ছিলেন লেগুনাচালক। এরপর বনে গেলেন কোটিপতি। জাকির হোসেনের এই কোটিপতি হওয়ার পেছনে ছিল এক প্রতারণার গল্প। তার এই প্রতারণার শিকার শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা। রেন্ট-এ-কারের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি প্রতারণা করে আসছিলেন। সুলভমূল্যে গাড়ি কেনাবেচার নামে করতেন প্রতারণা।
প্রতারণার টাকায় তিনি গ্রামে আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে একজনকে উপহার দেন প্রাডো গাড়ি। নির্বাচনে বিপুল টাকা খরচ করে হন চেয়ারম্যান। ঢাকায় রয়েছে ফ্ল্যাট-প্লট ও গাড়ি। ছেলেকে পাঠিয়েছেন আমেরিকায়। আগামী নভেম্বরে তারও আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু তার আগেই ২১ সেপ্টেম্বর রাতে কুমিল্লা জেলার মেঘনা থানা থেকে জাকিরকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তিনি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মানিকারচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান।
সম্প্রতি চারদিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জাকিরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২০টি মাইক্রোবাস উদ্ধার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশ।
পুলিশ জানায়, জাকিরের ব্যবসার পেছনে কারা সহযোগিতা করেছে, সবকিছু নিয়ে তদন্ত চলছে। তার গডফাদার কে জানার চেষ্টা চলছে। তদন্ত শেষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, গ্রেফতার জাকির চেয়ারম্যানের প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ী এমনকি সংসদ সদস্যরাও। ভুক্তভোগী শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা ডিবিতে অভিযোগ নিয়ে আসছেন। সবকিছু আমরা তদন্ত করছি।
গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মুগদা থানায় জাকির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একটি প্রতারণার মামলা করেন একজন ভুক্তভোগী। মামলাটি গোয়েন্দা তেজগাঁও জোনাল টিম ছায়া তদন্ত শুরু করে।
তদন্তে জানা যায় যে, জাকির পোর্ট থেকে কম দামে গাড়ি এনে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিতেন।
জাকির যে গাড়ি বিক্রি করতেন, সেটা আবার ক্রেতার কাছ থেকে নিজেই মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে নিতেন। এরপর একই গাড়ি ৩০-৫০ জনের কাছে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বিক্রি করতেন। একই রেজিস্ট্রেশন নম্বরের গাড়ি একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করতেন তিনি। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু ইঞ্জিন নম্বর দিয়ে মাসিক কিস্তি পরিশোধের ভিত্তিতে চুক্তি করতেন। এরপর তিনি কয়েক মাস কিস্তি পরিশোধ করে আর দিতেন না। এভাবে কিস্তি বন্ধ করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়া আগের বিক্রি করা গাড়ি অল্প দামে মালিকানা হস্তান্তরের লোভ দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন।
ডিবিপ্রধান আরও বলেন, জাকির প্রতারণার মাধ্যমে ৬০-৭০টি গাড়ি দেখিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবীর ৬০০-৭০০ জনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। যাদের মধ্যে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্য রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তার মোট গাড়ির সংখ্যা ৬৭টি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এখন পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে বিক্রি করা ২০টি মাইক্রোবাস দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করেছে।
আরও ৪০টি গাড়ির প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো উদ্ধারের জন্য অভিযান চলছে বলে জানান ডিবিপ্রধান।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জাকির জানান, ৫-৬ জনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রতারণা করতেন তিনি। বিভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে আনুমানিক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। জাকির হোসেন তার প্রতিষ্ঠান আর. কে. মটরসের নামে এবং তার আত্মীয়-স্বজনের নামে ২৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া জাকিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৯টি মামলা রয়েছে।
জাকিরের প্রতারণার সঙ্গে বিআরটিএ’র কেউ জড়িত কি না জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান বলেন, বিআরটিএ থেকে জাকির কাগজ করতেন না। একটি গাড়ি একাধিক লোকের সঙ্গে সাধারণ ডিড (চুক্তি) করতেন তিনি।
হারুন অর রশীদ বলেন, যারা জাকিরের কাছে প্রতারিত হয়ে টাকা খুইয়েছেন, তারা থানায় মামলা করতে পারেন। মামলার পর তদন্ত করে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ ব্যবস্থা নেবে।
গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. গোলাম সবুরের নির্দেশনায় অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. শফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে এবং তেজগাঁও জোনাল টিম লিডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. শাহাদত হোসেন সুমার নেতৃত্বে একটি দল জাকির হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।