ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও উদ্বেগ
Published : Friday, 29 July, 2022 at 12:00 AM
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও উদ্বেগচিররঞ্জন সরকার ||
বাংলাদেশে কিছুদিন ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও খোলাবাজার- উভয় জায়গাতেই টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে চলেছে। ২৬ জুলাই খোলাবাজারে প্রতিডলার বিক্রি হয়েছে ১১২ টাকায়। তা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এ দামেও আশানুরূপ ডলার পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো একদিনে ডলারের দাম বেড়ে এ পর্যায়ে ওঠেনি। বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত এক বছরে আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম ৯ টাকা ৯০ পয়সা বাড়িয়ে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু নির্ধারিত এ দামে খোলাজারে তো নয়ই, ব্যাংকগুলোতেই ডলার মিলছে না। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ডলার সংকট।
ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘাটতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো কোনো ব্যাংক থেকে এলসি খোলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বড় কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দিতে পারলেও ছোট ব্যাংক, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে।
উল্লেখ্য, বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম যেভাবে স্থির হয়, ওই চাহিদা আর জোগানের অঙ্ক মেনেই বিদেশি মুদ্রার সাপেক্ষে টাকার দাম বা টাকার সাপেক্ষে বিদেশি মুদ্রার দাম নির্ধারিত হয়। বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন হয় বৈদেশিক বাণিজ্যের কাজে। বিদেশ থেকে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে হলে টাকায় ওই দাম মেটানো যায় না। এ জন্য ওই দেশের মুদ্রা অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার প্রয়োজন হয়। আবার বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো দেশ কোনো পণ্য বা পরিষেবা কিনলে ওই মূল্য পরিশোধ করতে হয় টাকায়। অর্থাৎ এই লেনদেনের জন্য বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচা চলে। পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, বাংলাদেশের পণ্য ও পরিষেবার দাম মেটানোর জন্য বাজারে যত টাকার চাহিদা- এর তুলনায় বিদেশি পণ্য এবং পরিষেবার দাম মেটাতে বাংলাদেশে ডলারের চাহিদা বেশি, তা হলে স্বভাবতই ডলারের দাম বাড়বে অর্থাৎ টাকার দাম কমবে। তা হলে ডলারের অঙ্কে যেসব পণ্য ও পরিষেবা কিনতে হয় অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমাদের দেশ যা আমদানি করে, এর খরচ বাড়বে।
এই মুহূর্তে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামপতনের বহুবিধ কারণ থাকলেও প্রধান হলো দুটি। এক. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পেট্রোলিয়াম থেকে রকমারি পণ্যসহ সবকিছুরই দাম বেড়েছে অর্থাৎ ডলারের অঙ্কে ওই পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে। বহু ক্ষেত্রেই আমদানির পরিমাণ যেহেতু অন্তত স্বল্পমেয়াদে কমানো অসম্ভব, সেহেতু আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছে। এটি শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেরই। এতে ডলার মহার্ঘ হয়েছে, উল্টোদিকে টাকার দাম পড়েছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়েছে। গোটা দুনিয়াতেই আর্থিক ক্ষেত্রে তুমুল অনিশ্চয়তা চলছে। এই অবস্থায় লগ্নিকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেন। সুদের হার বৃদ্ধি হওয়ায় আমেরিকান ডলারে ওই দেশে টাকা জমা রাখা লাভজনক ও নিরাপদও। ফলে বাংলাদেশের মতো বাজার থেকে লগ্নি তুলে নেওয়ার ঢল পড়েছে।
ডলার সংকটের আরেকটি কারণ বেশি লাভের আশায় একশ্রেণির মানুষের ডলার মজুদ করে রাখার প্রবণতা। খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। এ কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে শেয়ারবাজারের মতো বিনিয়োগ করছেন। এমন গুজবও ছড়ানো হচ্ছে যে, অচিরেই ডলারের দাম দেড়শ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ফলে অনেকে এখন ডলার মজুদ করছেন। বেশি দাম দিয়েও বাজারে খুব বেশি ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকায় অনেকেই ডলার ধরে রাখছেন।
ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি-রপ্তানিতে প্রভাব পড়ছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানির রেকর্ড গড়েও আমাদের আমদানি নতুন রেকর্ড করে ফেলেছে। আমাদের রিজার্ভ কমছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আর এর ফল সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে একটা অস্থিরতা। সরকারি হিসাবে আমাদের রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলার হলেও আইএমএফের মতে সেটি ৩২ বিলিয়নের বেশি নয়। তা মোটামুটি আমাদের চার মাসের খরচ। তিন মাসের খরচে এলেই বিপদসংকেত বেজে উঠবে। আছে সুদের টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা। আমাদের এখনো সব ধারের সুদের টাকা ফেরত দেওয়া শুরু হয়নি। সেটি শুরু হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।
ডলারের তুলনায় টাকার বিনিময়মূল্য কমার প্রভাব সরাসরি পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রল, ডিজেল, এনজির দাম চড়া। পেট্রল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধি মানেই একদিকে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব, অন্যদিকে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়া বহু পণ্য নিয়মিত আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে কিছু সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছায়, কিছু অন্তর্র্বতী পণ্য। সেগুলোরও দাম বাড়ে। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও আবশ্যিক পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বাড়ছে। সরকারিভাবে মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তা ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে বলেই অর্থনীতিবিদদের অনুমান। টাকার দাম কমায় মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা।
মূল্যস্ফীতিকে এক ধরনের ‘কর’ হিসেবে দেখা হয়। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা অনেক মানুষের আবার গরিব হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এদিকে দাম বৃদ্ধির পাওয়ায় আমদানিতে প্রতিডলারের জন্য এখন গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এতে চাপে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে আমদানিকারকরা। যেসব ব্যবসায়ীর রপ্তানি আয় নেই অথচ আমদানি করতে হয়, তারা আরও সমস্যায় পড়েছেন। কারণ আমদানির জন্য ব্যাংকে ডলার পাচ্ছেন না, পেলেও প্রতিডলারের জন্য গুণতে হচ্ছে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। অন্যদিকে কিছুটা স্বস্তিতে আছেন বড় রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা। কেননা রপ্তানি বিল নগদায়নে তারা ভালো দাম হাঁকাচ্ছেন। প্রবাসীদের পরিবারও আগের চেয়ে বেশি আয় পাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের মতো স্বস্তি ও অস্বস্তি আছে ব্যাংকগুলোতেও। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায়ের চেয়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেশি- সেগুলো স্বস্তিতে আছে, বিশেষ করে কয়েকটি বড় ব্যাংক। আর যেগুলোর আমদানি খরচ বেশি এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কম, এসব ছোট ও নতুন ব্যাংক অস্বস্তিতে আছে।
ডলারের দাম যাতে না বাড়ে, এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি জোরদার করেছে। ডলার সংকটের কারণে সরকার আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কমানো উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসী পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে শতভাগ মার্জিন রেখে এলসি খোলার নির্দেশ দিয়েছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান কয়েক দফা কমানো হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগে কোনো কাজ হয়নি। দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ অর্থ বা ডলার খরচ হচ্ছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে তা মিটছে না। এ কারণে আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিজার্ভও কমছে।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আদেশ কমে যাচ্ছে আবার বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এর মধ্যে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এ কারণে শিল্প এলাকার বাইরে অবস্থিত কারখানাগুলো বিভিন্ন সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে এক জটিল অর্থনৈতিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে টাকার দামের পতন ঠেকাবে। স্বভাবতই এটি স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। মাঝারি মেয়াদের কথা ভাবলে ‘রেপো রেট’ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সুদের হার বাড়িয়ে টাকার দামের অবাধ পতন ঠেকানো যেতে পারে। অর্থব্যবস্থায় সুদের হার বাড়লে বিদেশি লগ্নি পুঁজি আকৃষ্ট হয়। ফলে দেশে ডলার ঢোকে, টাকার দামও বাড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এটি অতিব্যবহৃত নীতি। কিন্তু মুশকিল হলো, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগের ব্যয়ও বাড়ে এবং ব্যবসার লাভ কমে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে অভ্যন্তরীণ বেসরকারি লগ্নির ওপর। তা আবার একদিকে প্রভাব ফেলে কর্মসংস্থানের ওপর, অন্যদিকে লগ্নি হ্রাস ও কর্মসংস্থান হ্রাসের ফলে ভোগব্যয় হ্রাস- এ দুইয়ের প্রভাব পড়ে জিডিপির ওপর। তাই নীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা এ মুহূর্তে অতিগুরুত্বপূর্ণ। একদিকে টাকার দাম বজায় রাখা, অন্যদিকে বৃদ্ধির সম্ভাবনা অব্যাহত রাখা- বাংলাদেশ ব্যাংককে এ দুটি কাজই করতে হবে।
এ মুহূর্তে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করতে হবে। এর পাশাপাশি দরকার অপ্রয়োজনীয় আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ। ডলার খরচ করে যেসব কম গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রকল্প হচ্ছে, এতেও ধীরে চলা নীতি নিতে হবে। ডলার সংকট নিরসনে সবাইকে একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই। তা না হলে আগামীতে আমাদের ভয়াবহ বিপদে পড়তে হতে পারে।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক