
জুলফিকার নিউটন ||
এস, এম সুলতান (১০ আগষ্ট ১৯২৩-১০অক্টোবর ১৯৯৪) তিন অর্থে আদিম তাঁর কাজ লোকজ এবং আধুনিক ঐতিহ্যের প্রান্তে, তাঁর বিষয়াবলী, প্রায়শই, কৃষক জীবনের উপাখ্যান এবং কর্মতৎপরতা থেকে উখিত এবং সবশেষে তাঁর কাজে মানুষ এবং মানুষীর ফিগরসকল শ্রমজীবীশ্রেণী থেকে নেয়া। তিনি এক একক যাত্রী, মুসাফির কিংবা বৈরাগী, সে জন্য তিনি নির্দিষ্ট একটি ধারা কিংবা আচরণবিধির উত্তরাধিকারী নন। তিনি কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন ইংরেজ-ভারতীয় ঐতিহ্যের চিত্রগত ব্যাকরণ; সে জন্য তার মধ্যে ব্যাকরণ নেই। আধুনিক প্রথাসমূহ থেকে বিবর্তিত আঙ্গিক দক্ষতার ওপর তিনি কর্তৃত্ব বিস্তার করেননি, সেজন্য তাঁকে বিত্রস্ত মনে হয়। চিত্রগত সমস্যার ক্ষেত্রে তাঁর সমাধান পুনরাবৃত্তিক, সে জন্য তাঁকে মনে হয়গ্রাম্য সরল। এসব হচ্ছে তাঁর ছেদ এবং এসব ছেদ তাঁকে ভিন্ন করেছে।
সুলতানের শক্তির ভিত্তি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা। তাঁর কৃষক উৎস এবং তাঁর বোহেমিয়ান জীবনস্টাইল পরস্পর প্রবিষ্ট এবং তাঁর চেতনাকে আকার দিয়েছে। তাঁর কাজের দিকে তাকালে মানতে বাধ্য হই এ সকল কাজ উৎসারিত হয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এবং প্রায়শই উদ্দীপিত এবং উচ্চকিত হয়েছে। অভিজ্ঞতার ঐ প্রগাঢ়তা থেকে। তিনি তাঁর কৃষক উৎস থেকে দূরে যেতে পেরেছেন এবং অন্যপক্ষে তাঁর বোহেমিয়ানিজম শ্রেণীবিভাজনের পরপারে তাঁকে নিয়ে গিয়েছে। এ সবই তাঁর কাজে তৈরি করেছে এক ধরনের টেনসন, সে জন্য তাঁর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র উন্মাতাল। তাঁর ফিগরসকল সাধারণত মনুমেন্টাল। মনুমেন্টালিটির কারণে তাদের এবং চতুষ্পর্শ্বের মধ্যে কোন সঙ্গতি নেই। সে জন্য তাদের মনে হয় নাটকীয়। এই নাটকীয়তা তাঁর কাজের কেন্দ্রবিন্দুর ক্ষেত্রে বিপত্তি তৈরি করে। পটভূমির নিসর্গ রংয়ের বাজনায় নাচে,কিন্তু তাঁর নাটকীয় ফিগরসকল কৃষকের শ্রমের নিষ্ঠুর এবং স্থুল শারীরিকতার প্রতিভূ, এই শ্রমের নিষ্ঠুরতা এবং শারীরিকতা রংয়ের নরম নমিত স্কীমের সঙ্গে মেলে না।
এস, এম সুলতান তাঁর পুরুষ এবং নারী ফিগরের মধ্যে তফাত আছে। যে ক্ষেত্রে তাঁর পুরুষ ফিগর দৈত্যাকার এবং পেশল এবং আদিম, সে ক্ষেত্রে তাঁর নারী ফিগর গোলাকৃতি, মদির এবং লাবণ্যময়। একই কাজে, যেমন তেল রংঙে আঁকা গ্রামের বিকেল, তৈরি করে বিষমতা, এক ধরনের দূরত্ব। তেল রংঙে আঁকা ধান তোলা, নদী পার হওয়া, ধান মাড়াই, পুকুরে গ্রাম্য রমণীদের গোসল- এসব কাজে নারী ফিগর মদির এবং মায়াময়, যেন গ্রাম্য কিসসা কাহিনী, গীত থেকে উঠে এসেছে। বিপরীতে তাঁর পুরুষ ফিগরসকল- তেল রংঙে আঁকা জমি দখলের লড়াই, ধান ক্ষেতে কৃষক, লাঙ্গল গরু কৃষক- এ সব জমিন থেকে উঠে এসেছে, যে জমিন তৈরী হয়েছে বাংলাদেশের ভূগোল এবং ইতিহাস থেকে, যে ভূগোল এবং ইতিহাসের মধ্যে আছে। কৃষকের সঙ্গে জমির, কৃষকের সঙ্গে ধানক্ষেতের, কৃষকের সঙ্গে হালবলদের, কৃষকের সঙ্গে জমির দখলের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক নিষ্ঠুর এবং কর্কশ, আবার ভালোবাসার এবং মমতার। কৃষক লড়াকু, কৃষক আবার তার ধানগাছ, তার হালবলদ, তার নারীর প্রেমিক।
সুলতান তাহলে কি ? একজন লুকানো পিকাসো? একজন গোপন ভিনসেন্ট ভান ঘ? সুলতান দুই-ই, খুব সম্ভব আরও। পিকাসোর সঙ্গে তাঁর কতক মিল আছে নাটকীয় ফিগরদের জন্য তাঁর প্যাশনের কারণে। তিনি ভান ঘ’র কাছের তাঁর ব্রাশ স্ট্রোকের ভঙ্গি এবং শক্তির জন্য। তিনি আরও অধিক, বিষয়ের সঙ্গে তাঁর গভীর এবং নিবিড় মমত্ববোধের জন্য। ফল হচ্ছে : একটি ব্যক্তিক ভিশনের উৎপাদন: কিংবদন্তীর বাংলাদেশের ভিশন যার মধ্যে তিনি মিলিয়েছেন তাঁর কৃষক চতুষ্পর্শ। এর ফলে গ্রাম্য মোহনতা কিংবা ভাবালুতা আক্রান্ত গ্রামীণ নিসর্গ আঁকা থেকে তিনি বেঁচে গেছেন। এ ভাবে তাঁর কৃষকসকল অর্জন করেছে একটি মিথনির্ভর বাস্তবতা, আদিমদের এক ধরনের শক্তি এবং ইচ্ছার জোর। তারা সবাই প্রস্তুত, ক্ষিপ্র এবং উদ্যত সংস্কৃতিবান শ্রেণীদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে। তাঁর দরকার আদিমদের ইচ্ছার জোর, তাঁরপ্রয়োজন শ্রেণীচৈতন্যের উদ্দীপনা মধ্য শ্রেণীর ভদ্রতা ছিন্নভিন্ন এবং ইংরেজভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের দৃশ্যমান মদিরতা এবং নিরক্ত কাব্যিকতা বদলে দেয়ার জন্য। তিনি ভিন্ন এবং উন্মাতাল: শিল্প ভুবনের এক কৃষক, অভিজ্ঞতা এবং মনোভঙ্গির দিক থেকে বুর্জোয়াদের বিরোধি এবং বিপরীত।
সুলতানের এই মনোভঙ্গিটাই আমি থেকে থেকে তদন্ত করেছি। সুলতান প্রত্যাখ্যান করেছে পশ্চিমের আধুনিকতা, প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তানের কলোনীর আধুনিকতা, সুলতান বারবার ফিরে গিয়েছে তার শিকড়ে। অধস্তন বিশ্বের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা কি প্রান্তিক? ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা, পাকিস্তান ফেরৎ সুলতানের বক্তব্য হচ্ছে : অধস্তন বিশ্বের শিল্পীরা কেবল এথনিক শিল্পী নয়, তাঁরা প্রান্তিক অভিজ্ঞতার প্রবক্তা কেবল নয়, যে অভিজ্ঞতা অতীতের মধ্যে আবদ্ধ, আধুনিকতা থেকে দূরে। অধস্তনদের অভিজ্ঞতা ঔপনিবেশিকতা, পরাধীনতা এবং দাসত্বের কারণে জটিল, স্বতন্ত্র এবং অনন্য; এই অভিজ্ঞতা জনসমষ্টিকে একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠে এবং চোখে বলবার, দেখবার, ভাববার ক্ষমতা প্রদান করেছে। এই কণ্ঠ এবং চোখ আধুনিকতার উৎপাদন থেকে বহির্ভূত নয়। এ হচ্ছে অন্য এক আধুনিকতা। এ হচ্ছে দেশজ আধুনিকতা, এ হচ্ছে কৃষকদের অভিজ্ঞতা, আউল-বাউল-ফকিরদের গীতের অভিজ্ঞতা, এ হচ্ছে অধস্তন লাঞ্ছিত পরাজিত কৃষক-আউল-বাউলফকিরদের প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা। প্রাত্যহিক জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা আধুনিকতা নামক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে ভিন্ন এক চয়ন এবং বুনন। এই চয়ন এবং বুনন থেকে তৈরি হয় দেশজ আধুনিকতা।
সুলতান যেসব কাজ করেছেন তাতে মনে হয় তিনি একপক্ষে প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈশ্বিক আধুনিকতা এবং অন্যপক্ষে প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈশ্বিক আধুনিকতার অন্তর্গত পাকিস্তানী কলোনীর ধর্মমনস্কতা। রাধা, কৃষক, পশুপাখি, হালবলদ সে জন্য প্রতীক, ফিরে যাওয়ার এবং প্রত্যাখ্যান করার এবং নির্মাণ করার। এ সব থেকে তৈরি হয়েছে দেশজ আধুনিকতার দুই পরিপ্রেক্ষিত এবং দুই পরিপ্রেক্ষিতউদ্ভূত স্থানিক বাঙালিসংস্কৃতি। এই স্থানিক বাঙালিসংস্কৃতি (স্থানিকতা নড়াইল অঞ্চল অর্থে) টিকে থাকে সকল পরিবর্তন এবং দুর্যোগের মধ্যে, টিকে থাকার মধ্যে দিয়ে এই সংস্কৃতি অন্তরিত করেছে এবং আকার দিয়েছে বাঙালিত্বকে, এই বাঙালিত্বের মধ্যে নিমজ্জিত বিভিন্ন প্রান্তিক সংস্কৃতি : কৃষক-আউল-বাউল, লোকজ-ধর্মজ মনোভাব। অন্যপক্ষে এই স্থানিকতা হচ্ছে এক সার প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়া নির্মাণ, পুনর্নিমাণ এবং ভে ফেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান।
এভাবে সুলতানের স্থানিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ফর্ম, যেসব প্রশ্ন করেছে বৈশ্বিক সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানী সংস্কৃতির পরিসর। বৈশ্বিক আধুনিকতার বিপরীত হচ্ছে স্থানিক আবহমানতা, এই আবহমানতা ফের রুখে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানী ধর্মমনস্ক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রাধা, কৃষক, পশুপাখি, হালবলদের ফর্ম নিয়ে। সে জন্য স্থানিকতা একই সঙ্গে আবহমানতা এবং প্রতিরোধ। এই আবহমানতা হচ্ছে মিথ এবং প্রতিরোধ হচ্ছে স্মৃতিনির্ভর। মিথ থেকে তৈরি হচ্ছে সকলদুর্যোগ এবং দুর্ভোগের মধ্যে টিকে থাকার শক্তি, অন্যপক্ষে প্রতিরোধ থেকে তৈরি হচ্ছে জীবনদর্পিতা:জমির জন্য, ধানের জন্য, সন্তানের জন্য, হালবলদের জন্য, প্রেয়সীর জন্য রুখে দাঁড়ানোর ভঙ্গি। আবহমানতার এই ভঙ্গিটি দেশজ আধুনিকতার শক্তি। সে জন্য সুলতানের দেশজ আধুনিকতা বাস্তব, স্পষ্ট এবং ফিগরটিভ। ফিগরের মধ্যে দিয়ে তিনি আবহমানতার শক্তি এবং প্রতিরোধের ডালপালা তৈরি করেছেন। এই ফিগর মধ্য-ভিকটোরীয় স্থাণু ফিগর নয়, এই ফিগর পিকাসোর সক্রিয়তার আমদানি নয়, এই ফিগর ভান ঘ’র সন্ত্রাস তাড়িত নয়: এই ফিগর নড়াইলের জমি থেকে উখিত, নড়াইলের আউল-বাউল-বৈরাগীর খঞ্জনীতে স্পন্দিত।
দেশজ আধুনিকতা কতগুলো জিজ্ঞাসার সূত্র মেলে ধরে। বৈশ্বিক আধুনিকতার মধ্যে ক্রিয়াশীল কলোনিয়াল প্রভুত্ব কলোনীর মধ্যে কতগুলো জিজ্ঞাসা উত্থাপিত করে : ক. কলোনীর বাসিন্দাদের কেন কোন কণ্ঠ/ চোখ নেই, খ. তাদের ইতিহাস কেন বিকৃত এবং অধস্তন, গ, তাদের উৎসে ফেরার উপায় কেন সরল নয় এবং ঘ. বিভিন্ন ছেদের মধ্যে তাদের জীবনযাপন কেন যথার্থ নয়। এসব জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে তারা বৈশ্বিক আধুনিকতার অযথার্থতা এবং কলোনিয়াল নির্যাতনের প্রচন্ডতা উপস্থাপিত করে। এই উপস্থাপন সে জন্য প্রতীক খোজার মধ্যে। এই প্রতীক তাই বাস্তবের বর্ণনা : এই বর্ণনাটাই সুলতান করেছেন দক্ষতা এবং যত্নের সঙ্গে। তাঁর বর্ণিত নড়াইল কিংবা বাংলাদেশ ইতিহাসের কোন পর্বে এটি শনাক্ত করা সহজ নয়। এই নড়াইল কি স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু আমলের ? এই নড়াইল কি পাকিস্তানী কলোনিয়াল আইয়ুব আমলের? এই নড়াইল কি কলোনিয়াল বৃটিশ আমলের? কিংবা তারও আগের? আসলে সুলতানের এটি হচ্ছে প্রয়াস ফিরে যাওয়ার এবং প্রতিষ্ঠিত করার একটি জনসমষ্টিকে প্রতীকের মধ্যে দিয়ে একটি অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুনর্বার যুক্ত করার, যে যুক্ততা এই জনসমষ্টিকে ভাষা খুঁজতে সাহায্য করবে যাতে করে তারা ফের নিজেদের নিজস্ব ইতিহাসসমূহ আত্মসাত করতে পারে। বৈশ্বিক আধুনিকতা এই নিজস্ব ইতিহাসসমূহ উদ্ধার কিংবা পুনরুদ্ধারের সহায়ক শক্তি নয় এবং কলেনীর আধুনিকতা এই নিজস্ব ইতিহাস সমূহ অধস্তন করে রাখে। সুলতান এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কৃষকের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাস্তবতা ফিরিয়ে এনেছেন। কৃষকের জীবনযাপনের অংশ সমাজের বিভিন্ন অধস্তন স্তর এবং কৃষকের মনোজীবনের অংশ সমাজের বিভিন্ন অধস্তন মনোজতা। সুলতান রাধার কাছে, কৃষকের কাছে, পশুপাখির কাছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে এবং বিভিন্ন ইতিহাসের কিংবদন্তী উপাখ্যান গীতির মধ্য দিয়ে ফিরে যেতে চেয়েছেন। সে জন্য তাঁর বাশি দরকার, পশুপাখি দরকার, হালবলদ দরকার ফিরে যাওয়ার মাধ্যম এবং জীবনযাপনের সরঞ্জাম হিসাবে।