আনিস আলমগীর ||
ফেব্রুয়ারি
আসলে আমাদের ভাষাপ্রেম জেগে ওঠে। তখন সবাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগের
জন্য গলা উঁচু করে চিৎকার করি। ইংরেজি মিডিয়াম শিাকে হালকা-পাতলা গালাগাল
করি। অভিযোগ করি উচ্চ আদালতে বাংলায় ব্যবহার হচ্ছে না, সাইনবোর্ড বাংলায়
লিখছে না, সরকারি নথিপত্র কেন সব বাংলায় লেখা হয় না? কিন্তু বাংলা ভাষার
মূল সমস্যা কোথায়, তার সমাধান কী- সেটা নিয়ে কেউ কথাই বলি না।
মূল কাজটি হচ্ছে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত পরিম-ল থেকে বের করে যুগপোযোগী করা।
বাংলার
জন্য আহাদ না দেখিয়ে যেখানে যখন যে ভাষা দরকার সেটা ব্যবহার করা এবং ভাষায়
পারদর্শী হওয়া। সে জন্য সবার আগে দরকার ভাষাটি ঠিকমতো শেখা। আমাদের জন্য
শুরুতেই দরকার বাংলা এবং ইংরেজি ভাষাশিা। যারা আররি লাইনে পড়াশোনা করবে
তারা এই দুই ভাষার সঙ্গে আররি ভাষাতেও দ হওয়া। এর বাইরে প্রাথমিক স্তরে
অন্য ভাষা শেখার দরকার আছে মনে করি না। তবে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী বা অঞ্চলের
লোকেরা যদি তাদের ভাষার লিখিত রূপ থাকে সেটা শিখতে পারে, কিন্তু জরুরি না।
বাংলা,
ইংরেজি এবং গণিত- এই তিন বিষয়ের গাঁথুনি জোরালো করার পর শিার্থীর হাতে
বিজ্ঞান এবং অন্যান্য সাবজেক্ট তুলে দিতে হবে। আমরা সেটা করছি না। একসঙ্গে
সব গেলাতে চাচ্ছি। ইংরেজি শেখানোর মতো আমাদের শিক নেই প্রাথমিক স্তরেই। ফলে
সেখানে যে দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে সারাজীবন তার পরিণাম বহন করতে হচ্ছে। আবার
একটু বড় হলে ইংরেজি বিষয়ে বোর্ডের যেসব বই হাতে তুলে দিচ্ছি সেটা ভাষা শিার
জন্য আধুনিক না। আমি এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না। ইংরেজি মিডিয়ামের
প্রাথমিক স্তরে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ প্রণীত ভাষাশিার বইগুলোতে চোখ
বুলালে প্রমাণ পাওয়া যাবে, যার প্রধান উদ্দেশ্য ইংরেজি ভাষা শেখানো।
আমরা
কি করছি? আমরা বাংলা শেখানোর নামে যা পড়াচ্ছি সেটা শিশু তার বয়স অনুসারে
নিতে পারছে কিনা বিবেচনা করছি না। একশ্রেণির বইয়ের সঙ্গে পরবর্তী শ্রেণির
বইয়ের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। সে কারণে আমি মনেকরি বাংলাদেশের শিাব্যবস্থায়
সবচেয়ে অবহেলিত যে সাবজেক্টটি আছে সেটি হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। এই
বাংলা পড়ে শিার্থীরা না শিখতে পারছে বাংলা ভাষা, না পাচ্ছে বাংলা সাহিত্য
সম্ভারের স্বাদ। উদাহরণ হিসেবে বলি- ‘ভাব ও কাজ’ নামে কাজী নজরুল ইসলাম
একটি প্রবন্ধকে সংপ্তি করে বাংলাদেশ শিা বোর্ডের অষ্টম শ্রেণির বাংলা বইতে
স্থান দেয়া হয়েছে। যদি অষ্টম শ্রেণির শিার্থীদের জন্য এটি জরুরি হয়, যদি
সংপ্তিই করি, তাহলে সাধু ভাষায় কেন? চলিত এবং সহজ করে লিখতে সমস্য কি- যেটা
অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ তাদের কাসিক সাহিত্যের েেত্র করছে।
শুধু এটি
নয়, বাংলা বইয়ের অধিকাংশ গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ সাধু ভাষায় এবং অপ্রচলিত শব্দে
ভরা। সাধু ভাষার সঙ্গে শিার্থীদের পরিচিত করানোর অর্থ তো এই নয় যে
অপ্রচলিত একটি ভাষাকে শিায় প্রাধান্য দিতে হবে। সাধু ভাষাকে তো জাদুঘরে
পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বহু বছর আগে। তাহলে শিশুদের এই ‘প্যারা’ দেয়া কেন!
বাংলা
দ্বিতীয়পত্র নামে যা আছে সেটি হচ্ছে রীতিমতো অত্যাচার। ভাষাশিার নামে এরা
শিার্থীকে রীতিমতো বাংলা ভাষা বিদ্বেষী করে তুলছে। বিশ্বাস না হলে
বাচ্চাদের বই দেখেন। আমার সন্তানের স্কুলে কাস এইটের বাংলা সেকেন্ড পেপারের
জন্য স্কুল কর্তৃপ যে দুটি বই নির্ধারণ করেছে তার একটি ১২০০ এবং অন্যটি
৯২২ পৃষ্ঠার। একটি লিখেছেন জনৈক মাহবুবুল আলম অন্যটি লিখেছেন ড. আবুল কালাম
মনজুর মোরশেদ। অনুমান করতে পারবেন না ভাষাশিার নামে কতটা নি¤œমানের,
অবৈজ্ঞানিক বইপত্র এসব। স্কুল কর্তৃপরে সঙ্গে এসব বইয়ের লেখক-প্রকাশকরা
মিলে সিন্ডিকেট করে বই-বাণিজ্য করছে আর অভিভাবকদের বাধ্য করছে এসব
‘আবর্জনা’ কেনার জন্য।
বাংলা ব্যাকরণ নামে আমরা আসলে কী শিখাচ্ছি? সেটা
কি আমাদের বাংলা ভাষা শেখার েেত্র সহায়তা করতে পারছে নাকি বাংলা ভাষাকে
জটিল করে দিচ্ছে? আমার মতে জটিল করে দিচ্ছে। বাংলা ব্যাকরণ নামে আমরা যেসব
বই পড়ছি সেসব বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ করছে না, করছে সংস্কৃত ভাষার বিশ্লেষণ।
শেখাচ্ছে সংস্কৃতের নিয়মকানুন। এগুলোকে আবর্জনা হিসেবে ফেলে বাংলা ব্যাকরণ
বই বোর্ড কর্তৃপ নিজেদের দায়িত্বে রাখতে হবে।
উচ্চশিায় আমরা মাধ্যম কী
রাখব? বাংলার প্রেমিকরা বলবেন মাধ্যম বাংলা হতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে
ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের গড়ে
ভালো ছাত্র বলি আমরা, আর যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তাদের গড়ে
তুলনামূলক দুর্বল ছাত্র বিবেচনা করি আমরা। কিন্তু পাবলিকে পড়ছে বাংলায়,
যদিও অধিকাংশ পাঠ্যবই ইংরেজিতে লেখা আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিার্থীরা
পড়ছে পুরোটাই ইংরেজি মাধ্যমে। তাহলে কী হলো বিষয়টা? দুর্বলদের ইংরেজিতে
পড়তে বাধ্য করছি আর সবলদের বাংলায় পড়তে বাধ্য করছি।
অথচ গ্লোবালাইজেশনের
এই যুগে উচ্চশিায় আমাদের প্রত্যেকের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া দরকার। কারণ
প্রতিযোগিতার বাজারে কে কোন দেশে পড়েছে সেটা আর বিষয় নেই। জব মার্কেটে সে-ও
পণ্য, আমেরিকা-কানাডা-ইংল্যান্ড থেকে পাস করা গ্রাজুয়েটও পণ্য। ব্যবসা বা
গবেষণা সেক্টরেও একে অন্যের প্রতিযোগী। তাহলে উচ্চশিার মাধ্যম আন্তর্জাতিক
ভাষা হবে না কেন! আমার দেশের গ্রাজুয়েট যদি আন্তর্জাতিক মানের না হয় তাহলে
এত গ্রাজুয়েট দরকার কেন? শিার নামে সার্টিফিকেট বিক্রি এবং বেকার তৈরি করার
জন্য? অশিতি বেকারের চেয়ে তথাকথিত শিতি বেকার সরকারের জন্য উপদ্রব- সেটা
ভুলে গেলে চলবে না। উচ্চশিা সবার জন্য জরুরি না।
এবার আসি বাংলা ভাষার
গার্ডিয়ান বাংলা একাডেমি প্রসঙ্গে। বাংলা একাডেমি তাদের ব্যাকরণে ণ-ত্ব
বিধান, ষ-ত্ব বিধান বাদ দিয়েছে। কিন্তু ভাষা থেকে ‘ণ’ এবং ‘ষ’ বাদ দেয়নি।
তাহলে হলো কি! আমি বহুদিন থেকে বলে আসছি বাংলা বর্ণমালা থেকে ঞ, ঈ (কার), ঊ
(কার), ণ, ষ এবং ঢ় বাদ দেয়ার জন্য। এগুলোর ধ্বনি বাংলা ভাষায় আমরা ব্যবহার
করি না। উচ্চারণ হয় না। তাই এসব বাদ দিলে বাংলা জানা এবং শুদ্ধভাবে লেখা
অনেক সহজ হয়ে যাবে। বাংলা বানান আর উচ্চারণ নিয়ে বিভ্রান্ত জাতি এবং
আতঙ্কিত নতুন প্রজন্মের জন্য এটা হবে যুগান্তকারি কাজ। বৈপ্লবিক পরিবর্তন
না করলে এখন যে যার মতো, এক পত্রিকা একরকম বানান রীতিতে যে বাংলা শিখাচ্ছে-
সেটা বন্ধ হবে না। পরিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষা শেখার যন্ত্রণাটা কমবে,
ভাষাটা বিজ্ঞান সম্মত হবে।
বানানরীতি নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। বলছি কী
লিখছি কী! সংস্কৃত উচ্চারণ অনুকরণ করে লিখছি স্বাস্থ্য, স্বাধীনতা- আর
উচ্চারণ করছি শাস্থ এবং শাধিনতা। এগুলো ঠিক করতে হবে। শব্দের শুরুতে য-ফলা
(যেমন- ব্যবহার) আর ব-ফলা (যেমন- স্বর) কেন রাখব? এর কোনো উচ্চারণ আছে?
তৎসম শব্দ (যেমন- সূর্য-চন্দ্র) উচ্চারণ নিয়ে যত গোলমাল। খাঁটি বাংলা শব্দ
(সুরুজ-চাঁদ) উচ্চারণ নিয়েতো সমস্যা নেই।
ইদানীং কলকাতার উচ্চারণ আমদানি
করা হচ্ছে। ‘ইতিমধ্যে’কে উচ্চারণ করছি ‘ইতোমধ্যে’, ‘উদ্যোগ’কে বলছি
‘উদযোগ’। তাহলে ‘উদ্যান’কে কি ‘উদযান’ বলব? অতিমাত্রায় প্রমিত উচ্চারণের
দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করার সঙ্গে কলকাতার উচ্চারণে ধম্মো, কম্মো,
গপ্পো- বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলা একাডেমির উচিত শিগগির এই নিয়ে
যারা কাজ করছেন তাদের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল বানিয়ে কাজ শুরু করা। খেয়াল
হলো ‘ঈদ’কে ইদ বানানো, ফেব্রুয়ারি এলে বইমেলা আর মুখচেনা লোকদের বাঙলা
একাডেমি পুরস্কার দেয়া একাডেমির একমাত্র কাজ হতে পারে না। বাংলা ভাষাকে
সর্বস্তরে, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে, যুগোপযোগী করাই এর প্রধান দায়িত্ব হওয়া
উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।