কুমিল্লা
মহিলা কলেজ ৪৫ বছর আগে সরকারীকরণ হয়েছিল। এ ধারাবাহিকতায় আজ কলেজটি একটি
মহীরূহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের অহংকার ও গৌরবের ঠিকানা কুমিল্লা মহিলা
কলেজ। বেসরকারী কলেজে যাঁরা শিক্ষক ছিলাম, যাঁরা এখনও বেঁচে আছি, দায়িত্ব ও
আনন্দ নিয়ে বলতে চাই- আমরা এক পরিবারভুক্ত স্বজন-বান্ধব-আত্মীয় ছিলাম ও
আছি। বাংলা বিভাগের রাজিয়া সুলতানা ও আমি বেঁচে আছি, আয়েশা বেগম ও
উদ্ভিদবিদ্যার রাশিদা তাহির, গণিতের মো. শাহাবুদ্দিন, পদার্থবিদ্যার
হারুনুর রশীদ, শুনেছি রসায়নের হিরণ¥য় আচার্য্য আমেরিকায়, আমাদের গুরুজন
অধ্যক্ষ হোসনে আরা খান আমেরিকায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এফ.জামান, তাহসিন আরা
এবং শামসুন নাহার আমেরিকায়। অন্যদের খবর জানি না। হয়তো কেউ বেঁচে আছে বা
নেই। ভাগ্যক্রমে কালের সাক্ষী হয়ে এখনও বেঁচে আছি।
কুমিল্লা মহিলা কলেজে
আমার অধ্যক্ষ ছিলেন বেসরকারী পর্যায়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোসলেহ উদ্দিন
আহমেদ। সরকারী হওয়ার পর একমাত্র উপাধ্যক্ষ হোসনে আরা খান সহকারী অধ্যাপক
হিসেবে আত্তীকৃত হওয়ায় তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমরা প্রভাষক হিসেবে আত্তীকৃত হই। প্রায় ছয়মাস পর রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ
থেকে উপাধ্যক্ষ পদে মো. শামসুল হক যোগদান করেন এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
হলেন। তিনি দীর্ঘদিন ভিক্টোরিয়া কলেজের আরবি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৮০
সালের শেষের দিকে (সম্ভবত) অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন প্রফেসর যোবায়দা
মির্জা। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স। উল্লেখ্য, তাঁর পিতা ছিলেন
স্বনামখ্যাত ড. কাজী মোতাহের হোসেন। অধ্যক্ষ মহোদয়া তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা।
বদলীজনিত কারণে আমি তাঁর কাছে থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ১৯৮১ সালের এপ্রিলের প্রথম
সপ্তাহে ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করি।
বেসরকারি
কুমিল্লা মহিলা কলেজটি ছিল একটি পরিবার। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। ১৯৭৭
সালে কোনো এক সময় আমার ছোটবোনের বিয়ে। বিয়ে অনুষ্ঠান আমার দিগাম্বরীতলা
ভাড়া বাসায় অনুষ্ঠিত হবে। আমার বোন মহিলা কলেজের ছাত্রী। এই বিয়েতে কলেজের
অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ-শিক্ষক ও অন্যান্যসহ ৩০/৩২ জনকে নিমন্ত্রণ করি। তাঁরা
বিয়ের দিন রাত ৮টা নাগাদ সকলে এসে উপস্থিত হলেন। বিয়ের লগ্ন রাত ২টার দিকে
তার আগে খাওয়া-দাওয়া। আমার কলেজের সকলে খাওয়া-দাওয়ার পর বিয়ে অনুষ্ঠানের
শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকে সকালবেলায় আমার বোনকে বিদায় দিয়ে নিজেদের বাসায়
গিয়েছিলেন। আজও এই আন্তরিকতাপূর্ণ ঘটনা আমাকে, আমার পরিবারকে এতটাই
মুগ্ধতায় আপ্লুত করে রেখেছে, তা যেন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করা যাবে না। এ
প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা।
১৯৭৫ সালে আমার হাতে ২০০০.০০ (দু’হাজার) টাকা
জমা হয়। টাকার পরিমাণটা আমার কাছে বিশাল ছিল এবং তা খরচ না করলেও চলে। তাই
প্রথমবারের মতো বৈষয়িক বুদ্ধি সচেতনায় রূপালী ব্যাংকে তিন বছরের জন্য
স্থায়ী আমানত অর্থাৎ ফিকস্ট ডিপোজিট হিসেবে জমা দেই। তিন বছর পর সুদ আসলে
৩০০০.০০ (তিনহাজার) টাকা পাব। ইত্যাদি। ১৯৭৭ সালে আমার ছোটবোনের বিয়ে ঠিক
হয়, তখন অনেক টাকার প্রয়োজন। বোন আমার বাসায় থাকে, বিয়ে এখান থেকেই সম্পন্ন
হবে। বাবা জমি বিক্রি করে দশহাজার টাকা হাতে তুলে দেন। আমি টাকার জন্য
হন্যে হয়ে ঘুরছি। তখনই রূপালী ব্যাংকের জমানো টাকার কথা মনে পড়ে এবং তা
উত্তোলনের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হই। ঐ ব্যাংকে চাকরি করতো আমার ছাত্রী স্বপ্না
দেব। সে পরামর্শ দিল যে, আমি ইচ্ছে করলে এ স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ৮০% লোন
নিতে পারি এবং সুদ পরিশোধ করতে হবে একটু বেশি টাকায়। এদিকে আমার মানাতের
বয়স দু’বছর হয়ে গেছে। ছাত্রীর পরামর্শে আমানতের বিপরীতে ১৮০০.০০ (আটারোশত)
টাকা লোন নেই। পরবর্তী ঘটনা হলো- আমি আর লোনের টাকা জমা দিতে পারছি না।
ব্যাংক থেকে বার বার আমাকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। ১৮০০.০০ টাকা এখনই লোন হিসেবে
২৭০০.০০ টাকা গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আমার আমানতের মেয়াদ শেষ হতে তিন মাস
বাকি। আমি সিদ্ধান্ত নেই আর ব্যাংকের ধারে কাছে যাবো না, আমানতের টাকা
দিয়ে ব্যাংক তা নিজেই পরিশোধ করে নিক। এ বিষয়টি নিয়ে একদিন কলেজের শিক্ষক
মিলনায়তনে আমার সহকর্মীর রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কাছে
গল্পকারে বর্ণনা দিতে থাকি। অনেকটা সহজ ভাষায় রসিকতার আদলে। তিনি সব শুনে
বললেন, ‘ভৌমিক, যদি কিছু মনে না করেন, আমার কাছে বাড়ি থেকে জমি-পত্তনের বেশ
কিছু টাকা এসেছে, আপনি ২৭০০.০০ টাকা পরিশোধ করে দেন। তিনমাস পর আপনার
স্থায়ী আমনত যখন মেয়াদোত্তীর্ণ হবে, তখন আমার টাকাটা দিবেন, আপনারও ৩০০.০০
টাকা হাতে আসবে।’ এ কথা শুনে আমি শিহরিত ও অবাক হলাম। সহকর্মী অধ্যাপক
নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া স্বপ্রণোদিত হয়ে উপকারীর হাত প্রসারিত করে দিয়ে আমাকে
বা ব্যাংকের কাছে আমার মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখার যে উদ্যোগ নিলেন তার দায় এ
জীবনে শেষ করা কী সম্ভব? শেষ পর্যন্ত তা-ই করা হলো। আজ আমার এই মহৎপ্রাণ
সহকর্মীটি বেঁচে নেই। ঢাকা জেলার আড়াইহাজার সরকারি কলেজে উপাধ্যক্ষ হয়ে
গিয়েছিলেন, তারপর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সঙ্গে কঠিন সংগ্রাম করে ইহলোক ত্যাগ
করেন। অনুভব করছি তিনি শুধু সহকর্মীই ছিলেন না, ছিলেন বান্ধব।
অধ্যাপক
নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছিলেন রসিক ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন। একবার কলেজে
শিক্ষক পরিষদের মিটিং। অন্যান্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে একটি ছিল ম্যাডামদের
প্রসূতিকালীন ছুটির দিন নির্ধারণ। আগে তা ছিল ছয় সপ্তাহ। তাঁদের দাবি
দু’মাস। এ সিদ্ধান্ত শিক্ষক পরিষদ নিলেই চলবে- অধ্যক্ষ মহোদয়ের যুক্তি
হলো-এতদিন ছুটি দেয়া যাবে না। যদি কোনো ম্যাডাম তাঁর পরিবর্তে খণ্ডকালীন
কাউকে নিয়োগ দেন, তাহলেই ছুটি নিতে পারবেন।
প্রসূতিকালীন এতদিনের ছুটি
অথচ পুরুষদের জন্য কোনো সুযোগ নেই। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া-অধ্যাপক মো:
লোকমান ও আমি পাশাপাশি বসে আছি এবং আলোচনাটি উপভোগ করছি। ম্যাডামগণ যে
বিষয়ে ছুটি চাচ্ছেন তা বলতেও লজ্জাবোধ করছেন। অধ্যাপক মো: লোকমান
মোটাবুদ্ধির সরলপ্রকৃতির বিধায় নূরুল ইসলাম সাব তাঁকে কানে কানে বললেন-
‘লোকমান সাব, আপনি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমাদেরকেও মেটারনিটি ছুটি দিতে হবে।’
লোকমান সাব কোনো বিবেচনা না করেই দাঁড়িয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে সম্বোধন করে
বললেন, ‘স্যার, ম্যাডামদেরকে মেটারনিটি ছুটি দিলে আমাদেরকেও দিতে হবে।’
অধ্যক্ষ মহোদয় অবাক। তিনি বিস্ফরিত চোখে লোকমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আপনি কী বলছেন তা ভেবে দেখেছেন কি?’ ম্যাডামগণ হাসতে হাসতে গলে পড়ছেন,
অধ্যাপক মো: ওয়াজুদ্দিন বলেছেন, ‘লোকমান সাহেবের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
লোকমান সাহেব আমাকে বলছেন, ‘ভৌমিক, আমি কি কোনো ভুল বলেছি?’ নূরুল ইসলাম
সাহেব হাসছেন। বললাম, ‘আপনি বসুন, আর কোনো কথা বলবেন না।’ লোকমান সাহেব
বললেন- ‘নূরুল ইসলাম সাব যে শিখিয়ে দিল।’
এইছিল আমাদের কলেজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক। এরূপ কত ঘটনা মনে পড়ছে। এজন্যই কুমিল্লা মহিলা কলেজকে বলেছি- ‘আপন ভুবন’।
সংক্ষেপে
বলছি, মহিলা কলেজে অনার্স কোর্স চালু হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধীনে। অনার্স পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা নিতে আসতেন ড.আনিসুজ্জামান, ড.
আবু হেনা মোস্তাফা কামাল, ড. দিলওয়ার হোসেন, ড. শামসুল আলম, ড. ময়ূখ
চৌধুরী, ড. শ্রিপা রক্ষিত প্রমুখ। তাঁদের সান্নিধ্য ছিল আমাদের জন্য বাড়তি
অনেক কিছ্।ু এখন সবই স্মৃতি। মনে হয়, ‘কে বলে গো নেই আমি?’
কুমিল্লা
মহিলা কলেজের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের মানসিকতার কথাও
উল্লেখ করতে হয়। আমি যখন কলেজে যোগদান করি, একমাত্র অধ্যাপক হিরন্ময় আচার্য
ছিলেন হিন্দু শিক্ষক। তিনি অবিবাহিত ও বহির্মুখী আত্মভোলো প্রকৃতির।
কলেজের ক্লাস শেষ করে বের হয়ে যেতেন। অন্য কোনো দায়িত্ব পালনে আগ্রহী ছিলেন
না। কলেজের সরস্বতী পূজা হচ্ছে, তিনি থাকবেন না জেনই রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বিভাগের প্রধান অধ্যপক মো: ইদ্রিস পূজা কমিটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপকের
দায়িত্ব পালন করতেন। পরে আমার উপর এ দায়িত্ব বর্তানো হয়।
কলেজের শিক্ষক
পরিষদের নির্বাচন হতো না। অধ্যক্ষ মহোদয় সকলের সঙ্গে বিশেষত জ্যেষ্ঠদের
সঙ্গে আলোচনা করে সম্পাদক ও সহ সম্পাদক মনোনীত করে দিতেন। আজ ভাবতে গিয়ে
অবাক হচ্ছি। আমাকে যখন শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মনোনীত করা হয়, তখন
ম্যাডামগণ তো বলেননি যে, কলেজটি যেহেতু মহিলা কলেজ, মহিলা শিক্ষকই সম্পাদক
হবে, তাঁরা সংখ্যাধিক্যও ছিলেন। এমন কি শিক্ষকদের মধ্যে হিরন্ময় আচার্য ও
আমি হিন্দু শিক্ষক, আর সকলে মুসলমান শিক্ষক হওয়া সত্বেও আমাকে সম্পাদকের
দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে কেউ আপত্তি করেননি। কতটা উদার পরিবেশে কুমিল্লা
মহিলা কলেজে অভাব-অনটনের মধ্যেও আনন্দে ও নির্মল পরিবেশে একই পরিবারভুক্ত
হয়ে ছিলাম। ভিক্টোরিয়া কলেজের এসে সে পরিবেশ পাইনি। ভিক্টোরিয়া কলেজে
শিক্ষক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ভোটাভুটির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এখনও কলেজের জীবিত সহকর্মী এবং সেসময়কার ছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হলে নিজেকে অতীতের কাছে হারিয়ে যাই।
ডা.
শওকত জাহান এলি যখন স্মৃতিকথায় লিখে- ‘শুধু অঙ্ক, ফিজিক্স আর বিজ্ঞানের
বিষয়গুলোই নয়, সাহিত্যে অসাধারণ দখল না থাকলে ভাল করা যায় না, আব্বা
জানতেন। আর তাই হয়তো স্কুলে থাকাকালীন পণ্ডিত স্যার আর কলেজে পড়ার সময়
শান্তিরঞ্জন স্যারের কাছে বাংলা পড়ার সুযোগ হয়।....
তাঁদের অফুরন্ত স্নেহ-ভালোবাসা ও আন্তরিকতাপূর্ণ শিক্ষা আমার সমৃদ্ধ করে চলেছে আজও।’
আমি
কুমিল্লা মহিলা কলেজে ১০ বছর শিক্ষকতা করেছি। ১৯৭২ খ্রি. ১৫ই ডিসেম্বর
থেকে ১৯৮১ খ্রি. ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। সরকারী হওয়ার বদৌলতে ভিক্টোরিয়া কলেজে
বদলী হয়ে চলে যাই এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে ১৬ বছর দু’পর্বে চাকরী করি।
কুমিল্লার দু’কলেজে ২৬ বছর চাকরী করায় আমার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অগণিত। আজও
রাস্তায় যখন বের হই, প্রতিদিন আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা
হয়। আমি এতটাই ভাগ্যবান যে, আমার আদর্শিক ছাত্র-ছাত্রী আমাকে নিঃসঙ্গ হতে
দেয় না। এ প্রাপ্তি অপার-অনন্য। শুধু মনের বীণায় বেজে উঠে, যখন পড়বে না
মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে!
কুমিল্লা
মহিলা কলেজ আমার জীবনের এক সোনালী সময়ের ঠিকানা। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার
আত্মিক ও হৃদয়ের সম্পর্ক। কলেজটির সার্বিক উন্নতি কামনা করি।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫