
বিভুরঞ্জন সরকার ।।
১৪
সেপ্টেম্বর দুটি ঘটনা ঘটেছে। এক. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে
চার দিনের ভারত সফর নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের
উত্তরও দিয়েছেন। দুই. নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ বা পথরেখা ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আগামী নির্বাচনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে আগামী
নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি
বলেছেন, ‘সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক, সেটাই আমরা চাই। তবে যদি কেউ না
করে, সেটা যার যার দলের সিদ্ধান্ত। সেজন্য আমরা সংবিধান তো বন্ধ করে রাখতে
পারি না। আমরা চাই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী
গণতান্ত্রিক ধারাটি অব্যাহত থাকবে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকবে।
আগামী
জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে নাকি ১৪ দলীয় জোট বা জাতীয় পার্টিসহ
মহাজোট করে অংশ নেবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমরা ১৪ দল করেছি।
জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছি। জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচন করেছে। তবে
তাদের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা ছিল। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে কে কোথায় থাকবে, তা
সময় বলে দেবে। নির্বাচনে যারা সব সময় আমাদের সঙ্গে ছিল। তারা আমাদের সঙ্গে
থাকবে। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’ জোটগত ভোটের প্রশ্নে তিনি বলেন,
আওয়ামী লীগ উদারভাবে কাজ করে। আওয়ামী লীগের দরজা খোলা। নির্বাচনে আওয়ামী
লীগকেই মানুষ ভোট দেবেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে,
নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো হয়নি। তবে জোটবদ্ধ নির্বাচন হওয়ার
সম্ভাবনাই বেশি। তবে এই জোটের পরিধি বা পরিসর কতটা বিস্তৃত হবে, তা সময়ই
নির্ধারণ করবে। বিএনপি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের
সাধাসাধি করে নির্বাচনে আনার সম্ভাবনা কম। বিএনপির দাবি মেনে সরকারের
পদত্যাগ ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিও সরকারের
বিবেচনায় নেই। আন্দোলন করে বিএনপি ও তার মিত্ররা সরকারকে দুর্বল করতে পারবে
তেমন শঙ্কাও সরকারপ্রধানের আছে বলে মনে হয় না।
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ
সম্মেলনের দিনই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা’ প্রকাশ করেছে ইসি। কর্মপরিকল্পনা
প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল
উপস্থিত ছিলেন না। অসুস্থতার কারণে তিনি থাকতে পারেননি বলে জানানো হয়। তার
অনুপস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রধান অতিথি হিসেবে
বক্তব্য দেন। এই কর্মপরিকল্পনায় রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি ও
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে
দেখছে সংস্থাটি। এ ছাড়া আরও ১২টি বিষয়কে চ্যালেঞ্জ মনে করছে ইসি। তবে এসব
চ্যালেঞ্জ উত্তরণের ১৯টি উপায়ের কথা জানানো হয় কর্মপরিকল্পনায়।
২০১৯
সালের ৩০ জানুয়ারি একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে ২০২৩
সালের নভেম্বর থেকে পরের বছর জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হবে। ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন শেষ
করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালের
মার্চে নীতিমালার আলোকে বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তিনশ আসনে সীমানা
পুনর্র্নিধারণ করে খসড়া প্রকাশ করবে ইসি। অন্যদিকে নির্বাচনী আইন প্রণয়নের
ব্যবস্থা করা হবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এ ছাড়া একই বছরের আগস্টে খসড়া
ভোটকেন্দ্রের তালিকার ওপর দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি করবে ইসি। ওই বছরের জুনেই
নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। ইসির
কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত
রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা, বিদ্যমান আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার,
সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নির্বাচন প্রক্রিয়া সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে
সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ নেওয়া, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ।
ইসির পরিকল্পনার মধ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে ভোটার সংখ্যা, জনশুমারি ও ভৌগোলিক
অবস্থানের ভিত্তিতে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমে (জিআইএস) নির্বাচনী
এলাকার সীমানা পুনর্র্নিধারণসংক্রান্ত ডেটাবেস ও অ্যাপ্লিকেশন প্রণয়ন।
কর্মপরিকল্পনায় নির্বাচনের পাঁচটি লক্ষ্যের কথা বলেছে ইসি। সেগুলো হলো
অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাখ্যায় কমিশন বলেছে, ‘ইচ্ছুক সব নিবন্ধিত
রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ।’
কর্মপরিকল্পনার প্রথমেই ইসি বলেছে,
‘নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি
আস্থা সৃষ্টি’ করা। তবে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে বিশেষ কোনো উদ্যোগের
কথা বলেনি তারা। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে অনাস্থা কেটে যাবে বলে মনে
করে ইসি। তবে ইসি নিয়ে যারা গোড়া থেকেই বিরূপ তারা বলছেন, ইসি কীভাবে
আস্থার সংকট কাটাবে, ইভিএমে আস্থা আনবে, পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে,
নির্বাচনের সময় হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করবে, এজেন্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত
করবে- কর্মপরিকল্পনায় এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। ইসির
কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো উত্তরণে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের
দিকেই তাদের তাকিয়ে থাকতে হবে।
অন্যদিকে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশের পর পরই
তা বাতিল করে দিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল
ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, এই নির্বাচন কমিশন তারা মানেন না। তাই
এই কর্মপরিকল্পনা নিয়েও তাদের কোনো বক্তব্য নেই। আর জাতীয় পার্টির মহাসচিব
মো. মুজিবুল হক বলেছেন, ইসির কর্মপরিকল্পনা মূল্যহীন। যে নির্বাচন কমিশনের
ক্ষমতা নেই, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে বলে মনে হয় না।
নির্বাচন
কমিশনও অবশ্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার ক্ষেত্রে অনেক
ধরনের চ্যালেঞ্জ বা বাধা দেখছে। প্রথম বাধাটি হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের
প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো শুরু
থেকেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের অনাস্থার কথা বলে আসছে। এখন
ইসিও মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর
আস্থা থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের
কর্মকর্তারা কতটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে এটি এখন ইসির
দ্বিতীয় চিন্তা। আর নির্বাচনে ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) প্রতি
বেশিরভাগ দলের অনাস্থা ভোট সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে
চিহ্নিত করেছে কমিশন।
এসবের বাইরেও ইসি যেসব প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত
করেছে, তার মধ্যে রয়েছে অর্থ ও পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ; নির্বাচনের সময়
আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা; সব দলের নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ; প্রার্থীদের
নির্বিঘ্ন প্রচার; জাল ভোট বা ভোটকেন্দ্র দখল বা ব্যালট ছিনতাই রোধ;
প্রার্থী বা এজেন্ট বা ভোটারদের অবাধে ভোটকেন্দ্রে আসা; ভোটারদের পছন্দ
অনুযায়ী ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি; নির্বাচনসংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ প্রদান;
পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োগ; পর্যাপ্তসংখ্যক
নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োগ এবং নিরপেক্ষ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকের
ব্যবস্থা রাখা। এসব প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে ১৯টি উপায়ের কথাও বলেছে ইসি।
জাতীয়
নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে
ইসি। এখন তারা বলছে, যন্ত্রটির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি করতে
হবে। কোন প্রক্রিয়ায় ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা নিয়ে বিপরীতমুখী
বক্তব্য এসেছে ইসির কাছ থেকে। এর আগে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন,
ইসি নিজস্ব বিবেচনায় ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে রাজনৈতিক
দলগুলোর মতামত মুখ্য বিবেচনায় ছিল না।
নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় ইসি দাবি
করেছে, গত জুলাইয়ে অংশ নেওয়া সংলাপে ২৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি দল
ইভিএমের পক্ষে বলেছে, ১২টি দল বিপক্ষে। বেশিরভাগ দলের মত ইভিএমের পক্ষে
থাকায় এটি ব্যবহার না করা যুক্তিসঙ্গত হবে না বলে মনে করে কমিশন। তাই কমিশন
উভয় পক্ষের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা
যুক্তিসঙ্গত মনে করে। যদিও সংলাপের শেষদিন সিইসি নিজে ক্ষমতাসীন আওয়ামী
লীগকে বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না।’
কর্মপরিকল্পনায়
ইসি বলেছে, ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন ও জেলা সদরের
আসনগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক মতানৈক্যের কথা তুলে
ধরে যন্ত্রটির পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরা হয় কর্মপরিকল্পনায়। তাতে বলা
হয়, বায়োমেট্রিক (যে বৈশিষ্ট্যের জন্য কাউকে শনাক্ত করা হয় সেই পদ্ধতি)
যাচাই করে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি থাকায় জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ইভিএমে একজন
ভোটার একাধিকবার ভোট দিতে পারে না।
ইভিএমে কারচুপি হয়- অভিযোগটি শুধু
মনস্তাত্ত্বিক ধারণা থেকে করা হয় বলে দাবি ইসির। তারা বলেছে, এ বিষয়ে ইসির
পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় প্রমাণ করার জন্য বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে
আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ অভিযোগটি প্রমাণ করতে পারেনি।
ইসি
বলছে, ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে কারচুপি হয়। তা হলে যে ১৫০ আসনে
ব্যালটে ভোট হবে সেগুলো নিয়ে শঙ্কা থেকে যায় কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, যে আসনগুলোতে ইভিএমে হবে সেগুলো নিরাপদ
করা হলো। বাকি আসনে ফোর্স (আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্য) বেশি খাটানো যাবে।
ইসির হাতে তিন-চার বছর সময় থাকলে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট করা হতো। ৩০০ আসনে
ব্যালটে ভোট হলে ‘রিস্ক’ (ঝুঁকি) অবশ্যই বেশি। এমনো হতে পারে, সে ক্ষেত্রে
একাধিক দিনে ভোট করা হবে।
ভোটের সময় ইসি পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে
পারবে, নাকি আগের মতো আরেকটি নির্বাচন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর
বলেন, ‘সরকার, পুলিশ আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটাই বলা হয়েছে। আমরা এ
কথাও বলেছি, আমরা যদি দেখি আমাদের দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করতে পারছি
না, যে মুহূর্তে থেকে, সে মুহূর্তে আমরা দায়িত্ব পালন করব না।’
নির্বাচনের
আগে হয়রানিমূলক মামলা করা হবে না, ইসি এই নিশ্চয়তা দিচ্ছে কিনা, এমন
প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, যে পরিস্থিতি ইসি
সৃষ্টি করতে চায়, সবার সহযোগিতা পেলে, সে রকম পরিবেশ হলে হয়রানিমূলক মামলা
হবে না।
বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক