শরতের পিচঢালা পথ
নার্গিস খান ||
আষাঢ়ের প্রথম দিবসে বিরহী যজ্ঞ যেমন মেঘের সাথে কথা বলে তেমনি শ্যালকরুপি মিষ্টি সম্মোধনটি ধপাস করে স্পষ্ট নিঃসৃত হয় মাহিনের কন্ঠনালী থেকে। অনিন্দ্য সুন্দর আলপনায় সাজানো বিয়ের পিঁড়ি। কুলোয় ধান দুর্বা, আফসান, পান সুপারি দিয়ে আচ্ছন্ন করা মুহূর্তটি উপভোগ্য বৈ কী।
দূরে কোথাও শোনা যায় তীক্ষ্ণ শীর্ষ ধ্বনির মতো সম্মিলিত ডাক , মনে হচ্ছে দূরাগত শব্দ এগিয়ে আসছে। ছায়াহীন ঝাউপাতাসম যৌবন যেমন উজ্জ্বল সমুদ্রের ন্যায়। ওম লাগা উষ্ণ ঘ্রাণ অনুভূত হয় শিহরণে। জেনেও না জানার ভান করা। অপূর্ব সৃজনে উদ্ভাসিত মন অকৃত্রিম ভালবাসায় মত্ত রুমি। পলাশের সাথে প্রথম দেখা ট্রেনের সহযাত্রী হিসেবে অতঃপর সৌভাগ্যবশত একই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাশাপাশি সিটের বিমোহিত আবিস্কার। পরীক্ষা শেষে একে অপরের সুলুক সন্ধান, উথালি পাতালি ছিটকে যাওয়া আবেগের অশুদ্ধ অপচয় বুঝি ।সান্নিধ্য বা সৌভাগ্য কোনোটি ভাবনায় বুদ্ধি শাসিয়ে বেড়ায়। অনুর্বর জীবনযাপন । অদৃষ্ট স্পর্শে জ্বলে উঠা হাজারো জোনাকি যেন।
ঠিকানা ও ফোন নম্বর মোহ ঘোরে নিঃশব্দে নীল আকাশের বুকে। রুমির পত্র যোগাযোগ পলাশের অনুভবে অনুভূতির উজ্জ্বল্য ঝলসানো । বিষন্ন দেয়াল ছেদ করে মৃত্তিকার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় যন্ত্রণার। কষ্টের প্রলাপ বিলুপে উদিত হয় স্বপ্নছায়া। যান্ত্রিক দিগন্তে কেউ একজন বলে ওঠে সুপ্রভাত। মোড়ানো কাগজের ভাঁজে ভাঁজে মায়াবী স্বপ্নের বীজ বুনা । পুরো চিঠিতে নাম না জানা ফুলের অচেনা সৌরভে নেয়ে উঠা ।জীবনের গন্ধমাখা অদ্ভুদ ব্যক্তিত্বে পরিপূর্ণ । বাঁচনিক আদান-প্রদানে প্রকৃতির নির্মল সুধাপানে উচ্ছ্বাসিত কল্পনার জগৎ সুবিশাল পরিগনিত। পরিণত হচ্ছে শুভক্ষণের কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের। প্রথম দিনের উষ্ণ ভালবাসার আবছা স্মৃতির পাল তুলেছে হৃদয়পটে। বিরহের দিনক্ষণের তড়িৎ স্বয়ংক্রিয়তা আন্দোলিত হচ্ছে । চেতনায় অনুভূত হচ্ছে প্রাণের স্পন্দন। অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। বরের বাড়ি বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত কনের বাড়িতে পৌঁছালো ধুমধাম করে গাড়ি থেকে নামানোর পর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গেইটে মহা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে বরণ করা হলো বেচারা বরকে । জীবনের এ্যানাটমী না মানা কিম্ভুতকিমাকার একজনের ঠাট্টাচ্ছল ঈষৎ ধাক্কায় বরের লুটিয়ে পরা থেকে উদ্ধার করেন বন্ধু জামি । গৃহে প্রবেশের প্রাপ্ত অনুমতি বরের নিজস্বতাকে ভাবিত করে।
পথিমধ্যে ঝক্কিঝামেলা পোহালেও নদীর জলের ঢেউয়ের ন্যায় অচেনা উৎকণ্ঠা তাড়িয়ে বেড়ায়। যথারীতি নানাহ খুনসুটির আশ্রয় পেরিয়ে নির্ধারিত কাজী সাহেবের বদান্যতায়। শরতের নীলাকাশে সাদা মেঘের ভূষণ। খোলা আকাশে তাকিয়ে বর কনে উভয়ে। বান্ধবী ও কাজিনদের রকমারি আচরণের বহিঃপ্রকাশ যেন আবহমানকালের পান্ডুলিপি।
কুয়াশায় ভেজানো পিচঢালা পথের শেষ প্রান্তে দিগন্ত জোড়া সূর্য । কেউ একজন সুপ্রভাত বলার অপেক্ষারত। অরুণ আলোয় আলোকিত পুরো বাড়ি। নব্য ফুলের সৌরভে নেয়ে উঠার অপেক্ষা। নব জীবনে সংযুক্ত হলো এক মেরুকরণ । একে অপরের স্পর্শে জ্বলে উঠবে হাজার জোনাকি। এতদিনের সঙ্গ বঞ্চনা দূরীভূত হওয়ার কাঙখায় দুটি সত্ত্বা। মায়াবী স্বপ্নের জাল বোনার সমুদ্র কাঁপন। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। এখন নতুন বরের হাত ধোয়ানোর পর্ব । বিশাল বড় সম্মানী বা পারিশ্রমিক প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নেতৃত্বের আবরণে আবৃত একজন এগিয়ে আসেন। চেহারায় কোন কিছুর ঘাটতি না থাকলেও পোশাকের ঘাটতি বরের সীমাবদ্ধতায় বেশি দূর এগুতে পারেনি। কাদামাটির সোঁদা গন্ধমাখা গ্রামীণ মায়ের স্নেহের হাতখানি দোলা দিয়ে যাচ্ছে। অসীম আত্মবান কখনও পরাজিত করতে পারেনা ।পলাশের বেলায়ও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি । সম্মানির মাত্রা এতই বেশি যে নিরুপায় বরযাত্রী বুদ্ধি বোধহীন। নির্বাক কনের মায়াবী স্বপ্নিক চাহনি। সুবর্ণ সকালের ডাক খোঁজে বেড়াচ্ছে। বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে বিশাল গুলি, বোমার শব্দ। চারদিকে নিঃস্তব্ধতা। ফুলের সৌরভে উঠতে চাওয়া দিনগুলোর বার্তা মলিন হয়ে যায়। প্লাটফর্মের লাইট ভেঙ্গে যাওয়ার মত নিঃশব্দতার আঁধারে আচ্ছন্ন বিয়ে বাড়ির সবাই। মুহূর্তেই স্বস্তিহীনতা আয়েশী আয়োজনের শৃঙ্খলা কেড়ে নেয় । মৃত্তিকার বুকের যন্ত্রণাকে উথিত করে। কষ্টের প্রলাপ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে রেডিওর তাজা খবরে। ঢাকা শহর রক্তে রঞ্জিত পাকিস্তানি হানাদারদের হামলায়।
সমস্ত শহর আচমকা অতর্কিত হামলায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে হায়েনার দল নিজস্ব পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। আমাদের সৈন্যদের নিরস্ত্র করে ফেলেছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সব তাদের আয়ত্তে নিয়ে গেছে। পলাশ কান খাড়া করে রেডিওর সংস্পর্শে আসে। আন্দোলিত হয় সংযোজিত খবরে।
শ্বাপদ চিতার মত হিংস্র থাবা তোলে নিরীহ বাঙালির উপর। যে যেখানে ছিল সেখানেই তার আত্মবলি হয়েছে। বাড়ি রাস্তাঘাট উদ্যান সবখানে ভয়ানক সংকেতে ঝরে পড়া মানুষের আহ্বান। স্বাধীনতার ক্ষুধিত মানুষের উপর হামলা । শত্রুর ঝাঁঝালো ধনুকের জ্যা থেকে রেহাই পায়নি কেউ। এদিক ওদিক নিস্পন্দন পড়ে আছে হাজারো মানুষের লাশ। স্ত্রস্ত ছুটাছুটি বাঁচার কাঙ্ক্ষায়। পলাশ স্থির থাকতে পারে না। শান্ত নিঃসঙ্গ রুনির স্থিরতায় চ্যুতি ঘটে। আশ্রিতা করতে চায় পলাশের অনুভবী বুকের ক্ষতস্থানে। বিষন্ন দেয়ালে নিজেকে অনুভব করে। আগুন পাতা ভোরের স্থিরহীন অপেক্ষা । জটিল সংশ্লেষের অনুর্বর জীবনের ঘন্টা। উথালি পাথালি পলাশ বেরিয়ে যেতে যৌবনের উন্মাদনায়। জোছনা কবলিত চাঁদ দিনের আলোয় বিলীন হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে অনুভবের দখিনা বাতাস পলাশকে বাহিত করে। আশ্চর্য শিল্পীত নেত্রে ঘরময় রুনির শরীরে ঘ্রাণ। ভোগী জীবনকে স্মৃতির পাতায় ভর করে অপ্রত্যাশিত চোখের আড়ালে চলে যেতে চায়। রুনিতে গভীর রাত্রির কানে বাজে বিরোহিণী ভাটিয়ালি গান। পলাশের স্বাধীনতার নিমজ্জন এড়ানো দুষ্কর রুনির ভাবনাতে পলাশকে সায় দিতে দ্বিধা করল না। হৃদয় পোড়া গন্ধে চারদিক আচ্ছন্ন । কুয়াশার ক্ষুদ্র রেনু চোখের কোনে হাজির হলেও পলাশকে না বলার সসীম সাহসটুকু জাগাতে পারেনি। রুনিও যেতে চায় পলাশের সাথে। অনুভূতির অন্ধ অপচয় হয়তো। হয়তো নিঃশব্দ শিশিরের পায়ে পায়ে এগুতে চায় পলাশের সান্নিধ্যে । স্মৃতিগুলো মেঘের বর্ষণে ঝরে পড়তে চায় ।মনের গহীনে বন বেগুনের কাঁটায় শরীর চিরে যেতে চায়। পলাশের উম লাগা উষ্ণ ঘ্রাণ তীব্র ধাক্কা দেয় রুনির চেতনায় । সঞ্চিত বিয়ে বাড়ির এলোমেলো ভারহীন কলাপাতায় বিছানো মাঠের শস্য যেন। পরিপাটি গুছানো স্বাচ্ছন্দ্য মিলিয়ে যায় পলাশের আত্মত্যাগ আর ইচ্ছায় গভীর জলরাশিতে। মৃত্যুমন্ডিত থাবা জেনেও পলাশ পিছপা নয়। তাকে যেতেই হবে। স্বাধীনতার ডাকে নিজেকে শামিল করতেই হবে। বিলিয়ে দিতে হবে জীবনের জয়গান। মুহুর্তেই স্বাধীনতার সুখানুভূতি শিহরিত করে স্বপ্নগুলো জেগে ওঠে বারবার। পাকিস্তানির উলঙ্গ পাপ মুছে দিতে হবে তাজা রক্তের ঢেউয়ে।
দেশের প্রতি পলাশের বিমোহিত ভালোবাসার স্বাচ্ছন্দ্য তাই বলে যায় রুনির অবশ কানে। পলাশ সূর্য উঁকি দেওয়া ভোরের হাওয়ায় বুভুক্ষু শিল্পীর আঁচরের ছায়ায় চোখের জলের ছাপে পেছনে ফেলে যায়। তাকে যেতেই হবে। যুদ্ধ করে হায়েনাদের হটিয়ে লাল সবুজের আগুন হাতে জ্বালাতে হবে। পরিত্যক্ত মই যেন শীতার্ত রাস্তায় পড়ে থাকা রুনি শান্ত নিঃসঙ্গ রংতুলিতে মনের গহীনে ছবি এঁকে চলে স্বাধীন দেশে পলাশের ফেরার অপেক্ষায় । পলাশ উজ্জ্বল ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলে উঠবে বাংলার শুভ্র শীতল নির্মল আকাশের পূর্ব দিগন্তে। চেতনার দীপ শিখা জ্বলবে প্রতিটি জনে প্রতিটি ক্ষণে। রুনির চৈতন্যের স্পর্শিত ভাবনায় কেবল শুভটুকুই ঘুরপাক খায়।
জাফরানী রঙ
সফিকুল বোরহান ||
নিরন্তর সময় বয়ে যায়। সব ছোটরা একসময় বড় হয়ে ওঠে। প্রচলিত পদ্ধতিগত কাঠামোতে সবাইকেই নাইতে হয়। সামাজিক, আর্থিক, বৈষয়িক, প্রেমজ গতিমেয়তার ধীর বলয় নানামুখী হতে থাকে। পথিকৃৎ যারা তারা অনেক উত্থান অবনমিতর পর ক্লান্ত এখন। দায়িত্ব বিভাজন প্রক্রিয়া সবার মধ্যে ছুটে চলার উদ্দাম আনে ঠিকই, প্রশমিত হতে চায় না পারিবারিক, পরিপার্শ্বিক অস্থিরতা। অর্বাচিন সামাজিক অস্থির পথচলায় অনিমেষ অর্জন দ্যুতিময় প্রত্যয়ের কাছে কিছুটা হলেও বিজয় আনে ঠিকই, পরক্ষণে আবার দুর্বার বেগ ঝড়ো হাওয়া হয়। এভাবেই বুঝি সায়াহ্নের বিমূর্ততায় কেউ দ্রুত আগায় কেউ বা ধীর লয়ে।
পারিজাত সময়ের হাত ধরে সেঁজুতি জোসনা বিলোলিত পথ ধরে পলাশের জীবন আঙিনায় এসে পড়ে শেষ পর্যন্ত। পরম প্রাপ্তির মদিরা ক্ষণ ক্লান্তীময়, এলোমেলো পরিধিতে স্নিগ্ধতার মিহি রঙ ছড়ায়। মর্ত্যরে শুভালোকে অজানা দোলক টুং টাং রিনিক সুর তোলে। আগমনি সেঁজুতির প্রথম স্পর্শ জানান দিল পৃথিবীটা শুধু একমুখী স্রোতস্বিনী নয়। সপ্তবিভায় প্রজ্জ্বলিত শত শিখার আড়ালে যা কিছু নিভু হয়ে আসে তা অপরিমীত। তারপর দুর্বার পথচলায় স্বপ্নীল মোহনা ঝিনুকমুক্তায় পূর্ণ হয়, পিচ্ছিল দোলা আসলেই নরম দু’বাহু কি এক অতি শক্তিতে ডরুনি ছানার শঙ্কামুক্তর মতো পাখির ডানায় আড়াল করে দেয় বুক কাঁপুনিদের। পলাশ কেঁপে কেঁপে ওঠে এমন শুদ্ধ নির্ভরতায়। এতদিনকার অপেক্ষাতে পার্থিব কোন চাওয়া ছিল না বলেই কি অবাক হয় পলাশ এসব দেখে!
তারপর অনাদিকাব্যে মহিমান্বিত হয়ে পলাশ-সেঁজুতি যখন চাঁদ নীচে লীন হয়, নিজেদের ভাসিয়ে দেয় জোসনা ভাসানিতে, চাঁদ বুঝি এতোসব দেখে অবাকই হয়। নীলিমার সবুজ সাঁকো পার হয়ে পলাশ-সেঁজুতি যখন জগৎ জুড়ে শেষহীন পদাবলীর শ্লোকে ডুবে থাকে চাঁদ তখন অমলিন জোসনার হাসিতে পরিতৃপ্তি দেখতে থাকে সেই দূরকালের ছোট্ট পলাশের পুরো অবয়ব জুড়ে।
পলাশ কী এতদিন পর জানতে পারছে স্থিরতার বৈভব! অতি আদরিক পেলব সর্বাঙ্গ, সমস্ত স্বত্বা, সমস্ত আকাশ, পৃথিবী, বাতাসে নবদোলার ঢেউ এনে দেয়। যদিও পলাশ এসব কমনীয় বিবর্তনে সহজ হতে পারে না। এত পাওয়া কি বেশী নয়? সারাটা জীবন সারলিক উজ্জীবতা আর পারিবারিক তরঙ্গায়িত দোদুল্যমানে যে অপ্রকাশ্য ম্রিয়মান জেঁকে বসতো তা কী শিমুল উড়ানিতে মুখর হচ্ছে না দখিনা মলয়!
‘তুমি বেশী পেলবে ডুবছো আমাকে নিয়ে, আমার বহতা আমারই। আমি এর চেয়ে বেশী মসৃনতা চাই না। আমার সুখঘুম শুধু আমার নয়, আমার গৃহকোণ শুধু আমার নয়। সেঁজুতি, আমি তোমার কর্ষণে অভিভুত কিনা জানি না, কিন্তু আমার সবটা অস্তিত্ব জুড়ে যে প্রসারণ সেখানে শুধু একা আমি যেন সাঁতার না কাটি।’
এসব শুনে সেঁজুতি চোখ ভেজায়।
‘পলাশ, তোমার গোপন গহিনে আমি কখনো বাড়ন্ত হতে চাই না, কিন্তু তুমি যে অনির্বাণ দহনে পুড়ে মিইয়ে আছো, তা কী একবার ভেবে দেখেছো। জেগে ওঠা অকৃতিত্বের নয়। আগত সোনালি রোদ জাগতিক প্রতিটা কণাকেই জাগরণী গান শোনায়। তোমার তুমিতে তুমি তো থাকছোই, তুমিতো সপ্তসিন্ধুর বারতায় ভাসছই, তবে কেনো মন বিষাদের চর্চা আসছে। আমি কি কিছু ভুল করছি?’
‘না, না, তা নয়। সবটা ঋতুতেই আমি ফুল ফোটা দেখতে আকুল হই। একেকটা ঋতুর শক্তিমান উদ্ভাসনে পুলকিত হই আমি। সে পুলক যদি পূর্ণপরিধিতে বিচরিত দেখতে পাই, তৃপ্ত হই। মনে হচ্ছে, তুমি যে প্রেরণাদায়িনী হচ্ছো তা ধরে রাখা আমার পক্ষে হয়ে উঠবে কী!’
‘হতেই হবে। তোমার চাওয়ার মাপকাঠি এতদিনে আমি জেনে গেছি। তুমি যে অরণ্যে বিচরিত হও তা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একান্ত নতুন কিছু নয়। এসব নিয়েই দিনলিপি রচতে হয়, নিজের স্বত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে নয়।’
‘ঠিক বলেছো। অন্ধ আবেগে পথ আগায় না, কিন্তু কম্পমান দেশজ রীতি, অনিয়মের জ্বালাপোড়ন, প্রাকৃতিক তান্ডব, পৈশাচিক কুক্ষিগত, হায়েনাদের হিংস্রতা, অভাবী শ্বাপদ আর দেশডুবানোর মাতন দেখতে থাকলে কী রূপকথার সাজানো ডালিতে সাতরঙা আলপনা আঁকতে ইচ্ছে জাগবে!’
‘পলাশ, তোমার বিচরণে তুমি কি কখনো কোনো বৈরী কিছুকে প্রশ্রয় দিয়েছো? তুমি কি লোলুপতার নীলে নিজে কখনো সাঁতার কাটার কল্পনা করেছো, কিংবা কোনো কিছুতে বঞ্চিতের বাত্যাবরণ নিয়েছো? নাওনি। তাহলে? তাহলে নরোম বিক্ষেপে আসো আমরা পথ চলি। অত ক্লান্তির কথা বলতে হয়না। জানি চোখ ভিজবে রক্তিম পরমাণুর প্রতিটি নিউরনের জন্য। বাস্তব সমীক্ষায় প্রতিটা নির্মল পদক্ষেপ তোমাকে স্বস্তি দেবে, প্রশান্তির বিছানো কার্পেট আদর দেবে। অবারিত চোখ ভেজানোর মধ্যে নিঃসীম যন্ত্রণা ছাড়া অন্য কিছু আসতে পারে না। আসো, তোমার প্লাবনী চোখটাতে স্থায়ী টিস্যু পরিয়ে দেই, যাতে আর কোন জল পল্লবী হতে না পারে।’
সেঁজুতির এসব কথায় পলাশ সহজ হয়। আজকের আন্তরিক বিক্ষেপণ খুব স্বস্তিদায়ক হলেও কত কথন ক্ষণে ক্ষণে বনজোনাকির মত জ্বলে জ্বলে ওঠে।
যে সমাজ বৈরী কাঠামোয় আবদ্ধ, যে বিশ্ব যুদ্ধ দিয়ে স্বার্থ উন্মাদনায় মত্ত, যেখানে নৈতিকতা উ™£ান্তের আবর্তে তলিয়ে যায় সেখানে ক্ষুদ্র পারিবারিক ক্ষণস্থায়ী বন্ধনে বেদনার নীল ছোপ তার লিক্লিকে কালো তুলির আলপনা তো আঁকবেই। দলিত সমাজ অক্ষমতার অভিশাপকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে না। অধিপতি যে জন সে তো নিজের গোলা ধানে ধানে পূর্ণ করতেই ব্যস্ত, বিবর্তন প্রথায় সবাই যদি সমতায় চলে আসে কে কার সাথে যুদ্ধে মাতবে, কে কাকে নীল দংশিতায় ডোবাবে, কার গায়ে ভরপুর অলংকার উঠবে!
নিভু নিভু প্রদীপ সলতের গাঁথুনী জড়িয়ে জ্বলা-নিভার যে ঐশ্বরিক রণন ছড়ায়, সেটার মায়াবী দর্শন মনের পলকায় পরাগত হতে না হতেই দপ করে নিভা কিংবা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলার ক্রিয়া বুঝতে না বুঝতেই সায়াহ্ন চলে আসে। আবর্তন প্রক্রিয়ায় নতুন পলাশরা নবরূপে নব মহিমায় নান্দনিক জলক্রীড়া করে। যুদ্ধবাজ আর বহুরূপী হায়েনাদের রিরংসার লোল আরেকমুখীতে ধাবিত হয়। হলদে সরষে ফুলেরা মনসুখ ঝাঁঝ ছড়াতে থাকে। প্রসারিত হতে থাকে তারাদের ঝাঁক।
তবুও জীবন চাঁদ-জোনাকির অমলিন পদ্মচ্ছটায় বিলোলিত হতে থাকে, হতেই থাকে...।
বিশালাক্ষীর যে জীবন, স্মৃতিকাতুরে যোজন শব্দমালায় তার ছিটেফোঁটাও তুলে আনা যায় না একজনমে। শুধু অণুবীক্ষণীয় আবেগ প্রতি অনুরণনে জাগানিয়া সুর তুলতে থাকে যখন, তখনই অনাবিল ছায়াময় দ্যোতনা নেচে গেয়ে ওঠে, হেমন্তী হিমভেজা পেলবে নেয়ে ওঠে মন। হারিয়ে যাওয়া মানবিক কিংবা দানবিক আগ্নেয় স্ফুরণগুলোকে এক করে বিনিসূতোর আবর্তে ঢালতে গেলেই চোখ নরম হয়ে আসার সাথে সাথে মধুরিম বিলোল আনন্দময়ী নাচন দেয়।
ভুলে থাকা, সে এক নিদান দূরের পরাজিত কায়া। যায় না, কোন কিছু ভোলা যায় না। বুভুক্ষতা, হিংস্রতার নগ্ন মাতম আর পারিজাত বলয়ের সোনাক্ষী দিনক্ষণ যা বাসন্তি পরশে চাঁদ মিশেলে জীবনরেণুতে লীন হয়ে আছে তার কাছাকাছি আসার দুর্বিনীত ইচ্ছা থাকাটা স্বপ্নময়। তুলে আনতে গেলেই এক জীবন সজিব ডানাওয়ালা স্বর্গীয় পরিদের সুর করা সবুজ কর্ষণে আর জোনাকির নরম আলোর মাখামাখিতে উদ্ভাসনা চলে আসে। সুখ হয়। আবার আরেক জীবন ধান কাটা কাস্তের প্রতিটা সুচালো রোয়া আর অগ্নিগিরির গভীর বুক থেকে ছিটকে আসা পোড়া লালচে হীরের চেয়েও কঠিন পাথরের রুঢ়তা বুকের পাঁজর কামারের হাঁপড়ের মতো ধপধপ ওঠানামা করে।
জীবন পাঁচমিশেলী! স্নায়ু তাড়িত মানুষ সৃষ্টির উন্মাদনায় তার অজান্তে মেতে উঠে জাগতিক সমৃদ্ধতায়, পূর্ণ করে নিজকে, প্রকৃতিকে। বোধীবৃক্ষের সীমাহীন বিচ্ছুরণে ঘন আবেগী স্বত্ত্বা দু’চোখ ভরে দেখতে শিখিয়েছে সৃষ্টির অবারিত কর্ষণকে। পলাশ দৃষ্টিতে রূপালি মোহতার বুণন এমন আটো করে প্রোথিত করেছিল যে তার শানিত প্রজ্বলন মনের গভীর থেকে সাত আসমান পার হয়ে কোন গগণে বিচরিত হচ্ছিল, হচ্ছিল...। যে জ্বালা ক্ষুধার, যে জ্বালা যুদ্ধের, যে জ্বালা পাশবিকতার, যে জ্বালা কুসংস্কারের তার পরিক্রমিক দলিত সামাজিক বৈরী বহমানগুলো সাদরে বুকে তুলে নিয়ে প্রকৃতির নির্ভার সন্তান চাঁদ-জোনাকির অমলিন পরশে জলভাসানী স্রোতে এগুতেই থাকে। সৃষ্টি প্রসব মুগ্ধতায় অমলিন যে মহান, তার কোন গোপন রহস্যময়তায় মানুষ নামের অতি আদরিক সৃষ্টির মধ্যে জ্বালাময়ী দুখ আর নির্মম বিদ্ধতা ঢেলে সাজিয়েছে ভালবাসা আর রক্তিম চতুর্ময় বন্ধন। পলাশ আদর বোঝে, শরীর পূর্ণতার প্রয়োজনে সজীবতার উপকরণের প্রচন্ড শূন্যতায় সে প্রকৃতি থেকে মনখোরাক তুলে নেয়। অবাক করা চাহনীতে উত্তরহীন প্রশ্নের বাণ আর নিরন্তর বয়ে চলায় প্রাণদুলুনীতে দুলতে থাকে, দেখতে থাকে।
গিতালি হাওয়ায় সেঁজুতির চুল এলোমেলো উড়ছে। দিপ্তিময় আভা ওর চোখে মুখে। রিকশার ছন্দময় চলা আর রূপোলি বিকেলে পশ্চিমাকাশের হলদে-সিঁদুরের মৃন্ময়ী মাখামাখিতে তন্ময় হয় পলাশ। আজকে সেঁজুতি মুক্ত বিহঙ্গী হয়েছে। ও জেনে গেছে সেঁজুতি-পলাশের নতুন অবগাহনের দিনক্ষণের কথা। সেঁজুতি কাঁধব্যাগটা কোলের উপর রেখে দু’আঙুলের নিপুণ ছটকায় ব্যাগচেইনটা খুলে একমুঠো বকুল তুলে বললো, ‘নেবে’!
পলাশ ছুঁেয় দেখে নিল। তারপর বকুলগন্ধায় মদির হতেই সেঁজুতি ওর বা হাত দিয়ে পলাশের কনে আঙ্গুলটা আলতো করে ধরে বলে ওঠে, ‘পলাশ, তোমার চলতি পথে আমার থেকে কোনো হোঁচট আসবে না, দেখে নিও। তুমি তোমাদের যে উঠোনের কথা বলেছ সেখানে আমি দৃপ্ত উপস্থিতির উদাহরণ হতে পারবো। পারবো আমি তোমার ধারাবাহিকতায় পথ চলতে। যদি কখনো মনে হয় তুমি অস্থির হচ্ছো, বলো আমাকে। শুধু দেখিয়ে দিও কী রকম হলে তুমি আজকের মতোই থাকবে।’
‘সেঁজুতি, কেনো বলছো এসব! তোমাকে নিয়ে অপার ভয় আমার। জীবন যে কীরকম বিধুরতায় ডোবে আবার পদ্মসোহাগী হয়, ভাসা-ডোবার পালা যতক্ষণ না আসে কিছু কী বলা যায়! তবে বিপুল বিশ্বাস আমার তুমি যে জলজড়ানীর ছন্দ তুলতে পেরেছো আমি সাহসী হতে পারবোই।’
সেঁজুতি জোরে চেপে ধরে পলাশের আঙ্গুলটা। পলাশ একটা কাঁপুনি লক্ষ্য করে সেঁজুতির। ওর হাতটা একটু বেশীই ঠান্ডা।
‘তোমার কি শরীর খারাপ, তুমি কাঁপছো। ফিরে যাবে বাসায়?’
‘হ্যাঁ পলাশ, আমার ভেতরে পরমানন্দীয় ঝড় বইছে। নিজকে ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আজকের দিনটা আমার এতগুলি বছরের নিদান অপেক্ষার অবসান ঘটালো। তোমাকে নিয়ে বড় দোদুল্যতা ছিল। না, না তোমাকে হারাবার ভয় নয় বরং তুমি নিজে হারিয়ে যাও কি না সে রকম কিছু।
‘আমি ঠিকই আছি, থাকবোও’ বলেই স্বভাবসুলভ হাসিতে রাঙিয়ে দিল পলাশের চৌপাশ।
তারপর সেঁজুতির ঠোঁটতরঙ্গে জাগতিক ঢেউ ওঠে, রবীন্দ্রনাথ ওর ওপর ভর করে। ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা...’। তন্ময় হয় পলাশ। অজান্তে দু’জনার দশ আঙুল বিনুনি হয়ে যায়। পশ্চিমাকাশে অদেখা শক্তিমান শিল্পী তখন দিগন্ত জুড়ে জাফরানী রঙের ওড়না বানাতে ব্যস্ত।
কত বড় হয়ে গেছে পলাশ! জীবনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে দোদুল্যতা না কাটতেই আবার কোন এক নভোমন্ডলে প্রবেশ করার নান্দনিক আহবান। নীল শিহরণ খেলে গেল ধমনীতে। গোপন কাঁপুনি দেখে ফেলছে না তো সেঁজুতি! অবশ্য সুরের ফাঁকে গ্রীবা বাঁকিয়ে বার কয়েক দেখে নিয়েছে পলাশের অবয়ব। দেখলো কী কিছু!
চোখটাকে কিছুতেই প্রবোধ দেয়া যায় না। ছলক মাতম প্রথম কৈশোরটা সামুদ্রিক ঢেউয়ের তোড়ের মতোন বুকের সবটা পাটাতন জুড়ে বসে যায়। সেখানে সেঁজুতির নরম উপস্থিতি জাফরানী ওড়নায় ঢাকা পড়ে যেতে থাকে, যেতে থাকে...।
সফিকুল বোরহান
অন্বেষা, রানির দিঘির পূর্ব পাড়, কুমিল্লা
০১৭১৪-৩৭২২০০
[email protected]দুঃখবিলাস- সামিরা আব্বাস পরশী
রাতের নিরবতার খুব কাছে গিয়ে
দেখতে চাই রাত কতটা গভীর,
কতটা নির্জনতায় আড়াল করেছে
শত সহস্র যুগের আর্তনাদের সুর।
সেই সুর, যেই সুর নিয়ে যায়
কোনো অলি-গলি হীন পোড়ামাটির শহরে।
যেখানে অতৃপ্ত আত্মার চিৎকারে ভেঙে যায়
তীব্র হাহাকার, বিভৎস দেওয়াল। আর?
আর কালো-পেঁচার করুণ চাহনি।
যেখানে চাঁদ ফেঁটে যায়, রক্ত গড়ায়
স্বয়ং রক্তস্রোতে ভেসে যায়।
সেই স্রোত নিয়ে যায় সেজিট্যারিয়াস এ'র জগতে।
কি ভয়ানক এক অন্ধকার জগৎ!
যেন দুমড়ে-মুচড়ে বিলীন করে দেয় সমস্ত অস্তিত্ব।
না ফিরে আসার কোনো স্পর্ধা থাকে!
রাতের নিরবতার কাছে প্রশ্ন রাখলাম -
কিভাবে লুকাও এত শত বছরের তীব্র আর্তনাদ?
"রবির আলো আড়াল করে আমার চিরচেনা বিষাদ।"
হেমন্ত সুখ'জুবাইদা নূর খান
আয় খুকুরা,আয় মণিরা, আয়রে ছুটে আয়,
ধানের নূপুর পরিয়ে দেবো ছোট্ট দু'টি পায়।
মাঠ ভরেছে সোনার ধানে; দেখবি নাকি বল্?
ধানের হাসি দেখতে হলে ত্বরা করে চল্।
জমির ভেতর আলটি ধরে ছুটবো পিছে পিছে,
গাইবো মোরা আনন্দে গান,হাসবো মিছে মিছে।
ঘাস ফড়িং আর প্রজাপতি দেখবো আকাশ পাড়ে
সাদা বকের ধূসর ডানা নজর কেমন কাড়ে।
ভাট ফুলেরা দেখবো ভাসে নীল দরিয়ার বুকে
ডাহুক পাখি চুপটি করে মাছ ধরে শির ঝুঁকে।
চড়ুই পাখির কিচিরমিচির, কোকিল মিহি সুরে
শালিক,কোকিল,টুনটুনিটা ডালে ডালে উড়ে।
ঘাসের ডগায় দেখবি শিশির মিটিমিটি হাসে
সূয্যিমামার কোমল রোদে হৈমন্তী ভোর আসে।
আর দেরী নয় খোকা - খুকু নয়কো মিছে দেরী
ত্বরা করে আয় না সবে খুলে পায়ের বেড়ী।
হেমন্তেরই সুখের পরশ মাখবো মোদের গায়
পাকা ধানের মাতাল ঘ্রাণে প্রাণ জুড়াবে তায়।
শীত মামাকে ডাকবো মোরা শিশির ভেজা হাতে,
নতুন ধানের পিঠে-পুলি পড়বে মোদের পাতে।
মায়া ভরা দেশ যে মোদের রূপের ডালি কত!
রঙের বাহার! সুরের বাহার! এমনি কত শত।
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ