ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আত্মকথায় স্মৃতি ঃ আমার একাত্তর
Published : Tuesday, 31 May, 2022 at 12:00 AM
আত্মকথায় স্মৃতি ঃ আমার একাত্তরশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
১ ডিসেম্বর বিকেল বেলা কোনো এক জরুরি কাজে বের হয়েছি। দেখি শহরের যে সকল রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে, এ রাস্তা ধরে গাড়ি, গাধার পিঠে বোঝাসহ সম্পূর্ণ অস্ত্রসজ্জিত ভারতীয় সেনাবাহিনি পায়ে হেঁটে মার্চ করতে করতে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মাইকে বলা হচ্ছে- কেউ বাড়ির বাইরে বের হবেন না। দরকার বোধে ট্রেন্সে আশ্রয় নিন। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলাম। একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত হতে চলেছে। মেসোমশায়সহ ভাইরা একত্রে বসে রেডিও শুনছি। শহরটা নিস্তদ্ধ। এমনিতেই যানবাহন কম, সন্ধ্যার পর সবই বন্ধ হয়ে যায়। কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। রাত আটটার পর খেতে বসেছি। আলু ভর্তা, ডিমের ঝোল আর ডাল। থালায় আলু ভর্তা খেয়ে ডিমের ঝোল খেয়েছি, এমন সময় পশ্চিমদিক থেকে অর্থাৎ আখাউড়া থেকে কামানের গুলি ও রকেট শেল আগরতলা শহরের উপর পড়তে শুরু করেছে। আমরা খাওয়া বন্ধ করে ট্রেন্সের ভিতর তড়িঘড়ি করে ঢুকে যাই। এভাবে ১০/১৫ মিনিট চলল। মনে হলো বাসার আশে পাশে শেলগুলো পড়ছে। একসময় বন্ধ হয়ে যায়। কিছুটা সময় কাটিয়ে ট্রেন্স থেকে ওঠে আবার খেতে বসলাম। খাওয়া প্রায় শেষ। তখনই প্রবলভাবে গুলি ও রকেট শেলের শব্দ এবং কুম্ভবন এলাকা থেকে একটি কামান দাগা হচ্ছে, যার শব্দটি খুবই বিকট। প্রথম বুঝতে পারি নাই। শব্দগুলো কোনদিক থেকে কোন দিকে হচ্ছে তা বুঝার মতো তখন বোধ হারিয়ে ফেলি। ট্রেন্সে চলে যাই সবাই আর ট্রেন্স থেকে উঠি সকালে। রেব হয়ে দেখি প্রচন্ড কোয়াশা। চারিদিক এভটাই কোয়াশায় ঢাকা, দু হাত দূরের কিছুই দেখা যায় না। বাসা থেকে ভয়ে ভয়ে রাস্তায় নেমে আসি, কথাবার্তা শুনতে পাই, এভাবে দেখি পাড়ার সবলোকই রাস্তায় এবং জিজ্ঞাসু অভিপ্রায়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। কোথায় গুলিগোলা হচ্ছে, কী হচ্ছে, সবই ভাসা ভাসা। এদিকে প্রচণ্ড কামান, রকেট শেল, গুলির আওয়াজ অনবরত চলছে এবং এক নাগারে তিন দিন পর বন্ধ হয়। তখন খবর পেয়ে যাই ভারতীয় সৈন্য আখাউড়া দখল করেছে, প্রচুর পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে। ধরা পড়েছে, তাদেরকে ট্রাকে করে নিয়ে আসা হচ্ছে- তিন তারিখ বিকেলে বের হয়ে শহরের আখাউড়া রোড দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাকগুলো দেখতে পাই। আহতরা কান্না করছে। অন্যেরা অস্ত্রহীন হাত পা বাঁধা অবস্থায় মাথা নিচু করে বসে আছে। জনতা ব্যাপকভাবে গালিগালাজ করছে, সঙ্গে আমিও। তারপর থেকে বিজয়ের ধারাবাহিক খবর পেতে থাকি নানা মাধ্যমে। মনটা সতেজ হয়ে ওঠে, প্রাণটাতে শক্তি সঞ্চয় হয়। জীবনটাকে সুন্দর বলে মনে হয়। অভাবিত স্বপ্ন এসে ভবিষ্যতকে গ্রাস করতে থাকে। একজন ভীতু, কেবলমাত্র প্রাণ বাঁচানোর প্রবল ইচ্ছায় কাপুরুষের মতো স্ত্রীকে ফেলে পলায়ন করেছি আমি তো মানুষ ছিলাম না। ভাবি, একদিন যখন কোনো প্রসঙ্গে স্ত্রী যদি বলে বসে ‘কই, বিপদের সময় তো আমাকে ফেলে প্রাণ বাঁচাতে চলে গেলে, একবারও আমার কথা ভাবোনি।' মাথা নীচু করে ক্ষমা চাইতে হবে। পরের কথা আগে বলি- একদিন এ বিষয়টি উত্থাপন করে তাঁর মনোভাব জানতে চেয়েছিলাম। অনেকটা প্রাসঙ্গিক দায়মুক্তির জন্য। উত্তর দিয়েছিল- 'তুমিই তো আমার সব। তুমি বেঁচে থাকলে আমার আনন্দ, আমার সুখ। একথা আর বলো না।' সে সময় হয়ত সান্ত্বনা পেয়েছি। নিজের কাছে আজও ছোট হয়ে আছি।
একেবারে ক্ষমার অযোগ্য। যাক এভাবে ষোল ডিসেম্বর ৭১ এলো। সমস্ত দিন। নানা নাটকীয়তার পর বিকেলে রমনা রেইস কোর্সে, যেখানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, মুক্তির কথা বলেছিলেন, সেখানে পাকিস্তান সেনাপতি (পূর্বাঞ্চল) নিয়াজী ভারতীয় লে. জে. অরোবার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। দৃশ্যটি দেখিনি রিডিওর ধারা বর্ণনা শুনে আপ্লুত হয়েছি। শিহরিত হয়েছি। কাপুরুষ সাহসী হয়েছি। সে সময়ে প্রতিটি বাঙালি বাংলাদেশী কী আনন্দ উৎসবে আত্মহারা হয়েছিল, তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। বাংলাদেশ-বাঙালি অনেককিছু হারিয়েছে, পেয়েছে স্বাধীনতা, এরচেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে ।
তখন এক চিন্তা কখন দেশে ফিরব। বাড়ি যাব। মা বাবার কাছে পৌঁছর। মাসীবাড়ি মামাবাড়ি ঘুরে তখনকার বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি পত্র নিয়ে (নিয়ে অনুমতিপত্রের কপি সংযোজন করা হলো): সকলকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।