নীলাভ আকাশের কালো মেঘ ভেদ করে উড়ে চলেছি কাঙ্খিত উদ্দেশ্যে, তখনই একত্রে আমার জন্মভূমি রূপসী কন্যাকে এক পলক পরখ করতে ভুললাম না। অসাধারণ সেই চিরচেনা দৃশ্য। দীর্ঘযাত্রাপথ অতিক্রম করে প্রথমেই নির্ধারন করলাম মধ্যএশিয়ার মুসলিম দেশ নব্বইয়ের দশকে রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা অর্জনকারী অন্যতম একটি দেশ কিরগিজস্থান। আর আমার এই ভ্রমণের প্রধান শিরোনামই এই কিরগিজস্থান। কারণ এখানে থেকেই আমি আমার এবারের ভ্রমণকে সফলভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি। গুগল ম্যাপে দেখলাম, দেশটি মোট আটটি প্রদেশে বিভক্ত। যার মাঝে আমার প্রায় পাঁচটিতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রদেশগুলো হচ্ছেÑ বিশকেক, ইসিক-কুল, জালালাবাদ, উশ সিটি, বেতকেন, নারাইন, কারাকল, তালাশ। দেশটির তিনটি বিখ্যাত পর্যটন স্পট ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’র তালিকাভূক্ত। জায়গাগুলো হচ্ছে- সিল্ক রোড, তিয়ানশান পর্বতমালা, সোলায়মান পর্বত।
এমিরাত এয়ারলাইন্সে দুবাই হয়ে তিন সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে পৌঁছে যাই অনিন্দ সৌন্দর্যমন্ডিত মুসলিম প্রধান দেশ কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেক। ইসহাক ভাইয়ের বড় ভাই হাসান ভাই ও তার এক বন্ধু বিশকেকের অধিবাসী ইব্রাহীম ভাইয়ের নিমন্ত্রণেই আমাদের এই কিরগিজস্তানের ভ্রমণ। মুসলিম প্রধান দেশ হওয়াতে শুক্রবার জুমাবার থাকায় জুমার সালাত আদায় করার সৌভাগ্য হয় বিশকেক মূল শহরে তুর্কী নির্মিত সেন্টার জামে মসজিদে। অসাধারণ নির্মাণশৈলী ও কারুকার্য খচিত, সুউচ্চ চারটি মিনার ও অনেকগুলো গম্বুজ বিশিষ্ট আকৃতিতে এক মনোরম পরিবেশে নির্মিত এ মসজিদটি। পুরো মসজিদ প্রাঙ্গণটি আমার দৃষ্টিতে এতটাই অসাধারণ ছিল যে চতুর্পাশের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। তাই মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্যকে স্মৃতিপটে আটকে রাখতে ক্যামেরাবন্দী করলাম মসজিদের ভিতরে ও বাহিরের অনেকগুলো দৃশ্যকে। নামাজ শেষে ইব্রাহীম ভাইয়ের উদ্যোগে পরিবেশন করলাম হাজার বছরের তুর্কী মুসলিম ঐতিহ্যরীতিতে পরিবেশিত বাহারী খাবার। অসাধারণ অমৃত স্বাদ যেন ছুঁয়ে আছে রুচিশীল স্বাস্থ্যসম্মত প্রতিটি খাবারে। সবাই মিলে একসাথে বিশালাকার টেবিলে সজ্জিত বাহারী হরেক রকম খাবারের তালিকায় থাকা সবগুলো খাবারই ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। তবে তার চেয়েও বেশি ছিল তাদের আন্তরিকতার মিশেলে আপ্যায়ণ ব্যবস্থা। কোমল মানসিকতার এই মানুষগুলোকে মনে থাকবে তাদের আচরণে মিশ্রিত ভালবাসার অকৃত্রিম ভূমিকার জন্য।
পুরো ভ্রমণের সবটুকু সময়জুড়ে এই কিরগিজস্তানে থেকেই দেখেছি সবগুলো স্থান। মজার বিষয় ছিল কিরগিজস্তানের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো যদিও আমাদের বাংলাদেশ তুলনায় নিম্নমান তবুও এখানকার প্রকৃতি, কৃত্রিম ও অকৃত্রিম সবকিছুই যেন মডার্ণ কালচারে সমৃদ্ধ। মজার ব্যাপার হলো, এখানকার স্থানীয় নাগরিকের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং নিরানব্বই শতাংশ জনগণ শিক্ষিত হলেও তাদের মাঝে ইংরেজি ভাষার জ্ঞান আছে মাত্র হাতে গোনা দশ থেকে ১৫ শতাংশ। আমার ধারণা ভুল হবে কি না জানিনা, কোভিড টেস্ট করাতে গিয়ে এক ডাক্তারের সাথে আলাপচারিতায় বুঝতে পারি তিনিও ইংরেজি কথোপকথনে তেমন পারদর্শী না। ড্রাইভার ও হোটেল বয় তো দূরের কথা। জানলাম তাদের বেশির ভাগই উচ্চ শিক্ষা পরিচালিত হয় ‘রাশিয়ান’ ও ‘কিরগিজ’ ভাষায়। কিছু কিছু লোক তুর্কি ভাষাও কথা বলে থাকে। মূলতঃ এই তিন ভাষাই তাদের জনগণের মুখের ভাষা। এক লক্ষ্য নিরানব্বই হাজার নয়শত একানব্বই বর্গকিলোমিটার দেশটিতে প্রায় আশি ভাগ লোকই বসবাস করে পাহাড়ি অঞ্চলে। মোট পাহাড়ি ভূমির মাত্র বিশ শতাংশ ভূমিতে জনগণের আবাসস্থল লক্ষ্যণীয়। বিশে^র পঁয়তাল্লিশটি স্থলবেষ্টিত দেশের মধ্যে কিরগিজস্থান হচ্ছে অন্যতম। এই দেশটির সাথে কোন সমুদ্র-বন্দরের যোগসূত্র নেই। এখানকার জনগণ অর্থনৈতিক লেনদেন কিরগিজ ‘সোম’ এর মাধ্যমে করে থাকে। তাদের মুদ্রার নাম হচ্ছে ‘সোম’। বছরের বেশির ভাগই তাপমাত্রা থাকে বিশ ডিগ্রীর মাঝে। বছরের ছয় মাসই পাহাড়গুলো বরফাচ্ছন্ন থাকে। প্রায়ই আটানব্বই শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশটির মাঝে আরেকটি দারুন ব্যাপার লক্ষ্য করলাম সেটি হচ্ছে তারা বেশির ভাগ সুন্নী মুসলিম এবং তাদের মাযহাব অনুসারে ঘোড়ার গোস্ত ও ঘোড়ার দুধ পানাহারে কোন বাঁধা নেই। বেশির ভাগ মানুষ ইসলামকে অনুসরণ করে তাবলীগ-জামায়েতের সান্নিধ্যে থাকে এবং এখানকার প্রায় মসজিদগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছে তাবলীগ-জামায়েতের আদর্শের ভিত্তিতে।
মধ্যএশিয়ার দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও সম্পূর্ণ আধুনিক ব্যবস্থা আর প্রযুক্তিতে আচ্ছাদিত দেশটি সম্পূর্ণ রাশিয়া ও ইউরোপীয়ানদের জীবনধারাকে অনুসরণে পরিচালিত। দূষণমুক্ত বায়ুর এ দেশটিতে ভ্রমণকালে আমার কাছে মনে হয়েছিল দেশটি যদিও মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত কিন্তু সম্পূর্ণ রাশিয়ার তত্ত্বাবধানে নিয়ন্ত্রিত। এখানে রয়েছে এক উন্নত জীবনযাত্রার মানসম্পন্ন আধুনিকতার ছোঁয়া। কর্মব্যস্ত জীবনযাপনে সময়কে সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করা যেন প্রতিটা মানুষেরই একটি জন্মগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অত্যন্ত সচেতন এবং শুদ্ধ পরিসরে বেড়ে উঠে এখানকার সবগুলো মানুষ। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োঃবৃদ্ধ সবাই যেন ব্যস্ত সময়ের মাঝেই নিজেকে নির্বাচন করতে ভালবাসে। পরনির্ভরশীলতা নয় বরং আত্ম-স্বনির্ভরতাই যেন প্রত্যেক নাগরিকের একনিষ্ঠ লক্ষ্য। কর্মকে প্রাধান্য দেওয়া মানুষগুলো যদিও ব্যস্ততার মাঝে জীবনযাপন করে তবুও প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে রয়েছে আন্তরিকতায় নিবেদিত বিশাল হৃদয়। এখানকার পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে সকলের প্রাত্যহিক জীবনটাই যেন একটি আকস্মিক গোছানো শুদ্ধপরিকর। যানজট আর কোলাহলমুক্ত জীবনধারার এই দেশে অবাক ভাললাগার বিষয় ছিল প্রতিটা স্থানীয় বাড়ির মনোরম পরিবেশ। প্রায় সব বাড়ির মূল ফটকের পাশে, আবার কোথাও সামান্য খালি জায়গা থাকলেই সেখানে যেন অতিথীদের বাহারী রঙ ও সৌরভমন্ডিত সুবাস ছড়িয়ে অভ্যর্থনা জানায় টবে অথবা বেষ্টিত আঙ্গিনায় সাজানো ফুলের বাগান। কম-বেশ সবার বাড়িতেই এমন দৃশ্যটা যেন একটি খুব স্বাভাবিক বিষয়। এজন্য প্রতিটা বাড়ির আঙ্গিনাই বেশ পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি।
পাহাড়-পর্বত-অরন্য-লেক-উপত্যাকায় ঘেরা কিরগিজস্তানে দেখার মতো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যার বেশিরভাগই রাজধানী শহর বিশকেকের আশপাশ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। নানা ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ইতিহাস বহন করে সুনিপুনভাবে গঠিত প্রতিটা দর্শনীয় জায়গার রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তেমনি একটি হল আল আরাচা জাতীয় উদ্যান। চার সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে যাত্রা হলো সাইডসিং আল আরাচা জাতীয় উদ্যানে। এটি কিরগিজস্তানের তিয়ান শান পাহাড়ের একটি আল্পাইন জাতীয় উদ্যান, যা ঊনিশত ছিয়াত্তর সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাজধানী বিশকেক থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। পার্কটি প্রায় দুইশত বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে এবং এর উচ্চতা প্রবেশপথে প্রায় পনেরোশ মিটার থেকে সর্বোচ্চ চার হাজার আটশত পঁচানব্বই মিটার পর্যন্ত তিয়ান শানের কিরগিজ আলা-টু রেঞ্জের সর্বোচ্চ শিখর। পার্কের মধ্যে বিশটিরও বেশি ছোট ও বড় হিমবাহ এবং পঞ্চাশটি পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে। বছরের প্রায় ছয় মাস জুড়ে বরফে ঢাকা থাকে এখানের পর্বতগুলো। চমৎকার ছিল সেখানের আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী। পরিষ্কার নীলাভ আকাশ সেই সাথে স্বচ্ছ পাথরে গড়ানো লেকের স্রোতবাহী হিমেল পানির ধারা এক বিচিত্র্য অনুভূতি এনে দিয়েছিল আমার মনে। সেখানে বেড়ানোর সময় মনে হলো যেন এক বিচিত্র্য সৌন্দর্যের অপূর্বতায় হারিয়ে গেছি এক নতুন জগতে। অসাধারণ ছিল উদ্যানে খেলা করতে আসা স্থানীয় বাচ্চাদের উল্লাসিত দৃশ্য। এখানকার প্রতিটি মানুষই আন্তরিক, ঘুরতে এসে এখানকার স্থানীয় বাচ্চাদের সাথে ক্যামেরাবন্দী হতে পেরে খুবই আনন্দ পেলাম। কখনও পর্বতের চূড়ায়, কখনও উদ্যানের লেকের পাশে, আবার কখনও বা স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন পাথরে বসে এমনকি আবার কখনও কোলাহলমুক্ত পরিচ্ছন্ন পাকা রাস্তায় দাড়িয়ে অনেকগুলো ফটোসেশন করে চলে এলাম এখান থেকে।
আবার বিশকেক শহরের প্রাণকেন্দ্র পৌঁছেই চলে গেলাম শহরের একটি পাবলিক স্কয়ার ভিক্টোরিয়া স্কয়ার দর্শনে। এটি নাৎসি জার্মানির উপর বিজয়ের জন্য নিবেদিত। ঊনিশত পঁয়তাল্লিশ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার চল্লিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে এটি তৈরি করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় এলাকা একটি বিজয় স্মৃতিস্তম্ভে ভরা। এটি একসময় প্রধান বিশকেক মার্কেটের স্থান ছিল। বর্গক্ষেত্রটিতে একটি মহিলার মূর্তি রয়েছে, যা তার স্বামীর যুদ্ধ থেকে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে। চিত্রিত মহিলারা একটি তুরস্কের নিচে লাল গ্রানাইটের তিনটি পাঁজর দ্বারা অনুষ্ঠিত একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পুষ্পস্তবক আকারে একটি তিন্দুকের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। সবমিলিয়ে ঐতিহাসিক এ স্থানটিতে অত্যন্ত আনন্দের সাথে ভ্রমণ শেষে যাত্রা করলাম জাতীয় ইতিহাস জাদুঘরে।
দেশের জাতীয় জাদুঘরটি বিশকেকের প্রধান জাদুঘর হিসেবে পরিচিত। এটি শহরের একেবারে কেন্দ্রের প্রধান চত্বরে অবস্থিত। এটি এক সময় সোভিয়েত আমলে লেনিন জাদুঘর নামে পরিচিত ছিল। জাদুঘরটি বর্তমানে এমন একটি সংগ্রহ হিসেবে রয়েছে যা কিরগিজস্তান কীভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল তার ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসেবে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে। লেনিন এবং কিরগিজিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আসকার আকায়েভকে উৎসর্গ করা প্রদর্শনীও রয়েছে এখানে। জাদুঘরটিতে কিরগিজের লোক সাহিত্য এবং এর পূর্ব সোভিয়েতের ইতিহাসকেও তুলে ধরা হয়েছে। এখানের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল আর্টগ্যালারী যেখানে প্রদর্শিত চিত্রগুলো যেন এ দেশের চিত্রশিল্পের প্রতি এ দেশের মানুষের আগ্রহের জানান দিয়ে যায়। এখানকার জাদুঘরে ফুটে উঠেছে চিত্রকলার ইতিহাস। প্রাগৌতিহাসিক মানুষের থেকে প্রাপ্ত শিল্পকর্ম থেকে শুরু হওয়া এবং সমস্ত সংস্কৃতিকেই পরিব্যপ্ত করে এখানকার প্রদর্শনী। এটি প্রাচীনকাল থেকে অবিরাম চলে আসা ও পর্যায়ক্রমিক বিরতির প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। সংস্কৃতিব্যাপী, বিস্তৃত মহাদেশ ব্যাপী এবং সহস্রাব্দব্যাপী চিত্রকলার এই ইতিহাস সৃজনশীলতার একটি চলমান নদী, যা একবিংশ শতাব্দীতেও অব্যাহত রয়েছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে এটি প্রধানত প্রতিনিধিত্বমূলক, ধর্মীয় এবং ধ্রুপদীয় বিষয় নির্ভর ছিল। জাদুঘরটির উল্লেখযোগ্য আরেকটি দিক রয়েছে, আদিকালের কার্পেট শিল্পের নান্দনিক প্রদর্শনী। যা পাঁচশত বছর পূর্বের কার্পেট সভ্যতাকেও বর্তমান আধুনিক প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। তুর্কি ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির নিদর্শনগুলোর মধ্যে কার্পেট অন্যতম। এর ইতিহাসও অনেক পুরোনো। এক সময়ের দুনিয়া কাঁপানো অটোম্যান সাম্রাজ্যের দেশ তুরস্ক থেকে নান্দনিক ডিজাইনের সব কার্পেট নিয়ে এসব অঞ্চলের ব্যাপক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজারজাত করা হয়। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস আর ঐতিহ্যে গড়া তার একেকটি কার্পেটের গল্প একেকটি ইতিহাস। তারই বহিঃপ্রকাশ এই বিশকেকের জাদুঘর। যা চোখে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। পুরো জাদুঘরটি ঘুরে-ফিরে সেখানকার বিভিন্ন আলোকচিত্র ও প্রদর্শনীর সাথে নিজেকে ক্যামেরাবন্দী করে এখান থেকে প্রস্থান করি সেই সাথে সেদিনকার মতো ঘুরে বেড়ানো শেষ হয়।
পরদিন অর্থাৎ পাঁচ সেপ্টেম্বর সকালে বিশকেক শহরের বেশ কয়েকটি পার্কে পদার্পন করি। বিশকেকের পুরো শহরটিতে অনেকগুলো পার্কই রয়েছে। এজন্য রাজধানী শহরটি বলা যায় পার্কের শহর। মনোরম পরিবেশে অবস্থিত পার্কগুলোর সবগুলোই ছিল অত্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধিত স্থান। নানা রঙের বাহারী ফুলের সমারোহ প্রতিটি পার্কেই রয়েছে বিনোদন উপযোগী বিভিন্ন সরঞ্জাম। ছিল নানা বয়সী প্রকৃতি প্রেমী ও বিনোদনপ্রিয় মানুষদের আনাগোনা। পার্কের নান্দনিক পরিবেশকে স্মৃতিতে সংরক্ষণ রাখতে বিভিন্ন আঙ্গিকে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। একই দিনে বিশেককের মূল আকর্ষণের মধ্যে থাকা বিশাল জাতীয় পতাকা সমেত আলা-টু স্কয়ার, ওশ বাজার, ফ্রাঞ্জ স্ট্যাচু, আর্ট মিউজিয়াম, ক্যাথেড্রাল, মিখাইল-ফ্রাঞ্জ জাদুঘর, কাশকা-স্কি রিসোর্ট, মানার মূর্তি, বিজয় স্কয়ারসহ নানা স্থাপনার সদৃশ পরিচিত হতে পেরে বেশ আনন্দমুখর সময় কাটালাম।
বৈকালিক সময়টা পাড় করি বিশকেকে অবস্থিত সুপাড়া চুনকুরচাক নামক একটি বিখ্যাত রিসোর্টে। এতে রয়েছে কিরগিজ ঐতিহ্যবাহী ভবন, ইয়ার্ট এবং পাথরের ঘর। এখানে প্রতিটি রুমের সদস্যের জন্য বরাদ্দ হিসেবে একটি টিভি, একটি ছাদ এবং একটি গরম টব প্রদান করা হয়। রয়েছে বৈদ্যুতিক কেটলি। ব্যক্তিগত বাথরুমে একটি হেয়ার ড্রায়ার এবং বাথরোব রয়েছে। রুম থেকে খুব সহজে পাহাড়ের দৃশ্য উপভোগে যেন মন জুড়িয়ে যায়। সাথে রয়েছে অতিরিক্ত একটি বসার জায়গা। অতিথিদের অন-সাইট রেস্তোরা পরিদর্শন এবং কিরগিজ খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে সাদরে স্বাগত জানায় এই নান্দনিক রিসোর্টটি। তাছাড়াও অন্যান্য সুবিধার মধ্যে আরোও রয়েছে মিটিং সুবিধা, লাগেজ স্টোরেজ এবং শিশুদের খেলার মাঠ, বলরুম-হলরুম, খাওয়ার জন্য আদি ঐতিহ্যকে সামিল রেখে আধুনিক ব্যবস্থায় গড়া ছোট ছোট ঘর সবমিলে কি নেই সেখানে। স্কিপিং, ঘোড়ায় চড়া এবং মাছ ধরা সহ বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সাইট। অথবা আশেপাশের নান্দনিক সকল মনোরম দৃশ্যকে খুব সহজেই উপভোগ করা যায়। তাই ভ্রমণের পাশাপাশি এখানে রাত্রিযাপনটাও ছিল আমার কাছে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
পাহাড়-পবর্ত আর নয়নাভিরাম উপত্যাকা সব মিলিয়ে নৈসর্গিক এক নান্দনিক সৌন্দর্যের অপার লীলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিরগিজস্তানে। যার বেশির ভাগই রাজধানী শহর বিশকেকের অন্তর্ভূক্ত। শহর এলাকা থেকে আশপাশের জায়গাগুলোর যত্রে-তত্রে যেন চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যকে বুকে নিয়ে প্রকৃতি সেজে আছে আপন মহিমায়। আমার এই ভ্রমণে বিশকেকের প্রায় সবগুলো দর্শনীয় স্থানগুলোতেই চোখ রাখতে সক্ষম হয়েছি এক স্বাচ্ছন্দ্যময় আনন্দের কলতানে। সাত সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল আরোও আকর্ষণীয়, আরোও স্মৃতিময়। দেখেছি স্বাধীনতা স্তম্ভ, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, সংসদ ভবন যা রাজধানীর মূল প্রাণকেন্দ্রেই ছিল। সেই সাথে কিরগিজ জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারির প্রথম সারিতে বসে দর্শক হয়ে সরাসরি উপভোগ করেছি কিরগিজস্তান বনাম বাংলাদেশ জাতীয় যুব ফুটবল দলের সেমিফাইনাল খেলা। পর্বতমালা আর লেক-উপত্যাকার ছড়াছড়ি কিরগিজস্তানে রয়েছে বৃহত্তম লেক ইসিক কুল। নয় সেপ্টেম্বর বিশকেক থেকে প্রায় একশত পঞ্চাশ কি.মি. দূরে রওয়ানা হলাম এই বৃহত্তম লেকটি দেখার উদ্দেশ্যে। কিরগিজস্তানের উত্তরে তিয়েন-শান (স্বর্গের পর্বত) এর উচ্চ পর্বতশ্রেণীতে ষোলশত মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই লেকটিতে দুই দিন অবস্থান করে ঘুরেছি, দেখেছি আর উপভোগ করেছি অকৃত্রিম নজরকাড়া সৌন্দর্যের গহীন স্বাদ। এটি দক্ষিণ আমেরিকার টিটিকাকা হ্রদের পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম উচ্চ পর্বত হ্রদ যা ছয় হাজার দুইশত ছত্রিশ বর্গকিলোমিটার পৃষ্ঠ জুড়ে রয়েছে। হ্রদের পাড়ে আসতে আমাকে অতিক্রম করতে হয়েছে প্রায় অনেকটুকু পথ। হ্রদটির দৈর্ঘ্য একশত আশি কিলোমিটার এবং প্রস্থ ষাট কিলোমিটার। হ্রদের গড় গভীরতা দুইশত সত্তর মিটার। যেহেতু হ্রদের পানিতে লবণের পরিমাণ কম এবং হ্রদের নীচে অসংখ্য উষ্ণ ঝর্ণার কারণে এটি নিম্ন তাপমাত্রা সত্ত্বেও জমে না। কিরগিজ ভাষায় ইসিক-কুল মানে গরম লেক। হ্রদকে এই অঞ্চলের খাবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে নয় বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্রামস্থল হিসাবেও পরিণত করা হয়েছে। ইসিক-কুল হ্রদ ছিল সিল্ক রোডের একটি স্টপওভার, যা সুদূর পূর্ব থেকে ইউরোপের ভ্রমণকারীদের জন্য একটি স্থলপথ। হ্রদটি একসময় চীনের কিং রাজবংশের মালিকানাধীন ছিল এবং তারবাগাতাই চুক্তির পরে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সহ রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। ইসিক-কুল হ্রদের আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যের অসাধারণ বৈচিত্র্য প্রচুর সংখ্যক উদ্ভিদ এবং মৎস্যসহ বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতির জন্য আদর্শ জীবনযাপনের সুযোগ করে দেয়। উষ্ণ জল ও সাদা বালুকাময় সৈকত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় মানের পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ইসিক-কুল লেক দেখার পর আমার যাত্রা এর পাশেই থাকা এঙ্গিলচেক হিমবাহতে। যদিও গ্রীষ্মের কারণে সাধারণত যতটুকু বরফাচ্ছন্ন থাকার কথা সেরকমটা নয়। তবে এর পাদদেশে -৩ তাপমাত্রা অনুভব করেছি। অতিরিক্ত ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাহিরে থাকা সম্ভব না হওয়ায় সাথে থাকা গাড়ীতে উঠেই হিটার ব্যবহার করতে হয়েছে। হিমবাহটির চূড়ায় যাওয়ার সুযোগ না হলেও নিচ থেকে বরফের চাদরে ঢাকা পাহাড়ী হিমবাহের মনোরম দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ভুল করলাম না। এটি উত্তর-পূর্ব কিরগিজস্তানের ইসিক-কুল অঞ্চলের মধ্য তিয়ানশান পর্বতমালার একটি হিমবাহ। এর মূল অবস্থান এঙ্গিলচেক গ্রাম থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পূর্বে। দক্ষিণ এঙ্গিলচেক হিমবাহ বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম হিমবাহ হিসাবে স্থান পেয়েছে এবং এটি কিরগিজস্তানের বৃহত্তম ও দ্রুততম চলমান হিমবাহ। প্রধান হিমবাহের দুটি বাহু হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ এঙ্গিলচেক হিমবাহ। খান টেংরি এবং পিক পোবেডির চীনা-কাজাখ-কিরগিজ গণ থেকে এই হিমবাহের উৎপত্তি এবং হিমবাহের উপরের অংশ এই তিনটি দেশে পড়ে। হিমবাহ থেকে গলিত জল সারিজাজের একটি শাখা অর্থাৎ চীনে আকসু নামে যা পরিচিত এনগিলচেক নদীতে মিলিত হয়, যা চীনের সীমান্ত অতিক্রম করে তারিম অববাহিকায় প্রবেশ করে। এই হিমবাহের জল মৌসুমী হিমবাহ লেক মের্জবাখারেও মিলিত হয় যার ফলে এঙ্গিলচেক নদী উপত্যকায় হিমবাহী হ্রদ অনেক সময় বন্যার সৃষ্টি করে।
হিমবাহের সৌন্দর্য্য উপভোগের পরপরই রওয়ানা করি আমার পরবর্তী ভ্রমণযাত্রা উজবেকিস্তানের উদ্দেশ্যে। কিরগিজস্তানের সবচেয়ে বড় দুইটি শহর জালালাবাদ ও উশ সিটি হয়ে দীর্ঘ ষোল ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় উজবেকিস্তান। তাই একটানা দীর্ঘ আট ঘন্টার পথচলায় ক্লান্তি অনুভবে বিশ্রামের জন্য থামতে হয় জালালাবাদ। সেখানে পেয়ে গেলাম আরেকটি নয়নাভিরাম লেক টোকটোগুল জলাধার, যা ঊনিশত ছিয়াত্তর সালে সোভিয়েত-নির্মিত ন্যারিন নদী জুড়ে বাঁধ দ্বারা গঠিত হয়েছিল। জলাধারটি দীর্ঘ এবং সংকীর্ণ এবং মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম। এটি নেরিয়ণ নদী দ্বারা ভরা দেশের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট জলাধার। এটিতে বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। পাহাড়ে ঘেরা লেকটি বিশাল এবং দৃশ্যগুলি অবিশ্বাস্য। বিশকেক থেকে দক্ষিণে ভ্রমণ করলে থামার জন্য এটি একটি ভাল জায়গা হওয়াতে এখানেই থাকলাম দুই দিন। লেকের আশেপাশের ক্যাফেগুলো গভীর ভাজা তাজা ট্রাউটের জন্য জনপ্রিয়। মনোরম জলাশয়ে সুন্দর, উষ্ণ জল। গ্রামাঞ্চলের মতো নয়নাভিরাম মরুভূমির খুব পরিষ্কার জল এবং আশ্চর্যজনক দৃশ্য মুগ্ধ করেছে আমাকে। জলাশয়ের দক্ষিণ শহর দিয়ে গাড়ী চালানোর সময়, ফিরোজা-সবুজ জলরাশি এবং বেগুনি শিলার স্তর রাস্তা বরাবর যে কাউকে মুগ্ধ করবে যেমনটা আমার নিজের মাঝে অনভূতির প্রতিফলন থেকে বলছি। সম্ভবত অনেকের মতই, উষ্ণ এবং উপকূলীয় পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত হ্রদে ভ্রমণ আমাদের কিরগিজস্তান ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ ছিল।
তারপর পৌঁছে গেলাম উশ সিটিতে। বিশকেক থেকে উশ সিটির দূরত সাতশত বিশ কিমি.। এই শহরের ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো। উজবেকিস্তানে ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কারণে উজবেক-কিরগিজ স্থলবন্দর তিন দিনের জন্য বন্ধ থাকায় উশ সিটিতে আমাদের থামতে হয়েছে। তাই উশ সিটিতে অবস্থিত মুসলিম জাহানের অন্যতম নবী সোলায়মান (আঃ) এর স্মৃতিধন্য সোলায়মান পাহাড়ে ঘুরতে গেলাম। সোলায়মান পর্বত যেখান থেকে ওশ ও এর পরিপার্শ্বের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। এই পাহাড়টি কিছু গবেষক এবং ঐতিহাসিকদের দ্বারা “স্টোন টাওয়ার” নামে পরিচিত এবং প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি প্রাচীন সিল্ক রোডের মধ্যবিন্দু চিহ্নিত করে। অনেক উঁচু এই পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আমার প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছিল। ইসলামের অন্যতম নবী সোলায়মান (আঃ) এই পাহাড়ের চূড়ায় আল্লাহর ধ্যানমগ্ন থাকতেন এবং পর্বতটিতে একটি মাজার রয়েছে যা তার কবর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জনশ্রুতি আছে যেসব নারী পাহাড়ের শীর্ষে উঠে খোলা জায়গায় হামাগুড়ি দেয় তারা সুস্থ শিশু জন্ম দেবে। পর্বতমালার গাছ এবং ঝোপগুলিতে অসংখ্য ছোট ছোট কাপড়ের “প্রার্থনা পতাকা” বেধে দেওয়া হয়েছে। এই স্থানটি এখনও স্থানীয় মুসলমানদের কাছে একটি পবিত্র স্থান। সর্বোচ্চ শিখর পর্যন্ত সিঁড়ি আছে যেখানে পনেরোশত বারো খ্রিস্টাব্দে সম্রাট বাবরের দ্বারা নির্মিত ছোট মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের বেশিরভাগ অংশ বিশ শতকের শেষের দিকে পুনর্গঠন করা হয়েছিল। পাথুরে পাহাড়টিতে এছাড়াও জাতীয় ঐতিহাসিক এবং প্রত্মতাত্ত্বিক জাদুঘর কমপ্লেক্স সুলাইমান অবস্থিত যা সোভিয়েত যুগে নির্মিত হয়েছিল, এই এলাকা এবং এর ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন এখানে সংরক্ষিত আছে। জাতীয় ঐতিহাসিক এবং প্রত্মতাত্ত্বিক জাদুঘর কমপ্লেক্স সুলায়মান পাহাড়ে খোদাই করে তৈরী করা হয়েছে, এটি প্রত্মতাত্ত্বিক সংগ্রহ ধারণকারী, ভূতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক আবিষ্কার এবং স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করে। ঊনিশশত ঊনপঞ্চাশ সালে জাদুঘরটি ওশ আঞ্চলিক জাদুঘর নামে শুরু হয়। ঊনিশত আটাত্তর সালে ওশ শহরের তিন হাজার বছর পালন উপলক্ষ্যে সোভিয়েত যুগে জাদুঘরটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এটি গুহা আকৃতির যার প্রবেশপথে একটি কাঁচে মোড়া কংক্রিটের তোরণও রয়েছে। সোলায়মান পাহাড় পরিদর্শন দেশে যাত্রা করি কারাসু সিটিতে, যেখানে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া প্রাকৃতিক পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানি দেখে। এক অবিশ^াস্য দৃশ্য ছিল এটি। অকৃত্রিমভাবে বাষ্পীভূত হওয়া পানিগুলো সম্পূর্ণ আমাদের দেশের গ্যাস মিশ্রিত বোতলজাত পানীয়গুলোর মতোই। যা অনেকটা কোক, স্প্রাইট সম্পূর্ণ অকৃত্রিম আর ঝাঁঝালো। এই পানিগুলো ছিল প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত মিঠা পানি, কিন্তু গ্যাসযুক্ত বা ঝাঁঝালো। দেখে মনে যেন প্রকৃতি আপন হাতে তুলে দিচ্ছে সুপেয় বিশুদ্ধ পানীয়। এখান থেকে এবার আমার যাত্রা হলো ইব্রাহীম ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে। সেখানকার দৃশ্যাবলী ছিল বলাবাহুল্য। নিরিবিলি পরিবেশ, গ্রাম্য মেঠোপথ আর পাহাড়-পর্বতারণ্য গ্রামটি ছিল অত্যন্ত চমৎকার। গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। এখানকার প্রত্যেকটি কৃষকই যেন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী এবং আত্মনির্ভরশীল। প্রতিটা কৃষকের বাড়িতে রয়েছে ঘোড়ার খামার, গরুর খামার ও ভেড়ার খামার। অসংখ্য ঘোড়া-গরু আর ভেড়ার পাল নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে চড়িয়ে সন্ধ্যায় নীড়ে আসা যেন প্রাত্যহিক রুটিন। আপেল, আঙুর ও চেরী ফলচাষই এখানকার প্রধান কৃষিজাত পণ্য। অত্যন্ত সুমিষ্টভাষী ও অতিথীপরায়ণ মানুষগুলো আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানায় আন্তরিকভাবে।
সবমিলিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজ ভ্রমণ আমার সর্বজীবনে স্মৃতিবন্ধনে অটুট হয়ে থাকবে। আয়তনে বাংলাদেশের দ্বিগুণ হলেও দেশটির জনসংখ্যা মাত্র নব্বই লাখ। পাহাড় পবর্তে ঘেরা দেশটিতে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্যের বহু উপমা। খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ দেশটিতে রয়েছে সোনার খনি, যদিও তা কানাডা সরকারের নিকট দায়বদ্ধ। এদেশের মানুষগুলো সত্যিই ছিল কোমল প্রকৃতির। অতিথিদের আপ্যায়ণে তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সিরামিক শিল্পের পাত্রে পরিবেশনকৃত চা। চা-ই যেন অতিথিদের মনোসন্তুষ্টির শিরোনাম এই চমৎকার দেশটির মানুষগুলোর কাছে। তিন বেলাতেই যখন খাবার পরিবেশন করা হয় সেই সাথে থাকে ‘চা’। চায়ের পেয়ালা খালি হতে না হতেই এখানকার হোস্ট আবারও ভর্তি করে দেয়। এটাই এখানকার ঐতিহ্য। সেই সাথে সংযুক্ত হয় খাবার শেষে ত্রিশ সেকেন্ডের সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা। তাদের খাবারের প্রধান তালিকা জুড়ে রয়েছে ঘোড়ার মাংস, ঘোড়ার দুধ, শিপ, দুম্বা, গরু ও খাসির মাংস, মধু, বিভিন্ন জাতের ফলমূল, কাঁচা বাহারী তাজা সালাদ, বিভিন্ন প্রকারের আচার ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময়ই সিদ্ধ মসলাযুক্ত মাংসকে তারা নিত্যদিনের মূল খাবার হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। অতিথি বাড়িতে আগমণের সাথে সাথে সংস্কৃতি রীতিতে বাড়ির প্রধান নিজ হাতে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানায় ঘরের বাহিরে হাত ধোয়ার মধ্য দিয়ে। এমনকি বিদায় জানাতেও অবলম্বন করা হয় একই পদ্ধতি।
পরিশেষে বলতে পারি, মধ্যএশিয়ার অন্যতম মুসলিম দেশ হিসেবে কিরগিজস্তান একটি চমৎকার দেশ। এখানে ভ্রমণ করতে এসে জীবনে পেয়েছি এক অকৃত্রিম স্বাদ যা স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে আজীবন। এই ভ্রমণ শেষে আমার বোধগম্য হয়েছে দেশটির পর্যটন ব্যবস্থা অপার ও অসীম যা এখানে এসে স্বচক্ষে না দেখলে অবগত হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। সবমিলিয়ে সুন্দর এই দেশ ও তার মানুষজন। তাই আমার এ ভ্রমণে উৎসাহ দানকারী ও সার্বিক সহায়তা প্রদানে ভূমিকা পালনকারী এবং ভ্রমণপ্রেমী পাঠকবৃন্দ সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই সাথে সকলের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে বিদায় নিলাম আজকের ভ্রমণ পর্বের বিশ্লেষণ থেকে। আমার বিশ^াস, বাংলাদেশের ভ্রমণবিলাসী মানুষজন পরবর্তীতে ভ্রমণের জন্য রাশিয়া থেকে স্বাধীনতা অর্জনকারী এই পাঁচটি দেশকে তাদের ভ্রমণ তালিকার শিখরেই রাখবে। আমি ভূ-স্বর্গ কাশ্মিরেও ভ্রমণ করেছি। ব্যক্তিগতভাবে এই দেশগুলোকে নিয়ে আমার অভিমত, এসব দেশগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ের ভ্যালী, উপত্যাকা, বরফের স্নিগ্ধতা, মানুষদের আতিথেয়তা-আন্তরিকতা-সৌন্দর্য্য যেন কা