
রণবীর ঘোষ কিংকর ||
কুমিল্লায়
ব্যাপক আনন্দ-উৎসাহ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়া পাঁচদিনের শারদীয়
দুর্গোৎসব শেষ হলো প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। বুধবার (৫ অক্টোবর)
বিকাল থেকে প্রতিটি পূজা মন্ডপে নেমে আসে বিষাদের ছায়া।
সপ্তমী থেকে
নবমী তিন দিন মায়ের পায়ে পুষ্পার্ঘ অর্পনের পর দশমীর বিকেলে মায়ের পায়ে
সিঁদুর দিয়ে প্রতিটি পূজা মন্ডপে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেন সনাতন নারীরা। এ
সময় সব অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক
বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- এ প্রার্থনা করেন তারা। সিঁদুর খেলায় আনন্দের পর
বিসর্জনে যেন চোখের জলে বুক ভাসান ধর্মপ্রাণ নর-নারীরা।
সনাতন ধর্মের
বিশ্বাস অনুযায়ী, দশমীর বিহিত পূজার শাস্ত্রিয়মতে দর্পণ বিসর্জনের মধ্য
দিয়ে পাঁচদিনের আনন্দ-উৎসবকে অতীত করে ভক্তদের চোখের জলে ভাসিয়ে
দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা স্বপরিবারে মর্ত্যলোক থেকে দেবালয়ে চলে যান। আগামী
বছর ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে ভক্তরা বুধবার সন্ধ্যায় অশ্রুসিক্ত নয়নে
বিদায় দিয়েছেন মাকে। বিকাল ৫টার পর থেকে রাত ১০টার মধ্যেই কুমিল্লার
প্রতিটি পূজা মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন শেষ হয়। আর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী
ফিরে যান কৈলাসে স্বামীর ঘরে। এক বছর পর নতুন শরতে আবার তিনি আসবেন
‘পিতৃগৃহ’ এই ধরণীতে।
শাস্ত্রমতে এ বছর দেবী দূর্গার গমন হয়েছে নৌকায়।
যারফলে পৃথিবীতে শস্য ও জল বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিরাজ করছে। এর আগে মহাষষ্ঠী ও
বোধনের মধ্য দিয়ে দেবী এই ধরণীতে এসেছিলেন গজে (হাতি)।
প্রতি বছর পুজো
আসবে। আনন্দ-উৎসবের পাঁচদিন শেষে বিদায়ের পালা। বিজয়া দশমীর দিন বারবার এই
উপলব্ধির মুখোমুখি হই আমরা। কেননা মন খারাপ করে। তবু সিঁদুরখেলা, বরণডালা
দিয়ে হাসিমুখে বিদায় দিতে হয়। যাকে কেন্দ্র করে কয়েকটা দিন এত আনন্দে কাটল,
সময়ের নিয়ম মেনে আজ তাঁকেই চলে যেতে হবে।
কোনও কিছু নতুন করে পেতে গেলে
যে বারবার হারাতে হয়- একথা লিখে গিয়েছেন বাঙালির আরেক প্রাণের ঠাকুর। সেই
কথা দুর্গামায়ের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও খাটে। এলে তো যেতেই হবে। সেই সার
সত্যকে মেনে নিয়েই বিজয়ার এত আয়োজন।
অসুরবিনাশী মাদুর্গা যে ক’দিন
পিতৃগৃহে ছিলেন ঢোলের বাদ্য, উলু আর কাশার ধ্বনিতে ভক্তি আর আনন্দ মূর্ছনা
দুই-ই জাগিয়েছেন ভক্তদের মনে। বিসর্জনের আগেও চলেছে ঢাক, শঙ্খধ্বনি, মন্ত্র
পাঠ, উলুধ্বনি, অঞ্জলি প্রদান, নৃত্য, মায়েদের সিঁদুর খেলা।
ভক্তরা
বুধবার ধান, দুর্বা, মিষ্টি আর আবির দিয়ে দেবীকে বিদায় জানালেন। আসছে বছর
বসুন্ধরায় আবার এই সময় ফিরে আসবেন মা- এই আকুল প্রার্থনায় ভক্তরা চোখের জলে
বিদায় দিয়েছেন জগজ্জননীকে।
দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার
দিন; এই দিনটি মহালয়া। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন পূর্ণিমায়;
এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বার্ষিক লক্ষ্মীপূজার দিন।
দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা
ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি।
ভক্তরা দুর্গতি নাশিনী দুর্গা
মাকে আহ্বান করে বলে- ‘মাগো, তুমি আমাদের দুর্গতি নাশ করে দাও, আমাদের
মানসপটে লালিত-পালিত হিংসা বিদ্বেষ-হানাহানি দূর করে দাও। আমাদের শক্তি
দাও, আমাদের শান্তি দাও’।
পৌরাণিক মতে, দুর্গাদেবী হলেন ব্রহ্মার মানস
কন্যা। যখন সংসারে অসুরের রাজত্ব চলছিল, চারদিকে অসুরের জয়, অসুরের দাপটে
মানবকূল ত্রাহি ত্রাহি করছিল, অসুর তাদের আসুরিক বৃত্তি দ্বারা সবার
স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল, শান্তি-সমৃদ্ধি হিংসার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে
দিয়েছিল।
সেই আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল মানুষের ভাল গুণ বা মানবীয় সত্ত্বা।
তখন দেবী দুর্গাকে সৃজন করে ব্রহ্মা তাকে সর্বশক্তিতে ভরপুর করে অসুর
বিনাশের জন্য মর্ত্যে প্রেরণ করেছিলেন। তখন দুর্গা দেবী তার দিব্যশক্তির
দ্বারা আসুরী শক্তি বা অপশক্তিকে (অসুরকে) পরাভূত করে পুন:শান্তির জন্য
সামর্থ হয়েছিলেন।
কুমিল্লা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সাধারণ সম্পাদক বীর
মুক্তিযোদ্ধা নির্মল পাল জানান, এবছর প্রশাসনের কঠোর নজরদারীতে ও প্রতিটি
সংসদীয় আসনের এমপি এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় কুমিল্লায় বেশ আনন্দ ও
উৎসব মুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে শারদীয় দুর্গা পূজা। শারদীয় ওই দুর্গা
পূজার মধ্য দিয়ে সব অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির বিকাশের মাধ্যমে
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এই প্রত্যাশাই আমাদের।