চাঁদে অবতরণ বলতে আমরা চাঁদের বুকে কোনো মহাকাশযানের আগমন বা অবতরণ
বুঝে
থাকি। এই মহাকাশযান মনুষ্যবাহী কিংবা মনুষ্যবিহীন---উভয়ই হতে পারে। এই যে
কথা কয়েক বললাম, তাতেই বুঝা যাচ্ছে পৃথিবী নামক নীল গ্রহটি সভ্যতার কোন
পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর বয়স চারশো কোটি বছর আর আধুনিক মানুষের
উৎপত্তি মাত্র চল্লিশ হাজার বছর আগে। শুরুতে প্রাচীন মানুষেরা চাঁদের দিকে
তাকিয়ে চাঁদকে তাদের দেবতার চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারেনি।
ধীরে
ধীরে আধুনিক মানুষ প্রতিকূল পৃথিবীতে টিকে থাকার পাশাপাশি প্রকৃতির
সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে শিখলো। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো অনুভব করলো। ধ্বনি,
বর্ণ, শব্দ ও বাক্যে বিবর্তনের পাল উড়িয়ে পৌঁছে গেলো তারা সাহিত্যের
দ্বারপ্রান্তে। কালের স্রোতধারায় কবি চিত্রকল্পে চাঁদের বুকে চরকা বুড়ি
খুঁজে পেলেন কিংবা দেখতে পেলেন চাঁদের গায়ের কলঙ্ক। পৃথিবীর ভূমিতে দাঁড়িয়ে
কোনো এক মা তার খোকাকে ঘুম পাড়ান ঠিক এইভাবে,
"আয় আয় চাঁদ মামা
টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।"
আকাশের ঐ চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। তাকে ঘিরে পৃথিবী পৃষ্ঠে কত না মায়াবি কাব্য রচিত হয়ে চলেছে।
বলুনতো,
দূরের ওই চাঁদ মানবজাতির রোমাঞ্চের অনেকটা জায়গা দখল করতে পারলো কিভাবে?
কেবল লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে বলেই কি চাঁদের এতো উপচে পড়া রূপ
পৃথিবীর মানুষ উপলব্ধি করে? ঘটনা কিন্তু তাই! সৌন্দর্য যত দূরে, তার মোহনীয়তা-কমনীয়তা ততটাই নিকটে।
সেই
অজেয়-অকল্পনীয় চাঁদে মানুষ তার পদচিহ্ন রাখতে সমর্থ হলো। আশ্চর্য!
প্রাচীন মানুষ ভাবতে পেরেছিল কি একদিন তাদের স্বজাতিরা চাঁদে বসবাসের
সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করবে? কিন্তু এখন মানুষ জানে কবি যাকে চাঁদের কলঙ্ক
বলেছিলেন তা আসলে চাঁদের এবড়োখেবড়ো পাহাড়, নিম্নভূমি এবং গর্ত ছাড়া কিছুই
নয়।
হ্যাঁ এটাই সত্য যে, অর্ধ শতাব্দী আগে চাঁদের মাটিতে শেষবার
মানুষ পা রাখলেও এখন মানুষ চাঁদে বসবাসের চিন্তা-ভাবনা করছে। অতি সম্প্রতি
নাসা আর্টেমিস-১ মহাকাশযান সফলভাবে চাঁদের কক্ষপথে পরিভ্রমণ করাতে সফল
হয়েছে। এই মহাকাশযানের সাথে পাঠানো হয়েছিল ওরিয়ন ক্যাপসুল। ওরিয়নের কারিগর
হোয়ার্ড হু বিবিসি-র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, "২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে
বসবাস শুরু করতে পারবে মানুষ। আমরা চন্দ্রপৃষ্ঠে লোক পাঠাব। তাঁরা ওখানে
থেকেই বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবেন।"
ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড
স্পেইস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) -এর জন্য ২০২২ সাল যেন এক সোনালি অধ্যায়।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দুর্দান্ত সব ছবি
পাঠানোর রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই নাসা নতুন মিশনে মেতে উঠেছে। চাঁদের কক্ষপথে
রকেট পাঠাচ্ছে তারা। পরিকল্পনা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে আবারও চাঁদে মানুষ
পাঠানোর।
প্রিয় পাঠক, আসুন চন্দ্র অভিযানের কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসের
পথ বেয়ে আমরা ফিরে যাই ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাইয়ের সেই সকালটিতে। কিছুক্ষণ পরেই
দুঃসাহসী তিন নভোচারী --- নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্সকে
নিয়ে প্রায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরের চাঁদের পানে ছুটে যাবে
অ্যাপোলো-১১ নামের নভোযান। যুক্তরাষ্ট্রের কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারের
আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হাতে ক্যামেরা, দূরবীন, রেডিও নিয়ে এক
সমুদ্র কৌতূহল আর কঠিন উত্তেজনায় প্রহর গুনছে হাজার হাজার মানুষ। কারণ,
তারা জানে, রূপকথার চাঁদে পড়তে যাচ্ছে মানুষের পদচিহ্ন। মানবজাতির অনেক বড়
ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে তারা। মানুষ যে একদিন মহাশূন্যের বিশাল
দূরত্বকে জয় করবে এ যে তারই প্রারম্ভ!
স্থানীয় ঘড়িতে তখন ঠিক ৯ টা
বেজে ৩২ মিনিট। কেপ কেনেডির দিগন্তরেখায় আকাশমুখী করে রাখা রকেটের তলদেশে
উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতে শুরু করলো। তীব্র আগুনের হলকার সঙ্গে সাদা ধোঁয়ায়
আচ্ছন্ন চারদিক। ধুমকেতুর মতো আকাশপানে ছুটলো স্যাটার্ণ ফাইভ রকেট।
রকেটটির
উপরের দিকে বিশেষ কায়দায় বসানো আছে কমান্ড মডিউল ও লুনার মডিউল যেখানে তিন
নভোচারী বসে মহাকর্ষের শক্ত বাঁধন ছিন্ন করে চলেছেন।
মহাকর্ষের
মায়া কাটিয়ে অ্যাপোলো-১১ উঠে যাচ্ছে, এই দৃশ্য দেখে হাজার হাজার মানুষ
উল্লাসে ফেটে পড়ে। অনেকেই আবেগের ভার সইতে না পেরে কান্না জুড়ে দিল। এই
কান্না হয়তোবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জয়ের সূচনা দেখতে পারার আনন্দের! অথবা যে
তিন নভোচারী চাঁদের দেশে পাড়ি জমালো তাঁরা আবার পৃথিবীর মাটিতে ফিরে আসবে
কি আসবেনা সেই অনিশ্চয়তাবোধ থেকে। চন্দ্র অভিযানের এই অসাধ্য সাধনের জন্য
কত কঠিন সব প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে তিন নভোচারীকে। এখানে বাস্তবের চেয়ে
প্রশিক্ষণটাই যে বড্ড কঠিন!
কত ঘাম, কত শ্রম, কত অর্থব্যয়ের পর
মানুষ চাঁদে প্রথম পদচিহ্ন আঁকতে পেরেছিলো সে ইতিহাস পৃথিবীর প্রতিটি
বৃক্ষের প্রতিটি পাতায় অঙ্কিত আছে।
মহাকাশে পাঠানো প্রথম প্রাণী
লাইকা নামের একটি কুকুর। ১৯৬১ সালে মহাকাশ থেকে ঘুরে আসা প্রথম মানব ইউরি
গ্যাগারিন। ১৯৬৩ সালে মহাকাশে যান প্রথম নারী ও বেসামরিক নাগরিক
ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। যদিও এই তিনটি অর্জন তৎকালীন সোভিয়েতের কিন্তু
আসলে এইসব অর্জন পৃথিবীর সকল মানুষের।
যাহোক, নীল আর্মস্ট্রং যখন
চাঁদের বুকে নেমেছেন, তখন চাঁদের আকাশে সূর্য নিচের দিকে ঢলে পড়েছে।
চাঁদের ধূসর মাটিতে ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা নীলের ছায়ার দৈর্ঘ্য তখন ৩৫ ফুট।
চন্দ্রপৃষ্ঠের মিহি ধূলোয় পা রাখা প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং সেই স্মরণীয়
উক্তিটি তখন করেছিলেন,"দ্যাটস ওয়ান স্মল স্টেপ ফর (আ) ম্যান, ওয়ান জায়ান্ট
লিপ ফর ম্যানকাইন্ড।" প্রায় ২০ মিনিট পর নীল আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে
চন্দ্রপৃষ্ঠে যোগ দেন বাজ অলড্রিন। চোখের সামনে বাজ দেখতে পেলেন নির্জন,
উষর চন্দ্রপৃষ্ঠ। উচ্ছ্বাসে তিনি বলে উঠেন, "চমৎকার দৃশ্য! অসাধারণ
নির্জনতা!"
চাঁদের মাটিতে দুই ঘন্টা কাটানোর পর নীল আর বাজ
নির্ধারিত সময়ে ঈগলে চড়ে বসেন। তাঁদের গন্তব্য তখন চাঁদের কক্ষপথে ঘূর্ণমান
কমান্ড মডিউল যেখানে অধীরভাবে অপেক্ষা করছেন মাইকেল কলিন্স। কমান্ড মডিউল
পাইলট মাইকেল কলিন্স কলাম্বিয়াকে চাঁদের কক্ষপথে চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে
১২ বার পাক খেয়েছেন তিনি। মৃদু একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দ ছাড়া কোথাও আর কোনো
শব্দ নেই। সেই সময়ের একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতার অনুভূতি উঠে এসেছে তাঁর
"ক্যারিয়িং দ্য ফায়ার" নামের আত্মজীবনীতে। তিনি লিখেছেন, "আমি তখন সত্যিকার
অর্থেই একা। সত্যিকারের কোনো জীবন্ত সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন।" স্মৃতিচারণায়
তিনি আরো বলেছেন, প্রতিবার তিনি যখন চাঁদের উল্টো পিঠে যাচ্ছিলেন, তখন
পৃথিবীর সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল।
নীল আর্মস্ট্রং আর
বাজ অলড্রিন চাঁদে মানুষের প্রথম পা রাখার ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে
চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি ধাতব ফলক স্থাপন করেছিলেন। তাতে খোদাই করে লেখা
ছিল,"জুলাই, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে, এখানে পৃথিবী থেকে মানুষ এসে প্রথম চাঁদের
মাটিতে পা রেখেছিলেন। সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলাম
আমরা।"
প্রিয় পাঠক, আসলেই কি পৃথিবীর মানুষ শান্তিপ্রিয়? প্রাচীনকাল
হতে আজকে পর্যন্ত তাদেরকে যুদ্ধবাজ এবং কলহপ্রিয় বললে কি খুব বেশি বলা
হবে? একটি মর্মান্তিক সত্য হলো, পৃথিবীর মানুষ সভ্যতার উন্নতি ঘটিয়েছে বটে,
তবে পৃথিবীর পরিবেশকে সমানে দূষিত ও কলুষিত করে যাচ্ছে। এতে পৃথিবী
বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
মহাশূন্য জয়ের নেশায় মত্ত মানবজাতির
অগ্রগতি কোথায় গিয়ে ঠেকে তা ভবিতব্যের হাতেই ছেড়ে দিলাম। তবে বিজ্ঞানকে
কিন্তু আধুনিক মানুষের অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার এটাও মানতে হবে,
সূর্যেরও একদিন পতন হবে। পৃথিবীর পরিণতি হবে উত্তপ্ত বুধ ও শুক্র গ্রহের
ন্যায়।
সুতরাং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অসীম শূন্যতা বা দূরত্ব মানবজাতি কতটা জয় করতে পারবে সেটা উত্তরহীন ও অনিশ্চিত।
বিজ্ঞানীদের
মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে জীবন সৃষ্টির অবারিত নিয়ামক। যখন
যেখানে জীবন সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করবে, সেখানেই সৃষ্টি হবে
রহস্যময় জীবন। হয়তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নিত্য চলছে জীবন সৃষ্টি ও ধ্বংসের এক
কঠিন খেলা। মহাকালের সে খেলায় আমরা একটি পরমাণু অপেক্ষা কয়েক কোটি গুণ
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ক্রীড়নক মাত্র। এই যে মানুষ, এই যে মানুষের
সৃষ্টি--- সবকিছুই কিন্তু মৃত্যুতে বিলীন। আর ভবিষ্যৎ পৃথিবী বিলীন হবে
মহাশূন্যের অতল গহীনে। এটাই হলো সৃষ্টির অমোঘ নিয়তি।